এবারের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত আবু সাঈদ অনেকের মনে ফিরিয়ে আনে নূর হোসেনের স্মৃতি। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর বুকে-পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক-গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান লিখে রাজপথে নামা নুর হোসেন বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রেরণার উৎস হয়ে আছেন।
সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় তিন বছর পর পতন ঘটে এরশাদ সরকারের। ১৯৯০ সালে সেই আন্দোলন আরও বেগবান করেছিল ডা. শামসুল আলম মিলন, নাজিরউদ্দিন জেহাদের লাশ।
এমন আরও অনেক নাম অনুপ্রেরণা হয়ে আছে আন্দোলনে, বীর হিসাবে স্মরণ করা হয় তাদের। ডাকটিকেটও আছে তাদের নামে। কিন্তু তাদের খুনের জন্য যারা দায়ী ছিলেন, তাদের কারও কোনও শাস্তি কি হয়েছে? উত্তর আসবে- হয়নি।
কেন হয়নি- সেই প্রশ্নের উত্তরে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবকেই কারণ হিসাবে দেখা হচ্ছে।
এবার শেখ হাসিনার ‘ফ্যাসিবাদী শাসন’র বিরুদ্ধে আন্দোলনে কয়েকশ মৃত্যুর বিচারের প্রতিশ্রুতি এসেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছ থেকে।
আগের আন্দোলনে নিহতদের সহযোদ্ধারা চাইছেন, এই প্রতিশ্রুতির যেন বাস্তবায়ন ঘটে; অতীতের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে না যায়।
বিচারহীনতার বড় মিছিল
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের প্রথম দিন পুলিশের গুলিতে রক্তাক্ত হয়েছিল ঢাকার রাজপথ। সেদিন ভিয়েতনাম দিবসে সংহতি মিছিল বের করেছিল ডাকসু ও ছাত্র ইউনিয়ন। মিছিলটি তৎকালীন মার্কিন তথ্য কেন্দ্রের (বর্তমান প্রেসক্লাবের পশ্চিম পাশে) পাশে এলে বাধে সংঘর্ষ। পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান ছাত্র ইউনিয়নের দুই নেতা মতিউল ইসলাম ও মির্জা কাদের।
তারপর কী হয়েছিল- জানতে চাইলে প্রবীণ রাজনীতিক, তৎকালীন ডাকসুর ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মতিউল-কাদের শহীদ হওয়ার পর তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। এতে বাধ্য হয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদত্যাগ করে। বেশ কিছু দাবি-দাওয়াও সরকার মেনে নেয়।”
মতিউল-কাদেরের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ আছে প্রেস ক্লাবের পাশে কদম ফোয়ারায়। তখন বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়ার প্রতিশ্রুতিও ছিল। কিন্তু তা হয়নি। ফলে চিহ্নিত হয়নি দায়ী ব্যক্তিরা।
কিন্তু মতিউল-কাদেরকে গুলি করার ঘটনায় জড়িত কারও বিরুদ্ধেই কোনও আইনানুগ ব্যবস্থা সে সময় নেওয়া হয়নি, বলেন কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি সেলিম।
সেনাপ্রধান এইচ এম এরশাদ রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার পর ছাত্রদের মধ্য থেকেই প্রথম প্রতিবাদ হয়েছিল, প্রথম রক্তও ঝরেছিল ছাত্রদের।
১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এরশাদ প্রণীত শিক্ষা নীতি বাতিল, ছাত্রনেতাদের মুক্তি এবং গণতন্ত্র ফেরানোর দাবিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিছিলে চলে গুলি। তাতে জাফর, জয়নাল, দিপালী সাহাসহ অন্তত ১০ জন নিহত হয়।
পরের বছর অর্থাৎ ১৯৮৪ সালে আবার ঢাকার রাজপথে ঝরে ছাত্রদের রক্ত। ওই বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি গণআন্দোলন চলাকালে সামরিক বাহিনীর ট্রাক তুলে দেওয়া হয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিছিলে।
তাতে নিহত হন ইব্রাহিম সেলিম ও কাজী দেলোয়ার হোসেন। দুজনই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও ছাত্রলীগের নেতা। তাদের লাশও পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়ে দাফন করে ফেলেছিল।
তার তিন বছর পর নূর হোসেন আত্মদান করেন ঢাকার জিপিওর সামনে। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিতে পুলিশ-বিডিআরের গুলিতে নিহত হন তিনি।
সেদিন কমিউনিস্ট পার্টির আমিনুল হুদা টিটুও নিহত হয়েছিলেন, তার লাশও গুম করে ফেলা হয়েছিল।
১৯৯০ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার পল্টনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ছাত্রদল নেতা নাজিরউদ্দিন জেহাদ। তার লাশ ছুঁয়ে তৎকালীন ছাত্রনেতারা শপথ নিয়েছিলেন, এরশাদ সরকারের পতন না ঘটিয়ে ঘরে ফিরবেন না।
তারপর আন্দোলন তীব্র রূপ নেয়, তার এক পর্যায়ে ওই বছরের ২৭ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় হন ডা. শামসুল আলম খান মিলনকে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে চিকিৎসক পেশাজীবীদের নেতা ছিলেন তিনি।
ডা. মিলনের রক্ত আন্দোলনে স্ফুলিঙ্গ হয়ে জ্বলে উঠেছিল। কবিতা-গানে স্মরণ করা হয় ডা. মিলনকে। তার স্মরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিএসসিতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ আছে।
বলা হয়েছিল, মিলনকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছিল এরশাদের মদদপুষ্ট একটি সন্ত্রাসী চক্র। এক্ষেত্রে বিচার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছিল।
তারপর কী হয়েছিল- জানতে চাইলে ১৯৮৯ সালের ডাকসুর জিএস, জাসদ নেতা মুশতাক হোসেন হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মিলন হত্যার বিচারের নামে আমরা প্রহসন দেখেছি।
“মিলনকে হত্যা তো একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে করা হয়েছে। সেটা তো অনুসন্ধানের মধ্যেই ছিল না। প্রত্যক্ষ গুলি কে করেছে, এসব খোঁজাখুঁজির মধ্যেই তারা ছিল। এত মানুষের মধ্যে তো সাক্ষী পাওয়া যায় না।”
বিষয়িটির পূর্ণ তদন্তের জন্য আইনজীবী শামসুল হক চৌধুরী রায়ের পর আবেদন করেছিলেন জানিয়ে ডা. মুশতাক বলেন, “সেটা আর কোনোদিন আলোর মুখ দেখেনি।”
এরশাদবিরোধী আন্দোলনে অন্য সব মৃত্যু নিয়েও তখনকার এই ছাত্রনেতা বলেন, “অন্য ঘটনাগুলোর তো কোনও বিচারই হয়নি। মিলন হত্যা ছিল সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী, কিন্তু সেটারই এমন করুণ পরিণতি হয়েছে।”
১৯৯০ সালের ডাকসুর জিএস হিসাবে জেহাদের লাশ ছুঁয়ে শপথ নেওয়াদের মধ্যে ছাত্রদলের তখনকার সাধারণ সম্পাদক খায়রুল কবির খোকনও ছিলেন।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমার জানামতে কোনও মামলা তখন নেওয়া হয়নি, পুলিশ বাদী হয়ে করলেও করতে পারে, কিন্তু আমি স্পষ্ট জানি না।”
জেহাদের ছোট ভাই কে এম শহীদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সেই সময় আসলে আমাদের কারও মানসিক শক্তি ছিল না যে আমরা মামলা করব। আমরা শুধু চেয়েছি, আমার ভাইয়ের রক্ত যেন বৃথা না যায়। সেটা বৃথা যায়নি, এটা দেখেই আমরা শান্তি পেয়েছি।
“বিএনপি পরবর্তীতে ক্ষমতায় আসছে …. সুযোগ ছিল মামলা করার, দোষীদের শাস্তি দেওয়ার …. কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি। বিএনপি থেকে একটা উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জেনেছিলাম, সেটিও পরে ফলপ্রসূ হয়নি।”
কয়েক মাস পরে নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি ক্ষমতায় গেলেও কেন তার খুনের বিচার হলো না- জানতে চাইলে দলটির নেতা খোকন সরাসরি উত্তর এড়িয়ে বলেন, “জেহাদ গণতন্ত্রের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন। তার যে চাওয়া ছিল তা তৎকালীন ছাত্রজনতা আদায় করতে পেরেছে। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে, এখনও আমরা প্রতিবছর জেহাদকে স্মরণ করি। তার আত্মত্যাগের পেছনে যে উদ্দেশ্যে, সেই উদ্দেশ্যের পেছনে কাজ করে যাচ্ছি।”
আগে হয়নি, এবার কি হবে
গণআন্দোলনে নিহতদের বিচার না হওয়ার কারণ হিসাবে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবকে দেখিয়েছেন আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমাদের দেশে এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার সাধারণত হয় না রাজনৈতিক কারণে। এসব বিচার করতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা লাগে। এটাই কখনও ছিল না। সবাই শুধু নিজেদের লাভের জায়গাটা হিসাবে রেখেছে। এর দায় রাজনৈতিক দলগুলোকে নিতে হবে।”
কমিউনিস্ট নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, “আন্দোলনে নিহতদের বেলায় দেখা যায়, দাবি আদায় হয়। কিন্তু তাদের মৃত্যুর বিচার হয় না। যদি বিচার হয়ও তাহলেও দেখা যায় আসল অপরাধীর হয় না। বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরিতে এসব ঘটনাও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে।”
বাংলাদেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠার পেছনে এসব ঘটনার বিচার না হওয়াও কারণ বলে মনে করেন মুশতাকও।
তিনি বলেন, “কারণ যারা বিচার করবে, তারাও এই শাসকদেরই অংশ থাকে। এর কারণে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটাতে শাসকরা ভয় পায় না।”
এবার জুলাই-আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে কয়েকশ মানুষ নিহত হয়েছে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি ছাত্র-যুবলীগও হামলায় ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। হতাহতদের সংখ্যা নির্ধারণে কাজ চলছে এখনও।
এবার নিহতরা বিচার পাবে বলে আশা করছেন মুশতাক হোসেন এবং জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
মুশতাক বলেন, “আমার মনে হয়, এবার অন্যান্য বারের মতো হবে না। কিছুটা অগ্রগতি হলেও হবে। হত্যাকাণ্ডের কারণেই হাসিনা সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়েছে। রাজনৈতিক কর্মসূচি না থাকলেও এই হত্যাকাণ্ডের কারণে ছাত্রদের এক দফা দেওয়া ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। ফলে এর বিচার হতেই হবে।”
আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়াও বলেন, “এবার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। আমরাও কাজ করছি। এবার রেজিম পরিবর্তন হয়েছে। রেজিম পরিবর্তন হওয়ায় এবার শাস্তি হওয়ার একটি বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। এই সুযোগ আমরা নিতে চাই। আমরা মনে করি, এবার আমরা এসব শাস্তি দিতে পারব।”
প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন সকাল সন্ধ্যা প্রতিবেদক মেরিনা মিতু