কোভিড-১৯ মহামারির উছিলায় চীনের সঙ্গে নিজের উত্তর সীমান্ত বন্ধ করে দিচ্ছে উত্তর কোরিয়া। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবির ভিত্তিতে তৈরি এক গবেষণা প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) এর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, সীমান্ত এলাকায় মানুষের চলাচল তীব্রভাবে দমন করেছে উত্তর কোরিয়া। যার ফলে আন্তঃসীমান্ত চলাচল ও বাণিজ্যও ব্যাপকভাবে কমেছে।
গবেষণায়, উত্তর কোরিয়ার নাগরিকরাও ক্রমবর্ধমান বিধিনিষেধমূলক ব্যবস্থার কথা বলেছেন।
এইচআরডব্লিউ জোর দিয়ে বলছে, জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর উচিৎ উত্তর কোরিয়ার বিচ্ছিন্নতা ও মানবিক সংকটের অবিলম্বে সমাধান করা।
উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মহামারির উছিলায় সীমান্তে দমনাভিযান জোরদার করেছেন।
শুধু চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের উন্নতির জন্য মাত্র কয়েক মাস আগে সীমান্তটি আবার খুলে দেওয়া হয়েছিল।
‘ত্রাসের অনুভুতি বুলেটের চেয়ে শক্তিশালী : উত্তর কোরিয়ার সীমান্ত বন্ধ করন ২০১৮-২০২৩’ শিরোনামের প্রতিবেদনে কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালে অতিরিক্ত, অত্যধিক এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
স্যাটেলাইট থেকে ছবিগুলোতে ফোকাস করে প্রতিবেদনটিতে দেখানো হয়, সীমান্তে উত্তর কোরিয়া ৪৮২ কিলোমিটার (২৯৯ মাইল) নতুন বেড়া নির্মাণ করেছে। আর বিদ্যমান ২৬০ কিলোমিটার বেড়াও মেরামত করা হয়েছে।
২০১৯ ও ২০২৩ এর মধ্যে ওই ছবিগুলো তোলা হয়। ছবিগুলোতে দেশটির উত্তর সীমান্তের প্রায় এক চতুর্থাংশ এলাকাজুড়ে নতুন গার্ড পোস্ট ও বাফার জোন তৈরির মতো বিষয়ও উঠে আসে। এতে দেশটির মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাপন আরও সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
সীমান্ত অবকাঠামোর সঙ্গে সঙ্গে নিয়ম-নীতিগুলোও আরও কর্তৃত্ববাদীভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। এমনকি সীমান্তরক্ষীদের দেখামাত্র গুলির আদেশও দেওয়া হয়েছে।
এইচআরডব্লিউ জানায়, সীমান্তে নিরাপত্তা স্থাপনার সংখ্যাও ২০ গুণ বেড়েছে। আগে যেখানে মাত্র ৩৮টি গার্ড পোস্ট ছিলো সেখানে এখন ৬,৫০০টির বেশি আছে।
এইচআরডব্লিউর কোরিয়া বিষয়ক গবেষক লিনা ইউন বলেছেন, উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের উচিৎ, “যে নীতিগুলো উত্তর কোরিয়াকে একটি বিশাল কারাগারে পরিণত করেছে সেগুলো বাতিল করার পাশাপাশি বাণিজ্যের জন্য সীমান্ত আবার খুলে দেওয়া। অভ্যন্তরীণ ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাগুলো শিথিল করা এবং রাষ্ট্রীয় পর্যবেক্ষণের আওতায় আন্তর্জাতিক জরুরি সহায়তা প্রবেশে অনুমতি দেওয়া।”
উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে আসা একজন বলেছেন, তিনি তার আত্মীয়দের সঙ্গে কথা বলে জেনেছেন সীমান্ত দিয়ে কোনও চাল ও গম আর দেশে পাঠানো যায় না।
তার আত্মীয় তাকে বলেন, “এখন একটি পিঁপড়াও সীমান্ত পার হতে পারে না।” এতে উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে আসাদের জন্য তাদের পরিবারকে সাহাজ্য করতে বাড়িতে অর্থ পাঠানো আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। ফলে দেশটির জনগণের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে।
২০২২ সালের শেষদিকে উত্তর কোরিয়া ছেড়ে যাওয়া আরেকজন ব্যক্তি তার আত্মীয়দের দুর্দশার বর্ণনা দেন। সেসময় বিশ্বের অনেক অংশেই কঠিন কোভিড-১৯ বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল।
তিনি বলেন, “আমার আত্মীয়রা বলেছেন, এখন মানুষ কোভিড-১৯-এ মারা যাওয়ার চেয়ে বরং অনাহারে মৃত্যুর ভয়ে বেশি চিন্তিত। তারা সবাই সাধারণ কোনও রোগে মারা যাওয়ার ভয়ে আছেন।”
সীমান্তে দমনাভিযানের কারণে দক্ষিণ কোরিয়ায় থাকা উত্তর কোরিয়ার মানুষেরা নিজেদের আত্মীয়স্বজনদেরকে নগদ অর্থও পাঠাতে পারছেন না। এইচআরডব্লিউ বলছে, ২০২৩ সালের শুরুতে মহামারির আগের চেয়ে মাত্র ১০ ভাগের একভাগ দালাল টাকা পাঠাতে পেরেছে।
প্রতিবেদনে উত্তর কোরিয়ার ওপর জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার ক্ষতিকর প্রভাব নিয়েও বলা হয়েছে। ২০১৭ সালে পারমাণবিক পরীক্ষা চালানোর পর উত্তর কোরিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে জাতিসংঘ।
এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদনে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞাগুলোকে ব্যাপক-ভিত্তিক উল্লেখ করে বলা হয়, সেগুলো “জনগণের জীবনযাত্রার পর্যাপ্ত মান এবং খাদ্য ও স্বাস্থ্যের অধিকারকে ক্ষুণ্ন করে। এতে দেশটির জনসংখ্যার বিশাল অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সীমান্তে কড়াকড়ি “বিশেষকরে নারীদের ওপর বেশি বিরুপ প্রভাব ফেলেছে। অথচ বেশিরভাগ পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী নারী। তারা যে বাজারে ব্যবসা করত সেগুলোর কার্যকলাপ সীমাবদ্ধ করা হয়।”
উত্তর কোরিয়ায় আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা একজন একজন সাবেক ব্যবসায়ী বলেন, তার এক আত্মীয় স্কুইড ও কাঁকড়া ধরে চীনের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিকভাবে বাণিজ্য করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারির উছিলায় সীমান্ত বাণিজ্যে নিষেধাজ্ঞার কারণে এই বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে। এতে তার আত্মীয়দের দেশের বাজারের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। যার ফলে তাদের আয়ও অনেক কমে গেছে। তাদের এখন টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
তথ্যসূত্র: বিবিসি