একটি শো করতে সিলেটের পথে রওনা করেছিল অড সিগনেচার ব্যান্ডের সবাই। যাত্রা পথে নরসিংদীর পাঁচদোনায় এক সড়ক দুর্ঘটনায় পড়ে তাদের গাড়ি; আর তাতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান ব্যান্ডের ভোকাল আহাসান তানভীর পিয়াল।
শনিবার সকাল ১০টা ২৬ মিনিটের দিকে অড সিগনেচার ব্যান্ডের ফেইসবুক পাতায় এই দুর্ঘটনার নিশ্চিত খবর জানা যায়।
অড সিগনেচার ব্যান্ডের সদস্যরা সিলেটের এমসি কলেজের একটি অনুষ্ঠানে পারফর্ম করতে মাইক্রোবাসে রওনা করেছিলেন।
নরসিংদীর পাঁচদোনায় ড্রিম হলিডে পার্কের সামনে তাদের গাড়ি দুর্ঘটনার মুখে পড়ে। গাড়িতে থাকা ব্যান্ডের তিন জন সদস্য আহত হন।
ঘটনাস্থলে মারা যায় দুজন; গাড়ির ড্রাইভার সালাম এবং ব্যান্ডের কণ্ঠ আহাসান তানভীর পিয়াল।
বিভিন্ন খবরের বরাতে জানা যায়, ঢাকা ছেড়ে সিলেটের পথে চলা মাইক্রোবাস এবং সিলেট ছেড়ে ঢাকামুখে আসা হানিফ পরিবহনের যাত্রীবাহী বাসের মধ্যে সংঘর্ষ হয় ভোর বেলা। দুর্ঘটনায় মাইক্রোবাসটি দুমড়েমুচড়ে যায়।
তবে মাইক্রোবাসকে চাপা দিয়ে বাসটি পালিয়ে যায়।
মাধবদী ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ঘটনাস্থলে এসে মাইক্রোবাস কেটে দুজনের লাশ উদ্ধার করেন।
বাকিদের অবস্থা তখন আশঙ্কাজনক ছিল। আহত তিনজনকে উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে পাঠানো হয়।
দুর্ঘটনায় আহত অন্য তিন ব্যান্ড সদস্য হলেন সাকিন, আকিব ও অমিতাভ।
বিকাল ৩টা ২৪ মিনিটে ফেইসবুকের ওই পোস্টে এক আপডেট মন্তব্যে অড সিগনেচারের পক্ষ থেকে বলা হয়, “বাকিরা সবাই আশঙ্কামুক্ত।”
তবে শ্রোতা ও বাকি সব ব্যান্ডশিল্পীদের মন্তব্য বলছে, তারা ব্যান্ডশিল্পী পিয়ালের মৃত্যু সংবাদে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন।
ব্যান্ড ভক্ত একজন ফেইসবুকে পিয়ালের জন্য শোক জানিয়ে লিখেছেন, “কোনো দিন আর তাকে মঞ্চে দেখতে পারবো না।
“হাতে গিটার নিয়ে ও তার গলার চিৎকার করে গাওয়া গানগুলো… পারবো না আর তার গানের মধ্যে নিজের ডিপ্রেশন ও ইমোশনগুলোকে আড়াল করতে।”
“শুনতে পারবো না আর…আমার দেহখান, দুঃস্বপ্ন, ঘুৃৃম, প্রস্তাব, তুমিও পারো, মন্দ ইত্যাদি গানগুলো। হয়তো এই দিনের জন্যই আমার দেহখান গানটি গেয়েছিলেন তিনি। নিজের গাওয়া গানটি রেখে নিজেই চিরবিদায় নিলেন এই পৃথিবী থেকে।”
তরুণদের প্লেলিস্টে জায়গা করে নেওয়া অড সিগনেচারের পিয়ালকে মনে রাখবে এই প্রজন্ম; এ কথা ফেইসবুকে লিখেছেন আল তুরাগ হুসেইন।
আমার দেহখান গানটি তাকেও বিমর্ষ করে তুলছে বারবার।
“কয়েক বছর আগে কলেজ শেষে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠলাম ‘আমার দেহখান’ গানটা প্রথম ইউটিউবে শুনেছিলাম। কি অনবদ্য কণ্ঠ, এতো মায়া আর কষ্ট একটা গানে থাকতে পারে এবং তা অনুভব করার যে একটা আকুতি তার সবটুকু সেই গানে খুঁজে পেয়েছি।”
“প্রস্তাব, ঘুম, দুঃস্বপ্ন, তুমিও পারো, আমার বাংলাদেশ, মন্দ,উল্লাসে মগ্ন এই গানগুলো নিজেই একেকটা মাধুর্যতার সংজ্ঞা। এর মাঝে প্রস্তাব গানটা তো যেন পুরোপুরি মনের অভিব্যক্তিই বলে দেয়। পিয়াল ভাইয়ার ভয়েস যেভাবে এই জেনারেশনকে কানেক্ট করেছে তা এই জেনারেশন কখনো ভুলতে পারবে না।”
“প্লেলিস্টে যখন হঠাৎ ‘আয় ঘুম চুম্বন দে তার সাড়া কপালে, যাতে ঘুম আসে সব নিশ্চুপ হয়ে যায়’ কিংবা ‘সেই দিনে এক গানে এক গল্পকারের গল্প খুঁজে পাবে, খুঁজে পাবে না সেই গল্পকার’ বেজে উঠবে তখন বার বার মনে পড়বে আমাদের একজন আহসান তানভীর পিয়াল ছিলেন।”
ফিউজড ব্যান্ডের ভোকাল ফারহান মেসবাহ একদিন আগেও ছবি তুলেছেন পিয়ালের সঙ্গে; এই মৃত্যুর খবর তাকে নাড়া দিয়েছে।
ফারহান মেসবাহ সে অনুভূতি জানিয়ে ফেইসবুকে লিখেছেন, “আমি কালকেও পিয়ালের সাথে ছবি তুললাম। দেখা হইতো এরকম হুটহাট কনসার্টে যেয়ে। বুঝতাম যে পিয়াল শুধু বড় বড় শো-তে পারফর্ম করে তা না, সে একজন সাধারণ অডিয়েন্স হিসেবেও এনজয় করতে পছন্দ করতো।”
“যখনই আমার সাথে দেখা হইতো অথবা ম্যাসেঞ্জারে কথা হইতো, এতো হাম্বল মানুষ খুব কমই দেখেছি। আমরা একসাথে একটা ক্যাম্পেইনেও কাজ করেছিলাম, কতো যে কথা হইছিলো ঐ টাইমটায়, সব কিছু এখন জাস্ট মেমোরি হয়ে থাকবে। আমার এতো খারাপ লাগতেছে।”
ফারহান শাহরিয়ার লিখেছেন, “এখনো মনে হচ্ছে হয়ত কেউ নিউজ দেবে পিয়াল ভাই বেঁচে আছেন। আবার গিটার হাতে স্টেজে উঠে গাইবেন ‘আমার দেহখান নিও না শ্মশান’। কিন্তু বাস্তবতা হলো অড সিগনেচারের হয়ে এই গান পিয়াল ভাই আর কখনো গাইবেন না।”
জাহিদ খন্দকার লিখেছেন, “অড সিগনেচার খুবই পছন্দের ব্যান্ড ছিলো। কিন্তু এক বছর ধরে তাদের কোনো গানই শোনা হতো না। কালকে হঠাৎ কী মনে করে দেহখান গানটি শুনতে গেলাম এবং বসে বসে গানটির কমেন্ট পড়তেছিলাম।
“আজকে হঠাৎ খবর পেলাম দেহখান গানের মেইন ভোকালিস্ট সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে।”
অড সিগনেচারের সেই পোস্টে মন্তব্য ঘরে এর মাঝে জমে গেছে হাজার হাজার মন্তব্য।
শোকগ্রস্ত সবার একটাই কথা, “আমার দেহখান গানের এই পূর্ণতা মেনে নেওয়া যাচ্ছে না।”
ব্যান্ডের ভোকাল ও গিটারিস্ট আহাসান তানভীর পিয়াল গানের পাশাপাশি একটি মার্কেটিং এজেন্সির জুনিয়র অ্যাংগেজমেন্ট অফিসার হিসেবেও কাজ করতেন।
পিয়াল নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ১৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী। এখানে সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্য ছিলেন তিনি।
আহসান তানভীর পিয়ালের মৃত্যুতে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন তার ও ব্যান্ডের অনুরাগীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছে।
মোনতাসির রাকিব, আরমান অমিতা, ইক্তেদার সাকিন, আকিব আহমেদ, তাহমিদ রায়ান অনিন্দ্য এবং আহসান তানভীর পিয়ালকে নিয়ে ছিল অড সিগ্নেচার ব্যান্ড। পিয়ালের মৃত্যুতে দলে সদস্য হলো ৫ জন।
২০১৭ সালে পথচলা শুরু করা এই ব্যান্ডের ‘আমার দেহখান’, ‘ঘুম’, এবং ‘কবিতা’ গানগুলো জনপ্রিয়তা পেয়েছিল তরুণদের মাঝে। সবগুলো গানই গেয়েছিলেন পিয়াল।