পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়ে ফের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। পশ্চিমাদের উদ্দেশে বুধবার তিনি বলেছেন, পারমাণবিক যুদ্ধের জন্য মস্কো প্রযুক্তিগতভাবে প্রস্তুত। যুক্তরাষ্ট্র যদি ইউক্রেনে সেনা পাঠায়, তাহলে তা যুদ্ধের তীব্রতা বাড়াবে বৈ কমাবে না।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে পুতিন থেমে থেমে পারমাণবিক যুদ্ধের হুঁশিয়ারি দিয়ে যাচ্ছেন।
রাশিয়ার কাছে আসলে ঠিক কী পরিমাণ পারমাণবিক অস্ত্র আছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তিকে হুমকি দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত? কখন তিনি এ অস্ত্র ব্যবহার করবেন? রাশিয়ায় পারমাণবিক অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণই বা কার হাতে? তার উত্তর খুঁজেছে রয়টার্স।
মজুতের পরিমাণ
বিশ্বের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার রাশিয়ার হাতেই। সোভিয়েত ইউনিয়ন আমলের পারমাণবিক অস্ত্র দেশটি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্টসের (এফএএস) তথ্য বলছে, প্রায় ৫ হাজার ৫৮০টি পারমাণবিক অস্ত্র রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের নিয়ন্ত্রণে।
এর মধ্যে প্রায় ১ হাজার ২০০টির মেয়াদ শেষ হলেও সেগুলো অক্ষত অবস্থায় আছে। দূরপাল্লার ও স্বল্পপাল্লার পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করতে পারে, এমন প্রায় ৪ হাজার ৩৮০টি।
এফএএস বলছে, মজুতের মধ্যে ১ হাজার ৭১০টি কৌশলগত যুদ্ধাস্ত্র স্থাপন করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে আছে ৮৭০টি স্থলভিত্তিক ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ৬৪০টি সাবমেরিন থেকে ছুড়তে সক্ষম ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। ২০০টির ভারী বিস্ফোরক বহনে সক্ষম।
পারমাণবিক অস্ত্রের এই বিশাল মজুত জানান দেয়, রাশিয়া কেবল একবার নয়, একাধিকবার পৃথিবী ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে।
স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে প্রায় ৪০ হাজার পারমাণবিক অস্ত্র ছিল। অন্যদিকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ছিল ৩০ হাজার অস্ত্রের মজুত।
যে পরিস্থিতিতে অস্ত্রের ব্যবহার
রাশিয়ার কোনও প্রেসিডেন্ট ঠিক কোন পরিস্থিতিতে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবেন, তা দেশটির ২০২০ সালের পারমাণবিক নীতিমালায় স্পষ্ট করা আছে।
সেখানে বলা হয়েছে, রাশিয়ার ওপর পারমাণবিক বা অন্যান্য গণবিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহার করে হামলা চালানো হলে প্রতিক্রিয়া হিসেবে মস্কো পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে।
এছাড়া রাশিয়ার ওপর প্রচলিত অস্ত্র নিয়ে কোনও দেশ হামলা করলেও দেশটি পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের এখতিয়ার রাখে। কারণ সেক্ষেত্রে এ ধরনের হামলাকে রাশিয়া তার অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে দেখবে।
অস্ত্রের মজুত বাড়ার সম্ভাবনা
২০২২ সালের নিউক্লিয়ার পশচার রিভিউতে (পারমাণবিক নীতি নির্ধারণ করে এমন বিধিনির্দেশিত পর্যালোচনা) যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল, রাশিয়া ও চীন তাদের পারমাণবিক শক্তি বৃদ্ধি ও আধুনিকায়ন করছে। আর অস্ত্রের ব্যয়বহুল প্রতিযোগিতা এড়াতে অস্ত্র উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করবে ওয়াশিংটন।
রুশ বাহিনী সংক্রান্ত এক বিশ্লেষণে এফএএস বলেছে, “রাশিয়ার পারমাণবিক সক্ষমতা ও এ বিষয়ে তাদের হুমকি-ধমকি গভীর উদ্বেগের। অবশ্য আধুনিকায়নের কাজ চলতে থাকা ছাড়া দেশটির পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার ও কার্যক্রম আমাদের ২০২৩ সালের অনুমানের তুলনায় তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি।”
গবেষণা সংস্থাটি আরও বলে, “ভবিষ্যতে রাশিয়ার কৌশলগত বাহিনীর জন্য বরাদ্দ দেওয়া যুদ্ধাস্ত্রের সংখ্যা বাড়তে পারার সম্ভাবনা আছে। কারণ দেশটি একক যুদ্ধাস্ত্রবিশিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রকে একাধিক যুদ্ধাস্ত্রসজ্জিত ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে প্রতিস্থাপন করছে।”
পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা হবে?
রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন সম্প্রতি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা করার কথা বিবেচনা করে, তাহলে মস্কো চুপ থাকবে না। তারাও পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা চালাবে।
পুতিন গত বছর একটি আইনে স্বাক্ষর করেন যেখানে দেশটির পারমাণবিক পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ চুক্তির (সিটিবিটি) অনুমোদন প্রত্যাহার করা হয়।
গত শতকের নব্বই দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গার পর এখন পর্যন্ত পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা চালায়নি মস্কো। তারা শেষ পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা করে ১৯৯০ সালে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কয়েকটি দেশ পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা আর্মস কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯২ সালে যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৯৬ সালে চীন ও ফ্রান্স, ১৯৯৮ সালে ভারত ও পাকিস্তান এবং ২০১৭ সালে উত্তর কোরিয়া সফল পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা করে।
হবে পুতিনের ইশরায়
পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা হবে কি না, এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। তার সঙ্গে সবসময় একটি নিউক্লিয়ার ব্রিফকেস (পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিতে বিশেষভাবে তৈরি ব্রিফকেস) থাকে।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু, সেনাপ্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভের কাছেও এমন একটি ব্রিফকেস থাকে বলে ধারণা করা হয়।
রাশিয়ার পারমাণবিক ব্রিফকেসের সাংকেতিক নাম চেগেট। এটি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার সেনাবাহিনীর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম।
পুতিন যদি মনে করেন, তার পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সময় এসে গেছে, তাহলে তিনি ওই ব্রিফকেসের মাধ্যমে সেনাপ্রধানকে আক্রমণের নির্দেশ দেবেন।
ওই নির্দেশ দ্রুত বিভিন্ন যোগাযোগব্যবস্থার মাধ্যমে কৌশলগত বাহিনীর ইউনিটগুলোতে পৌঁছাবে এবং একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপকে লক্ষ্য করে আঘাত হানা হবে।