Beta
শনিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
শনিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৫
৭৪ নাগরিকের বিবৃতি

‘আন্দোলনে এত হতাহতের নজির ১০০ বছরের ইতিহাসে নেই’

পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে শাহবাগে অবস্থান নিয়ে স্লোগানে-প্ল্যাকার্ডে প্রতিবাদ জানান শিক্ষার্থীরা।
[publishpress_authors_box]

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকে ঘিরে ‘শত শত শিক্ষার্থী ও সাধারণ নাগরিক’ হত্যার বিচার দাবি করেছেন দেশের ৭৪ বিশিষ্ট নাগরিক।

তারা বলছেন, এত অল্প সময়ে কোনও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে এমন বিপুলসংখ্যক হতাহতের নজির গত ১০০ বছরের ইতিহাসে (মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ বাদ দিলে) এ দেশে তো বটেই, এই উপমহাদেশেও মিলবে না।

সোমবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়, “আন্দোলনকালে শিক্ষার্থীসহ শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের নিহত, আহত ও নির্যাতিত হওয়ার প্রতিটি ঘটনার তদন্ত হতে হবে। স্বচ্ছ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে তদন্তের স্বার্থে তা জাতিসংঘের উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞ দলের তত্ত্বাবধানে হওয়া জরুরি।”

তাই জাতিসংঘকে এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান তারা।

‘বিক্ষুব্ধ নাগরিকদের’ পক্ষ থেকে বিবৃতিটি পাঠান ড. ইফতেখারুজ্জামান, খুশী কবির, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, শামসুল হুদা ও অ্যাডভোকেট সাইদুর রহমান। যেখানে সই করেছেন ৭৪ নাগরিক।

বিপুল প্রাণহানির দায় সরকারের জানিয়ে তারা বলেন, “সাংবিধানিক শপথ ও আইন উপেক্ষা করে সরকারের একাধিক মন্ত্রী যেভাবে চরম দায়িত্বহীন ভাষায় শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের ওপর তাদের সমর্থক ছাত্রদের ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানালেন, তাতে সারা দেশ এবং বিদেশে বাংলাদেশের জনগণ ও দেশের শুভাকাঙ্ক্ষীরা স্তম্ভিত, গভীরভাবে ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত হয়েছেন।

“শুরু থেকেই সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ও অরাজনৈতিক ছাত্র আন্দোলনকে সরকারি দল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করতে চেয়েছে। অন্যদিকে বিরোধীপক্ষও ছাত্র আন্দোলনের প্রতি সংহতির নামে একে নিজেদের রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের জন্য ব্যবহার করতে চেয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।”

ছাত্র-জনতা হত্যা ও জনগণের সম্পত্তি বিনষ্টের নাশকতার পেছনে যেকোনো ধরনের অপরাজনীতির নিন্দা করে বিশিষ্ট নাগরিকরা বলেন, “সরকারের বল প্রয়োগে কমপক্ষে দুই শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। হাজার হাজার মানুষ গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন। তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন কলেজ ও স্কুলপড়ুয়া ছাত্রছাত্রী এবং খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। এ ছাড়া বিভিন্ন সহিংস ঘটনায় হতাহতের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েকজন সদস্যও রয়েছেন। হতাহতের তালিকায় সংবাদকর্মীরাও আছেন।

“আমরা বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন এ কারণে যে আমাদের আশঙ্কা, সরকারি বাহিনী ও সরকারি দলের সংগঠনগুলোর আক্রমণে হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক ব্যাপক, অনেক ভয়াবহ। ইন্টারনেট ও গণমাধ্যমের ওপর সরকারের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের কারণে যা জানতে পারছি না।”

বেসামরিক নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ দমনে সাঁজোয়া যান নামানো, সেনাবাহিনী ও সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীকে নিয়োজিত করা, কারফিউ জারি করে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ, হেলিকপ্টার থেকে সাউন্ড গ্রেনেড ও অভিযোগমতে গুলি ব্যবহারকে বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিশিষ্ট নাগরিকেরা আরও বলেন, “এই আন্দোলন চলাকালে নাশকতামূলক তৎপরতার কারণে বেশ কিছু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা ও সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে এসব নাশকতার জন্য যারা দায়ী, তাঁদের চিহ্নিত করে আইন অনুযায়ী শাস্তির দাবি জানাচ্ছি আমরা। তবে এই অজুহাতে ভিন্নমতের কাউকে দমন–পীড়ন বা সাধারণ মানুষকে হয়রানি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। নাশকতার ঘটনার সময় তা প্রতিরোধে উপযুক্ত ব্যবস্থা সরকার নেয়নি এবং সরকারি বাহিনীগুলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে বলে গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। সুষ্ঠু তদন্ত করে তাদের এই ভূমিকার রহস্য উদ্‌ঘাটন ও তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা জরুরি।”

বিবৃতিদাতারা বলেন, তারা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ যে প্রাণহানি, ছাত্র-জনতার ওপর হামলা ও গুলিবর্ষণের কোনো তদন্ত না করে পুলিশ শুধু নাশকতার মামলা করে হাজার হাজার অজ্ঞাতনামা লোককে আসামি করেছে। কয়েক হাজার লোককে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের মধ্যে অসংখ্য নিরীহ নাগরিক, শিক্ষার্থী বা তাদের পরিবারের সদস্যরা রয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

শিক্ষার্থী আন্দোলনের সমন্বয়ক-কর্মীদের কয়েকজনকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে তাদের ওপর শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় হাসপাতাল থেকে পুলিশি হেফাজতে নেওয়া হয়েছে, যা অত্যন্ত অনভিপ্রেত ও নিপীড়নমূলক। গণমাধ্যম থেকে এ-ও জানা গেছে যে এলাকা ভাগ করে পুলিশ, র‍্যাবসহ অন্যান্য বাহিনী ‘ব্লক রেইড’ ও নির্বিচার গ্রেপ্তার করে জনমনে, পরিবারে, তরুণসমাজে সীমাহীন ভীতি ও ত্রাসের সঞ্চার করেছে।

এটি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে ওঠার বদলে আরও জটিল ও অশান্ত হওয়ার ইন্ধন জোগাবে বলে বিশিষ্ট নাগরিকদের আশঙ্কা।

এমন পরিস্থিতিতে বিশিষ্ট নাগরিকেরা দেশের বৃহত্তর স্বার্থে, শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ ও সামগ্রিকভাবে শিক্ষাঙ্গনকে নিরাপদ, শিক্ষামুখী রাখতে কয়েকটি দাবি সরকারের কাছে তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে দেশবাসীকেও কঠিন আত্মপ্রত্যয়ে দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে সক্রিয় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন।

তাদের দাবির মধ্যে রয়েছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনকালে পুলিশ, র‍্যাব, অন্যান্য বাহিনী বা সরকারের মদদপুষ্ট বেসরকারি অস্ত্রধারী ব্যক্তিদের হাতে সাধারণ শিক্ষার্থী, শান্তিপ্রিয় নাগরিক, কিশোর-কিশোরী, এমনকি শিশু নিহত, নির্যাতিত ও আহত হওয়ার প্রতিটি ঘটনার তদন্ত হতে হবে।

স্বচ্ছ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে তদন্তের স্বার্থে তা জাতিসংঘের উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞ দলের তত্ত্বাবধানে হওয়া জরুরি। তাই তারা জাতিসংঘকে এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করার আহ্বান জানাচ্ছেন। প্রকৃত দোষী যে-ই হোক, যত উচ্চ পদাধিকারী বা যেকোনো দল–মতের হোক, তাদের আইন অনুযায়ী শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

এছাড়া নিহত-আহতদের প্রতি জাতির সহানুভূতি, শ্রদ্ধা, সম্মান প্রদর্শনের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে যথাযথ মর্যাদায় শোক পালনের ঘোষণা দেওয়া, নিহত-আহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের প্রকৃত সংখ্যা, নাম-পরিচয় অবিলম্বে প্রকাশ, আহতদের পূর্ণ চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়া, আন্দোলনের সমন্বয়ক, সংগঠক, সাধারণ শিক্ষার্থীসহ নাগরিকদের আটক ও নির্যাতনের মতো অশুভ তৎপরতা বন্ধ, শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে শিক্ষাঙ্গনে সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনা এবং পুলিশ ও র‍্যাবের হয়রানি বন্ধের দাবি জানানো হয়।

কারফিউ তুলে দেশে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা, সাঁজোয়া যান, হেলিকপ্টার ও অন্যান্য সরঞ্জাম ফেরত নিয়ে যাওয়া, অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিতে ইন্টারনেটের ওপর সব সরকারি নিয়ন্ত্রণের অবসান এবং ভিন্নমতের মানুষকে হয়রানি ও তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারও বন্ধের দাবি করেন তারা।

সবশেষে গত দিনগুলোয় পুলিশ, র‍্যাব ও অন্যান্য বাহিনীর সহিংস আক্রমণে যে শত শত ছাত্র-জনতা নিহত, আহত ও নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, তাদের স্মরণে একটি জাতীয় নাগরিক শোক সভা আয়োজন করতে দেশের সব বিশিষ্ট ও দায়িত্বশীল নাগরিকের প্রতিও বিশেষভাবে আহ্বান জানানো হয়েছে বিবৃতিতে।

এই বিবৃতিতে যারা সই করেছেন তারা হলেন মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল, হামিদা হোসেন, খুশী কবির, ইফতেখারুজ্জামান, মেঘনা গুহঠাকুরতা, রাশেদা কে চৌধূরী, শুভ্র চক্রবর্তী, ফস্টিনা পেরেইরা, জাকির হোসেন, মাহিন সুলতানা, রুশাদ ফরিদী, রেজাউল করিম চৌধুরী, সাদাফ নুর, তাসনিম সিরাজ মাহাবুব, নুর খান, দীপায়ন খীসা, আরিফা হাফিজ, জাহানারা খাতুন, নারী অধিকারকর্মী শিরিন হক, মুক্তশ্রী চাকমা, সংবিধানবিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক, অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, হোসেন জিল্লুর রহমান, আনু মুহাম্মদ, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না, সুব্রত চৌধুরী, তবারক হোসেন, শরীফ ভূঁইয়া, আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, সারা হোসেন, সাইদুর রহমান, প্রিয়া হাসান চৌধুরী, শারমিন খান, অধ্যাপক আসিফ নজরুল, পারভীন হাসান, গীতি আরা নাসরিন, মো. তানজিমউদ্দিন খান, সুমাইয়া খায়ের, মুশতাক এইচ খান, মির্জা তাসলিমা সুলতানা, ফিরদৌস আজিম, বীনা ডি কস্তা, শাহনাজ হুদা, সাঈদ ফেরদৌস, রোবায়েত ফেরদৌস, নোভা আহমেদ, নাভীদা খান, সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা, ফারহা তানজিন তিতিল, মাইদুল ইসলাম, রিজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা, মানবাধিকার ও ভূমি অধিকারকর্মী শামসুল হুদা, গবেষক ও পর্যবেক্ষক বদিউল আলম মজুমদার, শিক্ষাবিদ স্বপন আদনান, দীনা সিদ্দিকী, পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চার নাসরিন খন্দকার, জ্যেষ্ঠ প্রভাষক মো. সাইমুম রেজা তালুকদার, সাবেক ব্যাংকার নাসের বখতিয়ার, সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, সাঈদা গুলরুখ, সাংবাদিক ও গণমাধ্যম অধিকারকর্মী সালিম সামাদ, মানবাধিকারকর্মী ও পর্যবেক্ষক শারমিন মুরশিদ, গবেষক ও অধিকারকর্মী রেজাউল করিম লেলিন, আলোকচিত্রী ও সমাজকর্মী শহিদুল আলম, লেখক ও গবেষক রেহেনুমা আহমেদ, আলতাফ পারভেজ, কবি ও লেখক আহমেদ স্বপন মাহমুদ, গবেষক ও অধিকারকর্মী রোজিনা বেগম, রেজওয়ান ইসলাম, গবেষক বারিশ হাসান চৌধুরী, অধিকারকর্মী ফজিলা বানু লিলি, ইশরাত জাহান প্রাচী, আদিবাসী অধিকারকর্মী হানা শামস আহমেদ ও সাংস্কৃতিককর্মী অরূপ রাহী।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত