নদী মাতৃক বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা কত, তা এখনও চূড়ান্ত হলো না। খসড়া একটি তালিকা দিয়ে জানানো হলো, আগামী বৈশাখে চূড়ান্ত হবে তালিকা।
মঙ্গলবার ঢাকায় বাংলাদেশের নদ-নদীর সংখ্যা নির্ধারণ বিষয়ক এক অনুষ্ঠানে একটি খসড়া তালিকা প্রকাশ করা হয়। যেখানে বলা হয়, দেশে এখন ১ হাজার ১৫৬টি নদী আছে।
আগামী পহেলা বৈশাখ চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে অনুষ্ঠানে জানান পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, পরিবেশ আইনজীবী হিসাবে যিনি নিজেও নদী রক্ষার নানা উদ্যোগে যুক্ত ছিলেন।
তিনি বলেন, “নদ-নদীর চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং ভূমি মন্ত্রণালয়কেও যুক্ত করা হবে।”
এরপর যৌথভাবে এই তালিকা প্রকাশ করবে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ও নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়।
২০২৩ সালে নদী দিবসে দেশের নদীর একটি তালিকা প্রকাশ করেছিল জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। সেখানে জানানো হয়েছিল, দেশে নদীর সংখ্যা এক হাজার আটটি।
তবে ওই সংখ্যাটি নিয়ে তখনই আপত্তি তুলেছিলেন লেখক এবং গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেছিলেন, “নদী কমিশন তো কেবল একটি বই লিখেছে। তাতে বাংলাদেশের কয়টা নদী আছে, সেই নদীর তালিকা করেছে। এটা অসম্পূর্ণ একটা তালিকা।”
তখনই প্রতিবাদ করেছিলেন জানিয়ে মাহবুব বলেন, “এক হাজার আটটা নদীর নাম দিয়েছে তারা। যে মিটিংয়ে তারা এই তালিকা প্রকাশ করেছিলেন, বইটা আমাদের দিয়েছিলেন, সেই মিটিংয়ে আমারও যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল।
“আমি সঙ্গে সঙ্গে উঠে এটার প্রতিবাদ করেছিলাম। আমি বলেছিলাম, আমার যে গবেষণা তাতে আমি ১ হাজার ৯০৯টি নদী পেয়েছি। আর আপনারা মাত্র এক হাজার আটটা নদী পেয়েছেন!”
‘আমাদের নদ-নদী’ গ্রন্থের লেখক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, “আমি বলেছি, নদীগুলোর নাম আছে, তালিকা চাইলে নেন তালিকা … সবার সামনে আমি বলেছিলাম। ওখানেই প্রমাণ হয়ে গেছে যে উনারা এক হাজার নদী বলেছেন, সেটা সঠিক নয়।”
২০১৯ সালে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত একটি রায়ে নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা বা ‘লিভিং এনটিটি’ বলে আদেশ জারি করে। ওই রায় অনুসারে, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান হলেন নদীর অভিভাবক।
২০১৪ সালে গঠিত নদী রক্ষা কমিশন ২০২৩ সালে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে নদীর তালিকা প্রকাশ করে। তার আগে ২০২৩ সালের ৯ অগাস্টে খসড়া তালিকা উন্মুক্ত করেছিল তারা; তাতে ছিল ৯০৭টি নদী।
নদী রক্ষা কমিশন নিয়ে মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, “তারা তো নদীর অভিভাবক। যদিও কাগজে-কলমে। নদী কমিশনের চেয়ারম্যানের একটা নৌযান পর্যন্ত নাই। তাহলে উনি কীভাবে নৌপথে দক্ষিণ বাংলা সফর করবেন? এমন হাস্যকর কিছু ব্যাপার আছে।”
এদিকে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) প্রকাশিত তালিকায় নদ-নদীর সংখ্যা অনেক কম দেখা যাচ্ছে। তাদের ওয়েবসাইটে বলা আছে, ২০০৫ সালে ‘বাংলাদেশের নদ-নদী’ নামে একটি বই প্রকাশ করেছে এই সরকারি সংস্থা। যেখানে মাঠ পর্যায়ের তথ্যের ভিত্তিতে মোট ৩১০টি নদী চিহ্নিত করা হয়।
২০১১ সালে পাউবো এবং সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) মিলে ৩০ মিটার রেজ্যুলেশনের ল্যান্ডস্যাট স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করে; এভাবে তখন মোটে ৪০৫টি নদী চিহ্নিত করা হয়।
ইতিহাস এবং দেশের নদ-নদী নিয়ে ২০টিরও বেশি বই লিখেছেন মাহবুব সিদ্দিকী। ৩০ বছর ধরে নদী নিয়ে কাজ করছেন। সরেজমিনে তথ্য নিয়েছেন অসংখ্য নদীর।
সেসব অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, “রংপুর বিভাগে কয়টা নদী আছে তা রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তুহিন ওয়াদুদসহ সই করে বিভাগীয় কমিশনারের কাছে জমা দিয়েছিলাম আমরা। আর আমি ব্যক্তিগতভাবে রাজশাহী বিভাগে জেলাওয়ারি কয়টা নদী এটার তালিকা করে বিভাগীয় কমিশনারের কাছে দিয়েছিলাম।”
“সুন্দরবনের নদী তালিকাও আমি দিয়েছি। সুন্দরবনে কয়টা নদী আছে এ পর্যন্ত কেউ ঠিক মতো রিপোর্ট দেয়নি। আমি বিভিন্ন বই-পুস্তক ঘেঁটে, যারা সরেজমিন কাজ করেছে তাদের রিপোর্ট দেখে ২২৭টা নদী পেয়েছি। আমি সবকটা নদীর নাম, কোথায় আছে সব দিয়েছি।”
নদী সংখ্যার সঠিক তালিকা করতে ইচ্ছাই যথেষ্ট বলে মনে করেন মাহবুব।
“৭৫ হয়ে গেছে আমার বয়স। আমি তারপরও হাঁটাহাঁটি করতে পারি বলে কাজগুলো করছি। আর দুয়েক বছর পরে হয়ত পারব না। আমি পরামর্শ দিতে পারি। ইচ্ছা থাকলেই আমরা আমাদের নদীর হিসাব করতে পারি।”
বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা নির্ণয়ে বিভিন্ন সময়ে নদী গবেষকদের নিয়ে বসেছিল নোঙর ট্রাস্ট। এর চেয়ারম্যান সুমন শামস সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সংখ্যা নিয়ে যখন কথা হলো, তখন তারা (নদী কমিশন) ১০০৮টি নদী দিয়ে বুঝ দিলেন। তাও ভাগ্যিস! এর আগে তো কোনও সংখ্যাই তারা বলতে পারছিলেন না।”
সঠিকভাবে পরিসংখ্যান নিলে নদীর সংখ্যা ২ হাজার পাওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
“গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী ১৯০৮টি নদী কথা বলেছেন তার গবেষণা থেকে। এটা হতেই পারে। আমি তো মনে করি, যদি আরও পেছনের দিকে যাই তাহলে হয়তো দুই হাজার নদী খুঁজে পাবো আমরা।”