এক নির্বাচনের আগে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন, আরেক নির্বাচনের পর হতে যাচ্ছে মামলার রায়। তবে রায়ের আগেও ভয়ে আছেন নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার সেই নারী।
তিনি বলছেন, বাড়ির আশপাশে অচেনা লোকের আনাগোনা তাকেসহ পরিবারকে ভীত করে তুলছে।
২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শেষে রাতে ধর্ষণের শিকার হন চার সন্তানের জননী চল্লিশোর্ধ্ব ওই নারী। ঘটনাটি দেশজুড়ে আলোচনার সৃষ্টি করেছিল।
সেই নির্বাচনে জয়ী আওয়ামী লীগের স্থানীয় এক নেতার বিরুদ্ধে ছিল ওই নারীর অভিযোগ। পরে ইউপি সদস্য ওই নেতাকে গ্রেপ্তারও করা হয়।
এক বছর পর ১৬ জনকে আসামি করে পুলিশ অভিযোগপত্র দেওয়ার পর বিচার শুরু হয় নোয়াখালীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে।
গত ১৬ জানুয়ারি রায়ের দিন নির্ধারিত হয়েছিল। তবে তা পিছিয়ে ৫ ফেব্রুয়ারি নতুন তারিখ ঠিক করেন বিচারক ফাতেমা ফেরদৌস।
রায়ের আগে ওই নারী সকাল-সন্ধ্যাকে বলেন, তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
“গত কয়েকদিন ধরে আমার বাড়ির সামনে মোটরসাইকেল নিয়ে লোকজন ঘোরাফেরা করে। তাদের কেউ কেউ মুখ চেনা, কেউ কেউ অচেনা। এ নিয়ে আমি, আমার পরিবার আতঙ্কে আছি।”
বিষয়টি পুলিশকে মৌখিকভাবে জানিয়েছেন বলেও জানান তিনি।
তবে চরজব্বার থানার ওসি মো. রফিকুল ইসলাম বলছেন, তাকে কেউ কিছু জানায়নি।
অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
কী ঘটেছিল সেদিন
ওই নারী জানান, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর ভোটের দিন সুবর্ণচর উপজেলায় নিজের ভোটকেন্দ্রে তিনি ভোট দিতে গেলে ১০/১৫ জন লোক তাকে ঘিরে ধরে তাদের পছন্দের প্রতীকে সিল মারতে বলেছিলেন। এ নিয়ে ওই লোকদের সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে তাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন তারা।
তিনি জানান, এরপর রাত ১২টার দিকে একদল দুর্বৃত্ত তাদের বাড়িতে গিয়ে তাকেসহ তার স্বামী ও চার সন্তানকে বেঁধে ফেলে। এরপর দুর্বৃত্তরা তাকে বেধড়ক পেটায় এবং টেনে হিঁচড়ে বাড়ির পাশে পুকুর পাড়ে নিয়ে দলবেঁধে ধর্ষণ করে।
ওই নারীর অভিযোগ, দুর্বৃত্ত কয়েকজনকে চিনে ফেলায় তারা তাকে গলা কেটে হত্যা করতে চেয়েছিল। তিনি হাত-পা ধরে কান্নাকাটি করে জীবন ভিক্ষা চাইলে দুর্বৃত্তরা তাকে হত্যা না করে ভোর ৫টার দিকে ফেলে রেখে চলে যায়।
সকালে প্রতিবেশীদের সহায়তায় ওই নারীকে ২৫০ শয্যা নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা
ঘটনায় পরদিন ওই নারীর স্বামী বাদী হয়ে নয়জনকে আসামি করে চরজব্বার থানায় মামলা করেন। আসামিরা হলেন- স্থানীয় বাসিন্দা মো. সোহেল (৩৫), মো. হানিফ (৩০), মো. স্বপন (৩৫), মো. চৌধুরী (২৫), মো. বেচু (২৫), বাদশা আলম (৪০), আবুল (৪০), মোশারফ (৩৫) ও ছালাউদ্দিন (৩৫)।
মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামিরা তার বসতঘর ভাঙচুর করে ঘরে ঢুকে বাদীকে পিটিয়ে আহত করে এবং সন্তানসহ তাকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে দলবেঁধে ধর্ষণ করে।
তদন্তকালে গ্রেপ্তার রুহুল আমিন
মামলার এজাহারে আসামির তালিকায় উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন প্রচার সম্পাদক রুহুল আমিনের নাম না থাকলেও ধর্ষণের শিকার ওই নারী অভিযোগ করে আসছিলেন, ভোটের সময় রুহুল আমিনের ‘সাঙ্গপাঙ্গদের’ সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি হয়েছিল। এরপর রাতে তারা বাড়িতে গিয়ে স্বামী-সন্তানকে বেঁধে তাকে ধর্ষণ করে।
এরপরও চরজব্বার থানা পুলিশ মামলার এজাহার থেকে রুহুল আমিনের নাম বাদ দেয় বলে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের তৎকালীন ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুকের কাছে নালিশ করেছিলেন ওই নারী।
ওই নারী ও তার স্বামীকে হাসপাতালে দেখতে গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গেও কথা বলেছিলেন ডিআইজি গোলাম ফারুক। তখন তিনি এ ঘটনায় রুহুল আমিনের সংশ্লিষ্টতা খতিয়ে দেখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাওয়ার পর জেলা সদরের একটি হাঁস-মুরগির খামার থেকে রুহল আমিনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। রুহুল আমিন চর জুবলী ইউনিয়ন পরিষদের চার নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য। ধর্ষণে সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠার পর তাকে বহিষ্কার করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
ভোটের সম্পর্ক পায়নি মানবাধিকার কমিশন
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদন বলছে, সুবর্ণচরের ওই নারী গুরুতর আঘাত করা এবং তাকে ধর্ষণের অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। তবে সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে এই মারধর ও ধর্ষণের শিকার হওয়ার কোনও সম্পর্ক কমিশন খুঁজে পায়নি।
ওই নারীর স্বামীর দায়ের করা এজাহারের বরাত দিয়ে কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, পূর্ব শত্রুতার জেরেই এ ঘটনা ঘটেছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক তখন বলেছিলেন, কমিশনের তদন্ত কমিটি ওই নারীকে গুরুতর আঘাত ও ধর্ষণের সঙ্গে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কোনও সম্পর্ক আছে বলে প্রমাণ পায়নি। তবে প্রাথমিকভাবে ওই নারী যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, তার সত্যতা মিলেছে।
আক্রান্ত ওই নারীকে দেখতে আরও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের নেতারাও তখন নোয়াখালীতে গিয়েছিলেন।
বিচার পরিক্রমা
পরের বছর ২০১৯ সালের ২৭ মার্চ রুহুল আমিনসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্যদিয়ে শুরু হয় বিচার।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর সালেহ আহমদ সোহেল খান জানান, আলোচিত এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ ২৩ জন সাক্ষী উপস্থাপন করে। আসামিপক্ষ চারজন সাফাই সাক্ষী উপস্থাপন করে।
১৬ জানুয়ারি রায়ের দিন ঠিক হলেও সেদিন পিছিয়ে যাওয়ার বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের স্টেনোগ্রাফার মো. সালাহ উদ্দিন বলেছিলেন, এটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং বড় মামলা। এ কারণে রায় লেখার কাজে কিছুটা বেশি সময় নিতে হচ্ছে। এখনও কাজ শেষ করা যায়নি। তাই ঘোষিত তারিখ অনুযায়ী রায় ঘোষণা করা সম্ভব হয়নি।
সোমবার সকাল ১১টা থেকে রায় পড়া শুরু হতে পারে বলে আদালতের বরাত দিয়ে জানান এপিপি সোহেল খান।
মামলায় বাদীপক্ষের আইনজীবী, জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি মোল্লা হাবিবুর রছুল জানান, কারাগারে থাকা ১৫ আসামির মধ্যে আটজন দোষ স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
“মামলার শুনানিতে সাক্ষীদের সাক্ষ্যে আসামিদের অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। আমরা আশাবাদী বিচারক রায়ে আসামিদের সর্বোচ্চ সাজার আদেশ দিবেন।”
আসামি কারা কারা
রুহুল আমিন ছাড়া মামলার অন্য আসামিরা হলেন- সুবর্ণচরের মধ্যম বাগ্যা গ্রামের মো. সোহেল (৩৮), মো. হানিফ (৩০), স্বপন (৪২), মো. চৌধুরী (২৫), ইব্রাহীম খলিল বেচু (২৫), মো. বাদশা আলম বসু (৪০), আবুল হোসেন আবু (৪০), মোশারফ (৩৫), মো. সালাউদ্দিন (৩২), মো. জসিম উদ্দিন (৩২), মো. হাসান আলী বুলু (৪৫), মো. মুরাদ (২৮), মো. জামাল ওরফে হেঞ্জু মাঝি (২৮), মো. মিন্টু ওরফে হেলাল (২৮) ও মো. সোহেল (২৮)।
মিন্টু ওরফে হেলাল ঘটনার পর থেকে পলাতক রয়েছেন। বাকি ১৫ জনের মধ্যে আটজন ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি ভুক্তভোগীর
গত ১৬ জানুয়ারি ওই নারী তার স্বামী ও স্বজনদের সঙ্গে আদালতে উপস্থিত ছিলেন।তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “আমার ওপর যে নির্যাতন চালানো হয়েছে, তা আমি এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারিনি। আমি সব সাক্ষ্য প্রমাণ আদালতে হাজির করেছি। আসামিরাও তাদের অপরাধ স্বীকার করেছে। আদালতের কাছে আমি অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি।”