Beta
রবিবার, ১৮ মে, ২০২৫
Beta
রবিবার, ১৮ মে, ২০২৫

নারীর যাতায়াত সহজ করছে স্কুটি, কিন্তু পথের হয়রানি কি কমেছে  

স্কুটি যাতায়াত সহজ করেছে বলে জানান অধরা ইয়াসমিন।
স্কুটি যাতায়াত সহজ করেছে বলে জানান অধরা ইয়াসমিন।
[publishpress_authors_box]

একটা সময় ছিল যখন নারীদের কোনও গাড়ির চালকের আসনে দেখলেই হতো সমালোচনা। চলত ফিসফাস-গুঞ্জন। সেই যুগ আর নেই। মানুষের চিন্তাভাবনায় বদল এসেছে।

রাজধানীজুড়ে আজকাল প্রায়ই নারীদের স্কুটি বা বাইক চালাতে দেখা ‍যায়। শখের বশে নয়, বরং প্রয়োজনের তাগিদেই এই যান বেছে নিচ্ছেন তারা।

এমনই একজন রাইসা জাহান। ঢাকার বেসরকারি এক ব্যাংকে কাজ করেন তিনি। নিজের স্কুটিতে চেপেই প্রতিদিন অফিসে যাওয়া-আসা করেন।

রাইসা মনে করেন, স্কুটি দিনকে দিন বাংলার নারীদের স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্রের বাহন হয়ে উঠছে। হয়তো কখনও কখনও আনমনে স্কুটি চালানোর সময় তিনি গেয়ে ওঠেন রবি ঠাকুরের সেই গান- ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’।

তবে তিনি এও মানেন, দিল্লি অনেক দূর। মানুষের চিন্তাভাবনা আর ‍দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন ঘটতে অনেক পথ পাড়ি দেওয়া বাকি। 

নারীরা দ্বিধাহীনভাবে স্কুটি চালাবেন, এই সহজ-স্বাভাবিক বিষয়টি মানুষের কাছে সহজ হয়েও যেন সহজ হচ্ছে না। কোথায় যেন বাধা।

আর দশজনের মতো একসময় গণপরিবহনেই অফিস যেতেন ব্যাংক কর্মকর্তা রাইসা। বছর কয়েক হলো তিনি স্কুটি ব্যবহার করছেন। এ বিষয়ে তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমি গত ছয় বছর ধরে একটি বেসরকারি ব্যাংকে আছি। প্রায় চার বছর হলো আমি স্কুটি চালিয়ে অফিসে যাই। এর আগে বাসে যাওয়া আসা করতাম।

“গণপরিবহনে যৌন হয়রানি নিত্যদিনের ব্যাপার। একবার এমনই এক ঘটনার পর বাসে যাতায়াত বন্ধ করে দিই। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম তখন। এক বন্ধুর পরামর্শে স্কুটি কিনি। চালানো শেখার পর তাতে চড়েই যাতায়াত শুরু করি। কিছুদিনের মধ্যে টের পাই, ভিন্ন এক ধরনের ইতিবাচক শক্তি যেন ভর করেছে আমার মধ্যে।”

তবে নিজস্ব বাহনে দুশ্চিন্তামুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারবেন ভাবলেও পুরোপুরি তা ঘটেনি। প্রায় প্রতিদিনই নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয় তাকে।

স্কুটি ঘিরে দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা সম্পর্কে এই ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, “রাস্তায় পুরুষ চালকরা যেন মানতেই পারেন না, একজন নারী স্কুটি চালাচ্ছেন। গাড়ি চালাচ্ছি, হঠাৎ কোনও পুরুষ বাইকার এসে আমাকে চাপায় দেওয়ার চেষ্টা করে বা খুব কাছে এসে পাশ কেটে যায়। অনেক সময় তারা অবান্তর মন্তব্য করে হাসাহাসিও করে।

“আর বাস ড্রাইভাররা তো নারী স্কুটিচালক দেখলে একদম কাছে এসে হর্ন দিতে থাকে। কিছু বলার সুযোগ থাকে না এসব ক্ষেত্রে।”

রাইসা অবশ্য জানান, কেবল পুরুষ নয়, নারীদের গাড়ি চালানো অনেক সময় খোদ নারীরাই সহজভাবে নিতে পারেন না। পুরুষদের পাশাপাশি তারাও ক্ষেত্রবিশেষে মারমুখী আচরণ করে বসেন।

তিনি বলেন, “একবার এক সিএনজি এসে আমার স্কুটির পেছনে ধাক্কা দিল। আমি রাস্তায় পড়ে গেলাম। প্রশ্ন করায় ওই সিএনজিচালক ও তার নারী আরোহী আমাকেই বলে বসলেন, আমি গাড়ি চালাতে পারি না। ওই নারী আমাকে এও বলেন, ‘বাইক চালানো কি তোমার কাজ? আলগা যত ঢং তোমাদের। তোমার ভাগ্য পরে মরে থাকোনি’।”

স্কুটি চালাতে গিয়ে ভোগান্তির শিকার হন অধরা ইয়াসমিনসহ অন্যরা।

রাইসার মতো অনেক নারী আছেন, যারা স্কুটিকে চলার পথের সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তবে স্কুটি তাদের আত্মনির্ভরশীল বা স্বাবলম্বী করেছে এমনটা শুরুতে মনে করলেও কিছুদিন না যেতেই পরিস্থিতি তাদের ভাবনার বদল ঘটাতে বাধ্য করেছে।

বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেলে রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেন অধরা ইয়াসমিন। স্কুটি তার যাতায়াতকে অনেক সহজ করেছে বলে জানান তিনি। বলেন, “স্কুটি থাকাতে অনেক সুবিধা হয়েছে। সময় বাঁচে। তবে রোজই কিছু না কিছু দুর্ভোগ পোহাতে হয়।  

“রাস্তায় চলার সময় কখনও কখনও মনে হয়, বেপরোয় বাস, ট্রাক বা সিএনজিচালকরা যেন আমাকে তাড়া করছে। পেছন থেকে বারবার হর্ন দিতে থাকে তারা। একেক দিন একেক চালকের কাছ থেকে বাজে আচরণ পাই। এসব নিয়েই চলতে হচ্ছে। তেমন কোনও পরিবর্তন নেই আসলে।”

অধরার বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে আরেক স্কুটি চালক ফারজানা ইয়াসমিন বলেন, “বাস, ট্রাক, সিএনজিচালকদের কাছ থেকে দুর্ব্যবহার তো সাধারণ ঘটনা। নারী বলে ট্রাফিক পুলিশরাও কম দুর্ব্যবহার, কম হয়রানি করে না। এমনও দিন গেছে রাজধানীর প্রতিটি মোড়ে পুলিশ আটকিয়েছে।

“ট্রাফিক পুলিশদের কাছ থেকে এমন মন্তব্যও শুনেছি যে, নারী চালকদের তো লাইসেন্স লাগে না। তারা সুন্দর করে হেসে দিলেই তো সব মাফ। ‘তা আপনার কাছে লাইসেন্স আছে? নাকি একটু হেলমেটটা খুলে হেসে দেখাবেন?’ লাইসেন্স দেখতে চেয়ে এমন মন্তব্যও তারা করেন।”   

নারী হয়ে স্কুটি চালানোর ‘অপরাধে’ পুলিশের কাছ থেকে আরও কী ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়, সে অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ফারজানা বলেন, “একবার এক সার্জেন্ট আমাকে আটকান। আমার স্কুটির চাবি নিয়ে নেন। আমি আমার লাইসেন্সসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তাকে দেখাতে যাই।

“সেই পুলিশ সার্জেন্ট আমার পরে আটকানো মোটরসাইকেলচালকদের কাগজ দেখছিলেন কিন্তু আমারটা দেখছিলেন না। এভাবে আমাকে প্রায় ৪০ মিনিট দাঁড় করিয়ে রাখেন তিনি। আমাকে আটকে রেখে তিনি এর ওর সঙ্গে গল্প করছিলেন, এদিক-ওদিক হাঁটাহাঁটি করছিলেন কিন্তু আমার বৈধ কাগজের দিকে তিনি তাকাচ্ছিলেন না। আমার স্কুটির চাবিও দিচ্ছিলেন না।”

স্কুটি নারীকে বাড়তি নিরাপত্তা দিলেও অনেক সময় এর কারণে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন নারী চালকরা-এমনই মন্তব্য করেন আফসারা বেগম।

মিরপুর ১১ নম্বরের এই বাসিন্দা বলেন, “আমার বাচ্চাদের স্কুলে আনা-নেওয়া করি স্কুটি দিয়ে। একবার এক বাসচালক আমাকে চাপ দিয়ে আইল্যান্ডে তুলে দিল। পাশে দাঁড়ানো ট্রাফিক পুলিশকে অভিযোগ করাতে তিনি উল্টো বাস চালককে বলে উঠলেন, “বাস স্কুটির উপর তুলে দিলি না কেন? এমন ফালতু মহিলাদের মেরে দিলে ক্ষতি নেই, কিছু হবে না।”

আফসারা বলেন, “পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার জায়গা থেকে না হয় ওই বাসচালক আর ট্রাফিক পুলিশ আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করেছে। কিন্তু স্কুটি নিয়ে আমি বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যাই, নিয়ে আসি- এ নিয়ে স্কুলের শিক্ষার্থীদের নারী অভিভাবকরা পর্যন্ত কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করতে ছাড়েন না।”

অবশ্য ট্রাফিক পুলিশের হাতে নারী স্কুটি চালকদের হেনস্তার অভিযোগ মানতে নারাজ ডিএমপির গুলশান দক্ষিণ ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার এ এস এম হাফিজুর রহমান। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এরকম হওয়ার কোনও সুযোগই নেই। রাস্তায় গাড়ি চলাচলে ট্রাফিক নিয়মগুলো নারী-পুরুষ সবার জন্য সমান।

“নিয়ম মেনে চললে আর প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট, লাইসেন্স সঙ্গে থাকলে সবাই নির্বিঘ্নে রাস্তায় চলাচল করতে পারে। নারীদের বরং আমরা বিশেষ চোখেই দেখি। সেক্ষেত্রে এসব অভিযোগের সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না। তবে কারও সঙ্গে যদি এমন ঘটনা ঘটে থাকে, তারা যদি নাম পরিচয়সহ অভিযোগ করেন, আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত।”

‘যাব বহুদূর’ নামে একটি স্কুটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে আতিকা রোমার। স্কুটি চালাতে গিয়ে কী ধরনের সমস্যা হয়, তা এই কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া নারীদের কাছ থেকে প্রায়ই শোনেন তিনি।

প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন আতিকা রোমা।

আতিকা ১৯৯০ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রথম বাইক চালানো শুরু করেন। এরপর দীর্ঘদিন বাইক চালাননি তিনি। শিক্ষাজীবনের গণ্ডি পেরিয়ে ২০০৪ সালে কর্মজীবন শুরু হয় তার। তখন বাস-সিএনজিই ছিল যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম।

তবে গণপরিবহনে নানা ভোগান্তির পর ২০০৮ সালের শেষের দিকে ব্যাটারিচালিত মোটরসাইকেল কেনেন আতিকা।

আতিকা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমার প্রতিষ্ঠান থেকে শিখে যারা এখন স্কুটি চালান, তাদের অনেকে আমাকে ফোন করে চলাফেরায় সমস্যার কথা জানান।

“অন্য চালকদের বাজে মন্তব্য, হয়রানি তো রোজকার বিষয়। এসবের বাইরে আরও একটি সমস্যা আছে যা তারা আমাকে প্রায়ই বলেন। বেশিরভাগ স্কুটির তেল নেওয়ার জায়গা সিটের নিচে থাকে। নারী স্কুটি চালকরা যখন তেল নিতে পেট্রোল পাম্পে যান, তখন তাদের নেমে সিট খুলতে সময় লেগে যায়। এতে সেখানকার স্টাফরা বিরক্ত হন। কটূ কথা শোনান।”

পেট্রোল পাম্পে এ ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে আতিকার নিজেরও। বলেন, “একবার তেল নিতে পাম্পে গেলাম। রাত তখন অনেক। সেখানকার লোকজন আমাকে দেখে খুবই বিরক্ত। তারা আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, ‘এত রাতে মেয়েমানুষ বাইরে কেন, বুঝি না’।”

“অনেক নারীই এখন স্কুটিতে অভ্যস্ত হতে শিখছেন। কিন্তু তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমাজ এগুচ্ছে না। পিছিয়ে আছে। তাই এত সমস্যার শিকার হচ্ছেন নারীরা,” যোগ করেন আতিকা।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত