সুইডেনের মালমো এরিনায় বসেছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ লাইভ সংগীত প্রতিযোগিতা ‘ইউরোভিশন’। প্রতি বছর এই ইভেন্টটি সরাসরি টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়। টেলিভিশনে সম্প্রচারিত সবচেয়ে সংগীতের দীর্ঘক্ষণের মিউজিক শো-ও এটি।
এবার মে মাসের ৭ তারিখ থেকে শুরু হয়ে এই কনসার্ট চলে একই মাসের ১১ তারিখ পর্যন্ত। ইউরোভিশন ২০২৪ লাইভ উপভোগ করে সারা বিশ্বের ১৬৩ মিলিয়ন দর্শক। ইউরোপিয়ান ব্রডকাস্টিং ইউনিয়ন এবং সেরিয়েজ টেলিভিশন যৌথভাবে এই ইভেন্টটির আয়োজন করে।
প্রথম ইউরোভিশন কনসার্টটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫৬ সালের ২৪ মে। সুইজ্যারল্যান্ডের লুগানোতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ওই কনসার্ট। সেবার অংশ নিয়েছিল মাত্র ৭টি দেশের প্রতিযোগী। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে এই লাইভ ইভেন্টে প্রতিযোগী দেশের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ইউরোভিশন ২০২৪-এ এবার ৩৭টি দেশ থেকে প্রতিযোগী অংশ নিয়েছে।
এবারের ইউরোভিশন ২০২৪ এর চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন সুইজারল্যান্ডের সংগীত শিল্পী নিমো মেটলার। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একটি বিক্ষোভও হয়েছে কনসার্ট হলের সামনে ফিলিস্তিনে হত্যাযজ্ঞ চালানোর প্রতিবাদে। মূলত ইসরায়েলি শিল্পী এডেন গোলানের অংশ নেওয়ার সময়ই ওই বিক্ষোভটি হয়। ইসরায়েলের এ শিল্পী ছিলেন সেরা পাঁচে।
ইউরোভিশন ২০২৪ এর সেরা পাঁচ শিল্পীদের খুঁটিনাটি নিয়েই এই লেখাটি-
এডেন গোলান
এডেন গোলানের জন্ম ইসরায়েলে। তবে বেড়ে উঠেছেন রাশিয়ায়। এই সংগীতশিল্পী দখল করেছেন ইউরোভিশন-২০২৪ এর পঞ্চম স্থান। ‘হারিকেন’ গানটির জন্য এই পপ শিল্পী পেয়েছেন পঞ্চম স্থানের মর্যাদা।
‘হারিকেন’ গানটির নাম শুরুতে ছিল ‘অক্টোবর রেইন’। ফিলিস্তিনের হামলার প্রেক্ষাপটে লেখা গানটি ইসরায়েলকে সমর্থন করে লেখা। ফলে বেশ কয়েকবার সংশোধন এবং পরিমার্জনের পর আয়োজক কর্তৃপক্ষ গানটি গ্রহণ করতে রাজি হয়।
পপ জনরার সফট মেলো ধাঁচের এই গানটিতে এক্সপেরিমেন্টের পথে হাঁটেননি শিল্পী এডেন গোলান। যেমনটা হালের বহু পপ গানে দেখা যায়। ফলে ইডিএম কিংবা হিপহপের ফিউশন শোনা যায়নি এতে।
গানটির গীতিকার আভি অহায়োন, কেরেন পেলেস এবং স্টাভ বেগার।
স্লিম্যান নেবশি
ফরাসি গায়ক স্লিম্যান নেবশির স্টেজ নেইম মনোনিম স্লিম্যান। ফ্রান্সের মিউজিক রিয়েলিটি শো ‘দ্য ভয়েস- লা প্লু বেল ভুয়া’ দিয়ে তার উত্থান।
ইউরোভিশনে এই শিল্পী অংশ নিয়েছিলেন তার গান ‘মুন অ্যামুও’ (Mon amour) নিয়ে। জিতেছেন ৪র্থ স্থান। মুন অ্যামুও ফরাসি শাসো (Chanson) জনরার গীতিকাব্য ধর্মী একটি গান।
মধ্যযুগের শেষদিকে ফ্রান্সে এই সংগীতের ‘শাসো ধারা’র উদ্ভব। ইউরোপে রেনেসাঁ শুধু চিত্রকলাই পালটে দেয়নি, পাশাপাশি পাল্টে দিয়েছিল সঙ্গীতকেও। কোন কোন বিশেষজ্ঞ মনে করেন রেনেসাঁর গর্ভে এই ‘শাসো’র জন্ম। সংগীতজ্ঞদের বেশিরভাগের মতেই ফরাসি পপ শাসোর আধুনিক রূপ।
এই গানের সঙ্গীতায়োজন করেছেন স্লিম্যান, মের সালাহ এবং ইয়াকব সালাহ। গানটির গীতিকার স্লিম্যান।
জেরি হেইল এবং আলিওনা
ইউক্রেইনের প্রতিযোগী জেরি হেইল এবং আলিওনা জুটি জিতেছেন ৩য় স্থান। এই জুটি তাদের গান ‘টেরেসা অ্যান্ড মারিয়া’ গানটি নিয়ে কনসার্টে অংশ নেয়। ইউক্রেনিয়ান পপ জনরার এই গানের কোরিয়োগ্রাফিতে ফুটে উঠেছে যুদ্ধের ভয়াবহতা।
গানের ব্যাখ্যায় এই জুটি অবশ্য আশাবাদের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। তাদের দাবি গানটি সৃষ্টির পেছনে আলবেনিয়ান- ভারতীয় ক্যাথলিক এবং শান্তিতে নোবেল জয়ী মাদার তেরেসা অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছেন।
গানটির গীতিকার আলিওনা এবং ইয়ানা শেমাইওভা।
বেবি লাসাগনা
রানার -আপ স্থানটিতে জায়গা করে নিয়েছেন ক্রোয়েশিয়ার প্রতিযোগী বেবি লাসাগনা। ‘রিম তিম তাগি দিম’ গানটি নিয়ে তিনি প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেটাল ঘরানার এ গানটি লিখেছেন বেবি নিজেই।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেটাল মানেই টেকনোর সঙ্গে ফিউশন। এতেও তার ব্যতিক্রম দেখা যায়নি। জার্মান ব্যান্ড রামেস্টেইনের প্রভাব ভালোভাবেই টের পাওয়া যায় এই গানে। গান নিয়ে বেবি জানান, কোন এক ক্রুজ শিপে চাকরি মিললেও সে চাকরিতে যোগ দেননি বেবি। আর এই অনুভূতি নিয়েই তার গান ‘রিম তিম তাগি দিম’।
নিমো
তবে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন সুইজারল্যান্ডের পপ এবং হিপহপ শিল্পী নিমো মেটলার। ভিন্ন লিঙ্গের এই শিল্পী (নন বাইনারি জেন্ডার) তার গান ‘দ্য কোড’ নিয়ে ইউরোভিশনে অংশ নেন। গানটির গীতিকার বেঞ্জামিন আলাসু, লাস মিডসিয়ান নাইম্যান, লিন্ডা ডেল এবং নিমো মেটলার। ইডিএম এবং হিপহপ জনরার ফিউশনে তৈরি এই গানটি দর্শক এবং বিচারকদের ভোটে জিতে নেয় প্রথম স্থান।
উইউইব্লগস এ গানটির বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য পাওয়া যায় সমালোচকদের কাছ থেকে। তারপরও এই ব্লগে গানটির রেটিং ১০ এর মধ্যে ৮ দশমিক ৮৩।
সংগীত সমালোচকরা নিমোর কণ্ঠের বৈচিত্র্য এবং সক্ষমতার ভূয়সী প্রশংসা করলেও গানে হিপহপ এবং ইডিএম এর ফিউশনকে বেশ ‘জটিল’ হিসেবেই আখ্যা দিয়েছেন।
তবে অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, গানটি ঠিক এক বসায় শুনে ফেলবার মতো নয়।