প্যারিসের স্তাদে দা ফ্রাঁসের সব আলো অল্প সময়ের জন্য নিভে গেল। মুঠোফোনের আলোগুলো তো জ্বলে উঠলোই। নানা রঙের আলোর রোশনাইও দেখা গেল। এরই মাঝে একে একে স্টেডিয়ামের অ্যাথলেটিকস ট্র্যাকে ঢুকলেন ১০০ মিটার স্প্রিন্টের ফাইনালে ওঠা গতিমানবেরা।
ফাইনাল শুরুর আগে স্টেডিয়ামে পিন পতন নীরবতা। ধারাভাষ্যকারের কন্ঠে উচ্ছ্বাস। কে জিতবেন অলিম্পিকের ছেলেদের ১০০ মিটারের সোনা! কে হবেন এবারের অলিম্পিকের দ্রুততম মানব।
দৌড় শেষ করেই স্প্রিন্টারদের সবার চোখ ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ডে। কিন্তু সেখানেও নাটকীয়তা। তখনও যে নিষ্পত্তি হয়নি কে পাচ্ছেন সোনার পদক!
জ্যামাইকান কিশান থম্পসন আর যুক্তরাষ্ট্রের নোয়াহ লাইলস-দুজনের দিকেই টেলিভিশন ক্যামেরা ঘোরানো। দুজনই তখন চূড়ান্ত ফল পাওয়ার অপেক্ষায়। দুজনই যে ফিনিশিং লাইন ছুঁয়েছেন সমান ৯.৭৯ সেকেন্ডে।
শেষ পর্যন্ত ফটো ফিনিশিংয়ে এগিয়ে থেকে সোনা জিতলেন ৯.৭৯ (.৭৮৪) সেকেন্ড সময় নেওয়া লাইলস। আর রুপা জয়ী থম্পসনের টাইমিং ৯.৭৯ (.৭৮৯) সেকেন্ড। যুক্তরাষ্ট্রের আরেক স্প্রিন্টার ফ্রেড কার্লেই ৯.৮১ সেকেন্ড সময় নিয়ে জিতেছেন ব্রোঞ্জ।
লাইলসের হাত ধরে যুক্তরাষ্ট্রের ২০ বছরের অপেক্ষাও যেন ফুরোল। এর আগে ছেলেদের ১০০ মিটারে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে সর্বশেষ সোনা জিতেছিলেন জাস্টিন গ্যাটলিন, ২০০৪ এথেন্স অলিম্পিকে।
এবারের অলিম্পিকটা নিজের করে নিতেই প্যারিসে এসেছেন লাইলস। গত মাসেই নিজের সেরা টাইমিং করেছেন ৯.৮১ সেকেন্ড সময় নিয়ে।
১০০ মিটারের চেয়ে যেন ২০০ মিটারই বেশি পছন্দ লাইলসের। পুরো ক্যারিয়ারে বিভিন্ন বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় ১০ বার জিতেছেন ২০০ মিটারে সোনা। কিন্তু তারপরও বিশ্বের দ্রুততম মানব হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন সব সময়।
বোল্টের অবসরের পর বিশ্ব অ্যাথলেটিকসের ট্র্যাকও বর্ণিল কোনও মহাতারকার আবির্ভাবের অপেক্ষায় ছিল। তবে আপাতত বোল্টের রেখে যাওয়া শূন্যস্থান পূরণ নয়, লাইলসের লক্ষ্য ছিল সর্বশেষ টোকিও অলিম্পিকের ভূত তাড়ানো। টোকিও অলিম্পিক হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালে, লাইলসের লক্ষ্য ছিল সেখানে ১০০, ২০০ ও ৪x১০০ মিটারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার। কিন্তু করোনার কারণে শেষ পর্যন্ত সেই অলিম্পিক হয়েছে এক বছর পর।
তত দিনে চোট ও মানসিক ধকল মিলিয়ে লাইলস বেকায়দায়। ১০০ মিটারে অলিম্পিক ট্রায়াল থেকে বাদ পড়েন। শেষ পর্যন্ত শুধু ২০০ মিটারে অংশ নিয়ে জিতেছিলেন ব্রোঞ্জ। কয়েক দিন আগে লন্ডন ডায়মন্ড লিগে ১০০ মিটারে ব্যক্তিগত সেরা ৯ দশমিক ৮১ সেকেন্ডের টাইমিংয়ের পর লাইলস বলেছিলেন, ‘আমার বুকে এখনও আগুন ধরায় ওই ব্রোঞ্জ। আমি প্যারিসে এটি নিয়েই ঘুরব। নিজেকে মনে করিয়ে দিতে যে এবার আর এই রং নিয়ে ফিরছি না।’
কথা রেখেছেন লাইলস। সোনার পদক নিয়েই ট্র্যাকের চারপাশে ঘুরে বেড়িয়েছেন।
কিন্তু এখানেই থেমে থাকতে চাননা লাইলস। অলিম্পিকে রেকর্ড গড়ে অমরত্বের স্বাদ নিতে চান। হতে চান কিংবদন্তি।
বিষয়টা একটু পরিস্কার করে খুলে বলা যাক। গত বছর বুদাপেস্টে লাইলস ১০০ মিটারে সোনা জেতেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে। পাশাপাশি সেখানে ২০০ মিটার ও ৪ গুনিতক ১০০ মিটার রিলেতেও সোনা জিতেছেন। কিন্তু এবার প্যারিস অলিম্পিকে এই ৩টি ইভেন্টে তো অংশ নেবেনই। অংশ নেবেন ৪ গুণিতক ৪০০ মিটার রিলেতেও। এবং সবকটিতেই সোনা জয়ের ইচ্ছা লাইলসের।
অলিম্পিক ইতিহাসেই কোনও অ্যাথলেট একই গেমসে চারটি ট্র্যাক ইভেন্টে সোনা জেতেননি কখনো। যুক্তরাষ্ট্রের জেসি ওয়েন্স (১৯৩৬ বার্লিন), কার্ল লুইস (১৯৮৪ লস অ্যাঞ্জেলেস) দুজনই ৪টি করে সোনা জিতেছিলেন ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড ইভেন্ট মিলিয়ে। দুজনেরই ১০০, ২০০ ও ৪x১০০ মিটারের সঙ্গে আরেকটা ইভেন্ট ছিল লং জাম্প। এর বাইরে ১৯০০ প্যারিস অলিম্পিকে ৬০ মিটার স্প্রিন্ট, ১১০ মিটার হাই হার্ডলস, ২০০ মিটার লো হার্ডলস ও লং জাম্প মিলিয়ে ৪ সোনা জয়ের কীর্তি আছে যুক্তরাষ্ট্রেরই আলভিন ক্রায়েনজলিনের।
এবার প্যারিসে লাইলসের সামনে হাতছানি তাঁদের ছোঁয়ার, আবার একদিক থেকে তাঁদের চেয়েও আলাদা হয়ে থাকারও।
সেই ধাপের প্রথম সিঁড়িতে তো এরই মধ্যে পা রেখেছেন। বাকি ৩টি ইভেন্টের সময়ও নিশ্চয় পুরো যুক্তরাষ্ট্র তাকিয়ে থাকবে লাইলসের দিকেই।