বেসরকারি খাতে আর কোনও স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী (আইপিপি) কেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দেবে না সরকার। আর আইপিপি থেকে শতভাগ বিদ্যুৎ কেনার নীতি থেকেও সরকার সরে আসতে চায়।
শনিবার এক সেমিনারে এ কথা বলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।
‘নবায়নযোগ্য জ্বালানি রূপান্তরে অভ্যন্তরীণ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা’ শীর্ষক ওই সেমিনার সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) মিলনায়তনে আয়োজিত হয়।
জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, “আইপিপি থেকে সরকারই সব বিদ্যুৎ কিনবে- সেখান থেকে আমরা বের হয়ে আসব। মার্চেন্ট বিদ্যুৎ নীতি গ্রহণ করা হবে। বিনিয়োগকারী বিদ্যুৎ উৎপাদন করবেন এবং তারাই বিক্রির জন্য গ্রাহক ঠিক করবেন।
“কারণ, সরকার আইপিপি থেকে সরে আসতে চায়। সরকার ১০ থেকে ২০ শতাংশ আইপিপি থেকে বিদ্যুৎ কিনবে।”
আইপিপি থেকে বের হয়ে আসার কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন, “আইপিপির ক্রেতা সরকার হওয়ায় এখন টাকা দিতে পারছে না। এই নীতি থেকে সরে আসবে সরকার।
“নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার ঘটুক, এটি আগের সরকার আন্তরিকভাবে চায়নি। দেশে এখন নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে যেতে হবে। নবায়নযোগ্য শক্তি ছাড়া দেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার কোনও বিকল্প নেই।”
ফাওজুল কবির খান বলেন, “তখন (আওয়ামী লীগ আমলে) বলা হতো নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য সোলার স্থাপন করা যাবে না, আমাদের জায়গা নেই। এটি ভ্রান্ত ধারণা। বরং জোর করে মানুষের জমি নিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে। এখন এটা বন্ধ করতে চাচ্ছি। অব্যবহৃত জমি নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য ব্যবহার করার চেষ্টা চলছে।
“তবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের ইক্যুইপমেন্ট আমদানি শুল্ক কমানো হবে না। স্থানীয় পর্যায়ে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প গড়ে তোলার জন্য সরকার এ খাতে শুল্ক রাখবে।”
“ইকোনমিক জোন নির্মাণের নামে সাধারণ মানুষের অনেক জমি অধিগ্রহণ করলেও সেখানে কিছুই করা হয়নি। এতে সৃষ্টি হয়নি কর্মসংস্থানও।”
অর্থায়ন সংকট ও কারিগরি প্রযুক্তির অভাবও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের ক্ষেত্রে সমস্যা বলে উল্লেখ করে উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, “নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রকৃত সমস্যা কোথায়, সেটি চিহ্নিত করা দরকার। বর্তমান সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে রেল, সড়কসহ বিভিন্ন খাতের অব্যবহৃত জমি ব্যবহার করবে।
“আওয়ামী লীগ সরকার বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রয়োগ করে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে যেসব সম্মতিপত্র দিয়েছিল, সেগুলো এখন আর প্রযোজ্য হবে না।”
উম্মুক্ত ক্রয় আদেশ পদ্ধতি ফিরিয়ে আনা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “দেশের অর্থনীতির প্রধান সমস্যা সরকারি ক্রয়ে প্রতিযোগিতার অভাব। এজন্য আমরা সব উন্মুক্ত করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখন আর সরকারের সাথে ব্যবসা করার জন্য মন্ত্রী, সচিবদের আত্মীয় হওয়া লাগবে না, চেনা লাগবে না।”
ব্যাংকগুলো নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে ঋণ না দেওয়ায় সমালোচনা করেন উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, “ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৩ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে নাবায়নযোগ্য জ্বালানির কত? বরং বেশিরভাগই অন্যান্য খাতে। অথচ ব্যাংকগুলো নাবায়নযোগ্য জ্বালানিতে ঋণ দিতে এগোয়নি। তারা ব্যালেন্স সিট নির্ভর অর্থায়নে মগ্ন।
“সম্প্রতি বেক্সিমকো ও এস আলমের কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছে না। এদের ব্যালেন্স সিট ফাঁকা। অথচ তাদের খেলাপি ঋণই বেশি। তাই ব্যালেন্স সিট নির্ভর ঋণ দেওয়া কতটা যৌক্তিক? নাবায়নযোগ্য জ্বালানিতে কেন অর্থায়ন করছে না ব্যাংক?”
“এ সমস্যার সমাধান বিগত সরকার আন্তরিকভাবে চায়নি। এমনকি নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার হোক তা চায়নি। তাই অর্থায়ন সমস্যা রয়ে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকার নতুন নীতির মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধান করবে।”
নবায়নযোগ্য জ্বালানি ছাড়া দেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার কোনও বিকল্প নেই বলেন উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, “নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে সরকার রেল, সড়কসহ বিভিন্ন খাতের অব্যবহৃত জমি ব্যবহার করবে। এজন্য শিগগিরই একটি নীতি করা হবে।”
অনুষ্ঠানে সিপিডির গবেষণা পরিলাচক খন্দকার গোলদম মোয়াজ্জেম বলেন, “নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে অর্থায়ন সহজ করতে হবে। বিশ্বব্যাপী ১৮ ধরনের ঋণ ইনস্ট্রুমেন্ট অনুসরণ করা হয়। বাংলাদেশে শুধুমাত্র নন-কনসেশনাল ঋণ দেওয়া হয়। ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্ট্রুমেন্ট বাড়াতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগ আসার পথ সুগম করতে হবে।”
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড পার্টিসিপেটরি রিসার্চের চেয়ারপার্সন গৌরাঙ্গ নন্দী। তিনি সহজে অর্থায়নের জন্য একটি বিশেষ তহবিল গঠনের প্রস্তাব করেন। পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত বাড়তি বিদ্যুৎ সরকারের কাছে বিক্রির ব্যবস্থা করার সুপারিশ করেন তিনি।
ইআরএফ, সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড পার্টিসিপেটরি রিসার্চ, কোস্টাল লাইভলিহুড অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল একশন নেটওয়ার্ক (ক্লিন) ও বিডাব্লিউজিইডি যৌথভাবে এ সেমিনারের আয়োজন করে।
ইআরএফ সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধার সভাপতিত্বে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন। অনুষ্ঠানে দ্য সিটি ব্যাংকের চিফ ইকোনমিস্ট ও কান্ট্রি বিজনেস ম্যানেজার মো. আশানুর রহমান, ক্লিন এর চিফ এক্সিকিউটিভ হাসান মেহেদী বক্তব্য রাখেন।