সকাল সন্ধ্যা: সম্প্রতি রেলপথে একটি দুর্ঘটনার শিকার হয়ে আপনি অনেক দিন হাসপাতালে ছিলেন। সঙ্গত কারণেই আমরা অনেকদিন আপনাকে কোনও জনসমাগমে দেখিনি। এরপর ২ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘দ্রোহযাত্রা’-তে আপনি সভাপতিত্ব করলেন। কোন প্রেক্ষাপটে আপনি দ্রোহযাত্রা থেকে সরকার পতনের ‘এক দফা’র ঘোষণা দিলেন?
আনু মুহাম্মদ: জুলাইয়ের ১৪ তারিখ পর্যন্ত আন্দোলনের একটি ধরন ছিল। এরপর থেকে আরেক রকমের। জুন মাসে যখন আন্দোলন শুরু হয় তখন আমি হাসপাতালে ছিলাম। সেখান থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম আন্দোলনটি বড় সমর্থন পাচ্ছে। ছাত্র-ছাত্রীদের যুক্তিগুলো বেশ ভালো। জুলাই মাসে আমি বাসায় ফিরলাম। আমার অবশ্য বাসা থেকে বের হওয়াই নিষিদ্ধ ছিল। এজন্য আমি তখন লেখা শুরু করি আন্দোলনের পক্ষ নিয়ে। মনে আছে ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর যে বাক্যবাণ ছিল তা অন্যসময়ের থেকে অনেক বেশি ছিল। অবশ্য তিনি সবসময় এরকমই বলতেন। এই বক্তব্যের পর আমিও খুব ক্ষিপ্ত হয়েছিলাম। কিছু না লিখে তখন থাকা যাচ্ছিল না। আমি একটা সিরিজ লিখতাম ফেইসবুকে। সেই সিরিজের নাম ছিল ‘প্রধানমন্ত্রীর ভুল কথার জবাবে’। সেই রাতের লেখাটা ছিল ১২ নম্বর। আমি সেখানে লিখেছিলাম, ‘‘নাগরিকরা কোনও দাবি জানালেই কেন আপনার এত রাগ হয়? দেশকে নিজের সম্পত্তি মনে করেন? এটা দিলাম সেটা দিলাম এ ধরনের কথা কেন বলেন?’’
১৪ জুলাই রাত থেকেই আসলে আন্দোলনে নতুন পর্ব যুক্ত হলো। অবিশ্বাস্য রূপ নিল ১৬ তারিখের পরে। আবু সাঈদের মৃত্যুর পর ১৭,১৮,১৯ তো এটা ভয়ংকর আকার ধারণ করল। সরকার আগেও নিষ্ঠুরতা নির্মমতা দেখিয়েছে। কিন্তু এবারের মাত্রা সবকিছুকে পিছে ফেলেছিল। এমন হয়, অ্যাকসিডেন্টালি একটি ঘটনা ঘটে, তারপর পিছিয়ে আসে। তা না, একের পর এক দিনের পর দিন চলতেই থাকল। শিশু হত্যার সংখ্যাই তো একশ’র কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। এ পরিস্থিতিতে আমি ১৮ তারিখ একটা লেখা লিখি। শেখ হাসিনার পদত্যাগের কথা এর আগে থেকেই হচ্ছিল। এই সরকারের গ্রহণযোগ্যতা তো আগে থেকেই নেই। ওই সময় এমন পরিস্থিতি এই সরকার তৈরি করে যে তাতে এই সরকারের ক্ষমতায় থাকার আর কোনও যৌক্তিকতা নেই। এটা আমার ব্যক্তিগত অবস্থান ছিল। তখন আমার অবস্থান ছিল, এখন আমাদের আলোচনা হওয়া উচিত দেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তর কিভাবে হবে। ফলে, ২ তারিখের অনেক আগেই আমি ব্যক্তিগতভাবে এই অবস্থায় চলে গিয়েছিলাম। এরপরের সকল লেখাই আমি এ বিষয়টিকে মুখ্য রেখেই লিখেছি।
দোসরা আগস্ট সেই ধারাবাহিকতায় আসল ‘দ্রোহযাত্রা’। এর মধ্যে মনে হচ্ছিল কারফিউ দিয়ে সরকার সব সামলে নিবে। বা কোনও একটা আপোস করে ফেলবে। কিন্তু সেটা সরকার করতে পারেনি। কারণ কারফিউ বা সামরিক শাসন একেবারে শেষ। ওইটা যখন ব্যর্থ হয় তখন সরকারের আর কিছু করার থাকে না।
সরকারের আরেকটি আপোস চেষ্টা নষ্ট হয়ে গেল যখন তারা ছাত্র-ছাত্রীদের গ্রেপ্তার করে আন্দোলন দমন করতে চাইল। কিন্তু এই আন্দোলনের মজাই এটা ছিল যে, এটার কোনও প্রধান নেতা বলে কিছু ছিল না। আপনি একজনকে গ্রেপ্তার করলে আরেকজন দাঁড়িয়ে গেছে। এখানে একজন দু’জন-পাঁচজন ধরে কোনও লাভ নাই। ফলে সরকারের এই চেষ্টা বৃথা যায়। বোঝা গেল, সরকার সামাল দিতে পারবে না।
ওই ঘটনা চলাকালীন দোসরা আগস্ট দেখা গেল সমাজের সকল অংশের মানুষ এই একটি দাবিতে একত্রিত হচ্ছে। সেই জায়গা থেকেই আমি সেইদিন সরকারের পদত্যাগের দাবি জানাই।
সকাল সন্ধ্যা: এর আগে আমরা দেখেছি ২০০৭-০৮ সালে যখন ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা এলো তখন সেনানিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে শিক্ষার্থীরাই অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখলেন এবং এরপরই আওয়ামী লীগ-বিএনপির দুই নেত্রী মুক্তি পেলেন। গত দেড় দশকে কী এমন পরিবর্তন ঘটল যে, শিক্ষার্থীরা যেন এই দুইটি প্রধান রাজনৈতিক দলকেই প্রত্যাখ্যান করতে চাইছিল?
আনু মুহাম্মদ: আওয়ামী লীগ বা বিএনপি তারা ঘটনাক্রমে একেকবার গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে আর সেটা হারিয়েছে। মানুষ তো আসলে একটা কমর্ফোট জোনের মধ্যে থাকতে চায়। মানুষ বিদ্রোহ, সহিংসতা কিংবা গণ্ডগোলের মধ্যে থাকতে চায় না। এটা মানুষের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য। মানুষ আসলে শান্তি চায়।
এর আগে এরশাদ সরকারের পতন ঘটেছে কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই। তখন তিনজোট ছিল। তাদের রূপরেখা ছিল। এরপর বিএনপি আসল, তারপর আওয়ামী লীগ আসল। ওরা কিন্তু সবাই বিশ্বাসঘাতকতা করল। তিনজোটের রূপরেখা কিন্তু কেউ বাস্তবায়ন করে নাই। ফলে, এদের প্রতি তো মানুষের অনাস্থা তৈরিই হয়েছিল। এরপর ২০০১-০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামাত জোটের চূড়ান্ত খারাপ পারফরমেন্স। হাওয়া ভবন, র্যাব গঠন, চরমপন্থীদের তৎপরতা, দুর্নীতি সব মিলিয়ে তাদের সবচেয়ে খারাপ পারফরমেন্স এই সময়ে। এর ফলাফলে ক্ষমতা আর্মি নিল। ‘মাইনাস টু’র একটা আলাপ উঠল। এটি গ্রহণযোগ্যতা পেল না সেনাবাহিনীর কারণে। এরপর নির্বাচন হলো, আওয়ামী লীগকে মানুষ কিন্তু ভালো সুযোগ দিল। বেশ বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগ জিতল। একটা মেয়াদ পর্যন্ত তো আওয়ামী লীগ নির্বাচিতই ছিল। ২০১৪ থেকে তো আর আওয়ামী লীগকে নির্বাচিত বলা যায় না। ২০১৪ এর পর থেকে তো তাদের স্বৈরতন্ত্রী আচরণ আরও বেড়ে গেল। তারা ভাবল যে তাদের ক্ষমতায় থাকতেই হবে। সেজন্য আরও নিপীড়ণ বাড়িয়ে একটি নিপীড়ণমূলক কাঠামো তৈরি করল তারা। এসময় আন্তর্জাতিক সমর্থনের জন্য আমরা দেখলাম, ভারত যা চাচ্ছে তার থেকে বেশি দেওয়া শুরু হয়ে গেল। দেশের ভিতরে আর্মি, আমলাতন্ত্র, পুলিশকে বেশি বেশি সুবিধা দেওয়া শুরু করল।
এর প্রতিবাদে কিন্তু ছোট ছোট আন্দোলন হচ্ছিল। তাও কিন্তু মানুষ বিএনপি-জামাতের পেছনে যায়নি। বিএনপির সবচেয়ে বড় পারফরমেন্স ছিল গত বছরের ২৮ অক্টোবর। কয়েক লাখ মানুষ নিয়েও যে টিকতে পারল না এটা তার নৈতিক দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ। এই যে কয়েক লাখ মানুষ পালিয়ে গেল, বা বিএনপির আন্দোলনে সাধারণ মানুষের না আসা, এর বড় কারণ কিন্তু মানুষের আস্থা তৈরি করার জন্য বিএনপির কিছু করতে না পারা। মানুষের অনাস্থা তৈরি করার জন্য তারা যা করছে তা কাটানোর জন্য সে কিছু করতে পারে নাই।
সরকারেরও এই রিডিং ছিল— বিএনপির যে রেকর্ড তাতে সেও মানুষকে একত্রিত করতে পারবে না। তারা ধারাবাহিকভাবে বিএনপি-জামাতের কথা বলে গেছে। সরকারের হিসাব এটাই ছিল যে, এদের চাপায় রাখলেই তো হবে, তাহলে আর কিছু হবে না। কিন্তু জনগণের ক্ষোভ যে অন্যভাবে প্রকাশিত হতে পারে সেই হিসাব তাদের ছিল না। সরকার বিএনপি-জামাতকে ঠেকাতে পারছে ঠিকমতই। আন্দোলনের সোর্স যদি শুধু বিএনপি-জামাত হতো তাহলে সরকারের পতন হতো না।
এ আন্দোলনে কিন্তু সাধারণ মানুষজন কথা বলেছে। কিংবা গ্রাফিতিতে যা বলার চেষ্টা হচ্ছে তা হলো— আমরা আগের কোনও শাসনব্যবস্থা চাই না। আমরা আর অতীতে যাইতে চাই না। এই আকাঙ্ক্ষাটাই মানুষের মধ্যে এখন সরব। কিন্তু এর কোনও কাঠামোগত চিন্তা এখনও মানুষের মধ্যে নেই। বিএনপি কিংবা জামাত কিন্তু মানুষের অনুমোদন পায় নাই। কিন্তু কিরকম বাংলাদেশ চাই তার কোনও চিন্তা এখনও তৈরি হয় নাই। এটাকে একটা তরল অবস্থার সাথে তুলনা করা যায়।
সকাল সন্ধ্যা: অনেকে বলেছেন, ‘এক দফা’র ডাক সময়ের আগেই এসেছে। হঠকারি হয়েছে। আপনি কী মনে করেন?
আনু মুহাম্মদ: আমি তা মনে করি না। যদি শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট টিকে যেতেন তাহলে আরও অনেক মানুষ মারা যেত। আমরা ৪ তারিখ রিপোর্টাস ইউনিটে অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা দিলাম। তারপর সেখান থেকে আমরা বের হতে পারছিলাম না। আশে-পাশে সব জায়গায় গোলাগুলি হচ্ছে। সেইসময় টেলিভিশনে দেখলাম একটা ঘোষণা আসল— ‘‘এরা কেউ শিক্ষার্থী না এরা সন্ত্রাসী। এদের দমনে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে।’’ হাসিনার কথা হলো যত খুন হয়েছে এটা যথেষ্ট না, আরও খুন করতে হবে। তখন এই সরকারের আরও টিকে থাকা মানে ছিল আরও রক্তপাত, আরও মানুষের মৃত্যু। ফলে, এক দফার ঘোষণাকে কোনওভাবেই হঠকারি বলা যায় না। প্রস্তুতি না থাকলেও হঠকারি বলা যায় না।
সকাল সন্ধ্যা: এ আন্দোলন থেকেশিক্ষার্থীরা যেসব সংস্কারের ডাক দিয়েছে, তা কতটা বাস্তবায়ন হবে বলে মনে করেন? মধ্যবিত্তের এসব সংস্কারের সুফল গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাবে কি?
আনু মুহাম্মদ: এটা কোনওভাবেই শুধুমাত্র মধ্যবিত্তের আন্দোলন না। আমরা যদি শিক্ষার্থীদের ব্যাকগ্রাউন্ড দেখি। যেমন আবু সাইদ, ওর বাবা-মা একদম গরিব। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বড় অংশের শিক্ষার্থীরা শ্রমজীবী পরিবার থেকে আসছে। তাদের একতা, বেপরোয়া চেষ্টা যে আমাদের সন্তানকে আমাদের থেকে বের করতে হবে। মানে আমাদের শ্রেণি বা অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে বের করতে হবে। এটার জন্য যা করা যায় তাই করবে তারা। ফলে, এই শিক্ষার্থীদের জন্য চাকরির প্রশ্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি নিরাপদ কর্ম তাদের জন্য জীবন-মরণের বিষয়। কারণ একটা ভালো চাকরি না হলে তাদের জীবনটাই ব্যর্থ হয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা যে সমাজ থেকে একটি সমর্থন পেয়েছে তার পেছনে কিন্তু এই শ্রেণি-সম্পর্কটা গুরুত্বপূর্ণ।
উচ্চবিত্ত তো এখানে নাই। তারা এখানে পড়াশোনাও করে না। এখানে তাদের চাকরিরও দরকার নাই। উচ্চ মধ্যবিত্তও কিন্তু নাই। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা মনে করি উচ্চবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত পড়ে। কারণ সেখানে প্রচুর টাকা লাগে। কিন্তু সত্যিকার চিত্র কিন্তু সেখানেও মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানদেরই সংখ্যা বেশি। কারণ তারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেনি। কিন্তু সন্তানকে পড়াতে তো হবে। ফলে তারা জমি বেঁচে কিংবা ঋণ করে পড়াচ্ছে।
এ কারণেই দেখা গেল যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় মার খাচ্ছে তখন সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিশাল প্রতিরোধ গড়ে তুলল। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচাররাও বের হচ্ছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচাররাও বের হচ্ছে। এগুলো কিন্তু আমাদের হিসাবের মধ্যেও ছিল না।
স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরাও কিন্তু বের হয়ে আসল। এটা কিন্তু গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। টেলিভিশনের কারণে কিংবা মোবাইল ইন্টারনেটের কারণে মানুষ কিন্তু খুব দ্রুত বের হয়ে কানেক্টেড হয়ে গিয়েছিল। ইন্টারনেট না থাকলে হয়ত এটা এত তাড়াতাড়ি হতো না। অনেকে বলেছেন, এত তাড়াতাড়ি কিভাবে হলো। দুই মাসের মধ্যে এত কিছু কিভাবে হলো। এটার সাথে কিন্তু টেকনোলজিকাল একটা ডাইমেনশনও আছে। ফলে আমি মনে করি এই আন্দোলনে ব্যাপক সংখ্যক মানুষের সম্পৃক্ততা হয়েছে।
এই আন্দোলনে একটি শ্রেণিগত ঐক্য ছিল। শ্রমিক মৃত্যুর সংখ্যা একশ পার হয়েছে। গার্মেন্টস শ্রমিক থেকে শুরু করে ইনফরমাল সেক্টরের শ্রমিকও এখানে যুক্ত হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে শ্রেণি, তার ভাষা কিভাবে আসবে। তার কর্মসূচি, লক্ষ্য কিংবা প্রত্যাশা কিভাবে আসবে। এটার এখন পর্যন্ত কোনও বক্তব্য কিন্তু পাওয়া যায়নি।
এখন পর্যন্ত যেই রাষ্ট্র সংস্কারের কথা আসছে তা অনেকটা লিবারেল জায়গা থেকে। বিচার বিভাগ স্বাধীন করা, বিশ্ববিদ্যালয় সন্ত্রাসমুক্ত করা, আইনের শাসন কিংবা দুর্নীতি কমানো এগুলো স্বাভাবিকভবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশাটা এত নিচে নেমে গেছে যে সাধারণ কিছু পরিবর্তন করলেই মনে হবে অনেক কিছু হয়ে গেছে। কিন্তু রাষ্ট্র সংস্কার তো অনেক বড় বিষয়। এর মানে যা হবে তা টেকসই হবে। আমি মনে করি, এখন যে পরিস্থিতি তাতে এসব নিয়ে আলোচনা কিংবা সরব হওয়া বেশি দরকার। যেটা অনির্দিষ্ট আছে সেটাকে নির্দিষ্ট করা। যেটা তরল আছে সেটাকে কংক্রিট করা।
সকাল সন্ধ্যা: অন্তর্বর্তী সরকারেরউপদেষ্টা পরিষদ দেখে আপনার কী মনে হচ্ছে? ঠিক কোন জায়গায় দুর্বল মনে হচ্ছে?
আনু মুহাম্মদ: ক্ষমতা থেকে যখন শেখ হাসিনা পলায়ন করলেন তখন তো ক্ষমতা সেনাবাহিনীর কাছে। সেনাপ্রধান একটি বক্তব্য দিলেন, সেই বক্তব্য থেকে বোঝা গেল তার সাথে কিছু রাজনৈতিক দল আছে। কিন্তু যারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা নাই। এটা হচ্ছে প্রথম দুর্বলতা যা প্রকাশ পেল এবং একটা গ্যাপ তৈরি হলো।
এরপর যে আলোচনা আসে তা হলো প্রধান উপদেষ্টার বিষয়টি। এটা আমি যতটুকু জানি শিক্ষার্থীরা ঘোষণা দিয়েছে। তারা কেন কী পরিস্থিতিতে এই ঘোষণা দিয়েছে তা আমি জানি না। মুহাম্মদ ইউনূস নোবেল পুরস্কার বিজয়ী। এমনিতেই সারা পৃথিবীতে পরিচিত। তার বিরুদ্ধে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে যেসব অভিযোগ এবং শেখ হাসিনা তার সাথে যেভাবে ডিল করেছেন, তার মধ্যে তফাৎ আছে। ক্ষুদ্র ঋণ, সামাজিক ব্যবসার যে মডেল তা নিয়ে আমারও সমালোচনা আছে। আমি লিখেছিও বিভিন্ন জায়গায়। আমি এখনও মনে করি আমার আলাপ ঠিক। কিন্তু শেখ হাসিনা যেভাবে এগুলো ডিল করেছেন সেটার সাথে এগুলোর কোনও সম্পর্ক নেই। সেটা একটা ব্যক্তিগত আক্রোশ। সেই আক্রোশে তিনি যে হয়রানি করেছেন— তা কোনওভাবেই গ্রহণযোগ্য না। ওই হয়রানি ড. ইউনূসের প্রতি মানুষের সিম্প্যাথি তৈরি করেছে।
সেই সময় হয়ত এটা অনিবার্য হয়ে গেল যে এমন একজন ব্যাক্তি যিনি আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত এবং একইসাথে এই সরকারের মাধ্যমে নিপীড়িত। সেই জায়গা থেকে তাকেই প্রধানের ঘোষণা দেওয়া হলো। এভাবে এই চিন্তা কিন্তু হতে পারে।
এরপর যাদেরকে উপদেষ্টা করা হয়েছে তাদের ব্যাপারে নিশ্চয়ই ড. ইউনূসের একটা ভূমিকা আছে, সেনাবাহিনীরও একটা ভূমিকা থাকার কথা। যারা এসেছেন তারা নানান ক্ষেত্র থেকে এসেছেন, কিন্তু তাদের তো কোনও রাজনৈতিক দল নাই। একজনকে একটা মন্ত্রণালয়ে বসিয়ে দিলেই তো হবে না। তার একটা সমর্থক গোষ্ঠী লাগবে। একইসাথে নিজের একটি অবস্থান লাগবে।
এখানে আবার অনেকেই এনজিও’র সাথে যুক্ত। ফলে, তাদের একটি কাজ করার প্রক্রিয়া আছে। এখানে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা রয়েছে। তাদেরও চাওয়া-পাওয়ার একটা ব্যাপার আছে।
হয়ত এই সরকার অনিবার্য ছিল, কিন্তু তাদের যে সীমাবদ্ধতা তাও আমাদের মাথায় রাখতে হবে। যদি দেখা যায় আন্দোলনের স্পিরিট বা প্রত্যাশা থেকে তারা দূরে সরে যাচ্ছে তাহলে সেটা তো সমাজেরই দায়িত্ব তাদেরকে মনে করিয়ে দিয়ে ঠিক পথে নিয়ে আসা। এটা একটি স্ট্রাগলের ব্যাপার হবে।
সকাল সন্ধ্যা: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ কতদিন হওয়া উচিত বলে মনে করেন?
আনু মুহাম্মদ: এখন যে কাজগুলো করা জরুরি যেমন— জরুরি তদন্তগুলো করা দরকার একইসাথে দুর্নীতির শ্বেতপত্রগুলো প্রকাশ, নিহত-আহতদের তালিকা করা দরকার। এর সঙ্গে ব্যাংক ও আর্থিকখাতের সমস্যাগুলো হাতে নেওয়া দরকার।
অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার অনেক মৌলিক বিষয় না পাল্টাতে পারলেও অনেক দূর পর্যন্ত অগ্রসর হতে পারে। ভিত্তিটা তৈরি করতে পারে। সেটা করার জন্য কোন পর্যন্ত সময় লাগবে তা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। কেউ যদি জোরে হাঁটে তাহলে তার একরকম সময় লাগবে, আবার যদি সে বসে থাকে বা একটু পর পর বসে যায় তাহলে তার অনেক সময় লাগবে। তার ফলে এটা নির্দিষ্টভাবে বলা মুশকিল। সরকার যদি আন্তরিক হয়, সবার সাথে কথা বলে কাজ করে, তাহলে আমার তো মনে হয় ৬ মাসের মধ্যে একটা ভিত্তি তৈরি করা কোনও বিষয় না। কিন্তু এটা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। কিছু সময় বেশিও লাগতে পারে আবার কিছু সময় কমও লাগতে পারে। তবে, ছয় মাসের মধ্যে একটা কাজ গোছানো অসম্ভব কিছু না।
সকাল সন্ধ্যা: অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রথম কোন সংস্কারকাজগুলো হাতে নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন?
আনু মুহাম্মদ: এ সরকারের আমলে তো কিছু জিনিস এমনিতেই উন্নতি হবে। যেমন আমি তো মনে করি এই সময়ে সম্পদ পাচারটা বন্ধ হবে। ব্যাপক যে চাঁদাবাজি হয় তা তো আশা করি বন্ধ হবে। চাঁদাবাজি যদি বন্ধ হয় তাহলে জিনিসপত্রের দাম কমার জন্য এটিই তো একটা বড় কারণ। সম্পদ পাচার যদি বন্ধ হয় তাহলে বৈদেশিক রিজার্ভটা বাড়বে। সুতরাং, বৈদেশিক রিজার্ভ নিয়ে যে সংকট তা কমার একটি সম্ভাবনা আছে। ব্যাংকগুলোতে যারা ঋণখেলাপি তাদের পাকড়াও করে যদি তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয় তাতেও সম্পদ বাড়বে। আমরা তো আশা করি ঋণ খেলাপিদের সাথে সরকারের কোনও নেগোসিয়েশন হবে না। অবশ্য এই পরিস্থিতিতে কেউ চাইলেও পারবে না। অর্থনীতির যে ভয়ানক অবস্থা হয়েছিল তাকে সামাল দেওয়া এই সরকারের পক্ষে সম্ভব। এখন যেটা দরকার ব্যাংকগুলো ঠিক করা। যেসব লুন্ঠন দুর্নীতি হয়েছে সেসবের শ্বেতপত্র প্রকাশ করা। দেশ বিদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ঋণ নিয়ে যেসব মেগাপ্রজেক্ট আছে সেসব জনগণের কাছে প্রকাশ করতে হবে। যেসব মেগাপ্রকল্প বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর সেসব বাতিলের আইনি প্রক্রিয়া বের করতে হবে। এই কাজগুলো করতে কিন্তু বেশি সময় লাগার কথা না।
সকাল সন্ধ্যা: ‘তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’রমতো ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক’-ও কি কেবল একটি প্রেশার গ্রুপ হিসেবে থাকবে? নাকি সক্রিয় রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে?
আনু মুহাম্মদ: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের কোনও পলিটিক্যাল পার্টি করার চিন্তা নাই। একটা পার্টি করতে গেলে যে অভিন্ন চিন্তা বা মতামত থাকতে হয় সেই অবস্থা আমাদের নেই। শিক্ষক নেটওয়ার্কের ভিতর এখন যে চিন্তাটা আছে তা হলো ‘ছায়া সরকার’ করার। ছায়া সরকার মানে একটি খুবই সক্রিয় এবং শক্তিশালী কার্যকর ভূমিকা পালন করা। ছায়া সরকার মানেই একটি রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করা।
এখনও আমাদের রূপরেখা চূড়ান্ত হয়নি। ছায়া সরকার বলতে বোঝায় যেটা গদিনসীন সরকার না। সে আনুষ্ঠানিক ক্ষমতাশীল সরকার না। কিন্তু জনগণের পক্ষে তারা একটা পাল্টা সরকার রাখছে, যা সরকারকে মনিটরিংয়ের উপর রাখবে। সেখানে সরকারের পক্ষ থেকে যেকোনও কার্যক্রম হচ্ছে জনগণের পক্ষ থেকে তা দেখভাল করাই কাজ। সেখানে যদি ভুল হয়, যদি দুর্বলতা থাকে সেগুলোকে আইডেন্টিফাই করছে। এটি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ব্রিটেনে আছে। সেখানে সরকারই গঠন করে ছায়া সরকার।
বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে তো ঠিকমত সরকারই পাই নাই। সেখানে ছায়া সরকার হবে কিভাবে। যারা আসছে তারা সবাই লুটপাট, স্বৈরতন্ত্র, দাপট এগুলো নিয়েই ছিল। এখন পর্যন্ত নাগরিকদের প্রতিনিধিত্ব করে এরকম একটি সরকারও আমরা পাই নি। ছায়া সরকার কিভাবে পাব।
ফলে আমরা দায়িত্ব নিয়ে একটা ছায়া সরকারের কথা ভাবছি। আমরা মনে করি এর একটি প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে পড়বে।
সকাল সন্ধ্যা: বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের পটভূমিতে উগ্রপন্থার উত্থান ঘটবে কি না? এমন সংকট থেকে উত্তরণের রাস্তা কী?
আনু মুহাম্মদ: উগ্রপন্থা তো এখন সারা পৃথিবীতেই চলছে। রাইট উইং, ডানপন্থী, ধর্মপন্থী বা বর্ণবাদী যেই নামেই আমরা ডাকি না কেন— তাদের একপ্রকার উত্থান আমরা দেখতে পারছি। ইউরোপ, আমেরিকা কিংবা ভারতে তো ক্ষমতাতেই আছে উগ্র ডানপন্থী ধর্মভিত্তিক একটি গোষ্ঠী। সুতরাং সেটার সম্ভাবনা তো বাংলাদেশেও আছে। বাংলাদেশে এই লড়াই তো পাকিস্তান আমল থেকেই চলছে। এটার আরও বড় অসুবিধা হলো, পাশের দেশ ভারতে একটি ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় বসে আছে। ভারতে যখন সংখ্যালঘুর উপর হামলা হয় বা মোদি সরকার যখন দায়িত্বহীন বক্তব্য দেয়— তখন তারা বাংলাদেশের মানুষের ক্ষোভটা বাড়িয়ে দেয়। সেই ক্ষোভটাকে পুঁজি করে কিছু সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী সেটার সুবিধা নেয়। কিন্তু এটা তো ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ ‘মুসলিম রাষ্ট্রের’ উপর নিপীড়ণ করছে, এমন নয়। সেটা হলে ভারত দ্বারা নেপাল আক্রান্ত হতো না। কারণ, নেপাল তো ‘হিন্দু রাষ্ট্র’। এটা একটা বৃহৎ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের যে আধিপত্য তৈরি করার নকশা সে কারণে করে।
সাম্প্রদায়িক মতাদর্শ তো আছেই তার সাথে যা যুক্ত হয়েছে তা হলো আওয়ামী লীগের ভূমিকা। ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর যে উত্থান বা নড়া-চড়া দেখা যাচ্ছে তার প্রধান কারণ হচ্ছে কিন্তু আওয়ামী লীগের শাসন। আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের সময় ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোকে দমন করার জন্য কিছু যুক্তি তৈরি করে তারা গুম, ক্রসফায়ারকে যৌক্তিক করতে চেয়েছে। কিন্তু এটা মোটেও ঠিক না। সে আসলে তার বিপক্ষ মতকে দমন করেছে। আবার অন্যদিকে ধর্মীয় বিভিন্ন গোষ্ঠীকে লালনপালন করেছে আওয়ামী লীগ। পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। তাদের দাবি অনুযায়ী, পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন করেছে। একদিকে তাদের প্রতি সিম্প্যাথি তৈরি করেছে সমাজে অন্যদিকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে তাদের কলেবর বাড়াতে অবদান রেখেছে। এর ওপর যখন আওয়ামী লীগ অপরাধ করার সাথে সাথে নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে দাবি করে তখন তারা মুক্তিযুদ্ধকেও কলঙ্কিত করে। এতে এসব ধর্মীয় গোষ্ঠী বা যারা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তারা লাভবান হয়। কোনও আন্দোলন হলেই এটা ‘জামাত-বিএনপি’ করছে বলার মাধ্যমে তো এসব গোষ্ঠীকেই গৌরবান্বিত করা হয়।
বিএনপি বিভিন্ন সময় জামাত থেকে বের হতে চেয়েছে, কিন্তু আওয়ামী লীগ সবসময় চেয়েছে বিএনপির সাথে জামাতের একটা ট্যাগ থাকুক। যাতে বিএনপিকে ধরা সহজ হয়।
সকাল সন্ধ্যা: ৫ অগাস্ট এবং এর আগে-পরে যেসব ভাস্কর্য ভাঙ্গা হলো, শিল্পকর্ম ও ইতিহাস-ঐতিহ্যর উপর আঘাত করা হলো, জাদুঘরসহ অনেক স্থাপনা ভাঙচুর হলো, পোড়ানো হলো এটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করেন?
আনু মুহাম্মদ: এই ভাঙ্গাটা আমি সমর্থন করি না। একটি সৃজনশীল প্রয়াস এই গণ-অভ্যুত্থান ধরে গড়ে উঠেছিল। গ্রাফিতি, গান-নাটক কত কিছু হয়েছে। অন্য যেকোনও আন্দোলনের থেকে এবারের আন্দোলনে সৃজনশীলতার অবস্থান অনেক বেশি ছিল। এই গণ-অভ্যুত্থানের মানুষ গিয়ে ভাস্কর্য ভাঙবে, ম্যুরাল ভাঙবে, জাদুঘর ভাঙবে কিংবা অন্যমতের মানুষকে আঘাত করবে— এটা তো মিলে না। কিছু লোক তো আছেই সুযোগ-সন্ধানী। আবার কিছু লোক মতাদর্শিকভাবে এটা করেছে। এখানে ভারতের কিছু খেলাও আছে। তাদের একপ্রকার উস্কানি আছে। আবার ভারতেরই যারা গণতান্ত্রিক শক্তি তারা কিন্তু প্রকৃত সত্যটা জানতে চাচ্ছে। কারণ তাদের সমর্থন এই আন্দোলনে ছিল। তাদের সাথে আমাদের যোগাযোগ বাড়ানো দরকার। এটা আমাদের দুই দেশের জন্যই প্রয়োজন। দুই দেশেই যে সাম্প্রদায়িক শক্তি রয়েছে তাদের মোকাবেলায় দুই দেশের গণতান্ত্রিক শক্তি, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যে সংহতি বাড়াতে হবে। দুই রাষ্ট্রের সরকারের মধ্যে যে সংহতি সেই সংহতি কিন্তু দেই দেশের জনগণের মধ্যে তৈরি হয় নাই।
সকাল সন্ধ্যা: কিন্তু ভারতের সঙ্গে আমাদের এখনকার যে সম্পর্ক, মানে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে যে ভারত বিদ্বেষ রয়েছে— বিশেষ করে এই যে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে ভারতকে দায়ী করা হচ্ছে— এটা দূর করা যায় কিভাবে?
আনু মুহাম্মদ: ভারতের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো এমনকি বামপন্থীদলগুলোও এ বিষয়ে কখনো মনোযোগ দেয় নাই। ভারতের সরকার বা কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর যে ভূমিকা তা নিয়ে যদি সমালোচনা থাকে ভারতের মিডিয়ায় তাহলে বাংলাদেশের মানুষ বুঝত যে ভারতে তাদের বন্ধু আছে। সুন্দরবন আন্দোলনের সময় আমরা খুব চেষ্টা করেছিলাম। আমরা ভারতে গিয়ে একটি কনভেনশনও করতে চাই। কিন্তু রাষ্ট্র তো এটা পছন্দ করে নাই। আমাদের ভিসা না দিয়ে সেই কর্মসূচি ঠেকানো হলো। কিন্তু ওইটাই পথ হিসেবে আমি মনে করি।
জনগণের সাথে জনগণের সংহতি বাড়ানো ছাড়া আমি কোনও বিকল্প দেখি না। আবার বাংলাদেশের তো মিডিয়া নাই ওখানে। তারা এখানকার খবর পায় আংশিক। ফলে তারা মনে করে এখানের সবচেয়ে বড় সমস্যা সাম্প্রদায়িকতা। আসলে তো সেটা পুরোপুরি ঠিক না। এটার বিরুদ্ধে যে বাংলাদেশে যে লড়াই আছে, এমনকি যারা ধার্মিক— ধার্মিক মানেই তো আর সাম্প্রদায়িক নন— তাদের অনেকেও তো সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়েন বাংলাদেশে। ওই পক্ষ থেকেও এই আংশিক সংবাদের প্রেক্ষিতে একটি বিদ্বেষ তৈরি হয়, আবার সেটার আংশিক একটা রূপ আমরা বাংলাদেশেও দেখি। বাংলাদেশের সবাই মনে করে ভারত হচ্ছে শত্রু। আসলে ভারত তো শত্রু না, ভারতের শাসক শ্রেণি বা ভারতের সাম্প্রদায়িক শ্রেণিই আসল শত্রু। কাজেই ভারতের গণতান্ত্রিক শক্তির সঙ্গে যোগসূত্রটা বাড়ানো দরকার।
সকাল সন্ধ্যা: দেশের একটি বড় অংশের মানুষ যারা সেক্যুলার চিন্তা-চেতনায় আস্থাবান, তাদের অনেকেই আওয়ামী লীগের ভোটার। এই পরিস্থিতিতে তাদের কী হবে?
আনু মুহাম্মদ: আওয়ামী লীগ তো তাদের সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছে। আওয়ামী লীগ তো কোনও সেক্যুলার পলিসি ফলো করে নাই। কিন্তু একটা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য আওয়ামী লীগ যেই ক্ষতি করে গেছে তা আর কেউ করতে পারে নি। ফলে, যারা আওয়ামী লীগের সমর্থক তাদের মধ্যে যে অংশটি সুবিধাভোগী— তারা কী করবে তারা সেটা জানেন; এর বাইরে যারা আছেন, তারা হয়ত আবার নতুন দল খুঁজবে। এখানে তো সেক্যুলার গণতান্ত্রিক আইডিয়া নিয়ে অনেক দল আছে। সেসব জায়গা তাদের খুঁজে নিতে হবে।
সকাল সন্ধ্যা: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
আনু মুহাম্মদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।