পুরনো পরিত্যক্ত প্লাস্টিক পণ্য দিয়ে তেল, চিনি, আটা, এমনকি মুরগি কিংবা মাছও মিলছে চট্টগ্রামে। কেউ যদি রোজকার বাজারের পরিবর্তে স্কুল ব্যাগ, খাতা-কলমের মতো শিক্ষা উপকরণ চান, সেটিও মিলবে পুরনো প্লাস্টিক জমা দিলেই।
গত সপ্তাহে চট্টগ্রামে শুরু হয়েছে পুরনো প্লাস্টিকের বিনিময়ে প্রয়োজনীয় পণ্য পাওয়ার এ ব্যবস্থা। ‘প্লাস্টিকের বিনিময়ে বাজার’ শিরোনামে এ ব্যতিক্রমী কার্যক্রম শুরু করেছে বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন।
এর আগে কক্সবাজারের সেন্ট মার্টিন দ্বীপে একই ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তবে চট্টগ্রাম শহরে এ ধরনের উদ্যোগ এটিই প্রথম।
সোমবার সকালে নগরীর বাকলিয়া স্টেডিয়ামে বিদ্যানন্দের এই উদ্যোগের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। এর মাধ্যমে বছরজুড়ে দুই লাখ কেজি পরিত্যক্ত বা পুরনো প্লাস্টিক পণ্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রাথমিকভাবে নিজস্ব তহবিল থেকেই পাইলট প্রকল্প চালু করেছে বিদ্যানন্দ। যথাযথ সাড়া পেলে নগরজুড়ে এর পরিধি বাড়বে এবং পরবর্তী বছরে কার্যক্রম আরও সম্প্রসারিত করা হবে।
বাকলিয়া স্টেডিয়ামে এক বছর মেয়াদী পাইলট প্রকল্পের উদ্বোধন করে চট্টগ্রাম সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, “জলাবদ্ধতা বন্দরনগরী চট্টগ্রামের প্রধান সমস্যা। পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জন করতে পারলে আমরা নগরীর জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান পাব। জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ প্লাস্টিক ও পলিথিন। সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে এই কাজটি করা কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং। তাই বিদ্যানন্দের নতুন এই উদ্যোগ আমাদের সহযোগিতা করবে।”
বাকলিয়া স্টেডিয়াম এই কার্যক্রম শুরুর প্রথম দিনেই পাঁচ শতাধিক পরিবার নিজেদের সংগ্রহে থাকা পুরনো প্লাস্টিকের বিনিময়ে সদাই করেন। সেদিন তিন টন পরিত্যক্ত প্লাস্টিক সংগ্রহ করা হয়, যদিও লক্ষ্যমাত্রা ছিল পাঁচ টনের।
বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, পাইলট প্রকল্পটি স্থায়ী করতে নগরীর হালিশহর ও পতেঙ্গা এলাকায় দুটি দোকান নির্মাণ করা হবে। এছাড়া নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে থাকবে ৫০টি ভ্রাম্যমাণ বাজার কাজ শুরু করেছে। এ কাজে বিদ্যানন্দকে লজিস্টিক সহায়তা দিচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। প্রকল্পের পুরো তহবিল যোগান দিচ্ছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন নিজেই।
‘প্লাস্টিকের বিনিময়ে বাজার’ গ্রাহকের চাহিদার পর ভিত্তি করে ২২ ধরনের পণ্য রেখেছে। সেখানে এক কেজি প্লাস্টিকের বিনিময়ে ছয়টি ডিম, কিংবা আধা কেজি সুজি কিংবা একটি পরনের কাপড় নেওয়া যাবে।
আবার তিন কেজি পলিথিন বা প্লাস্টিকের পরিবর্তে এক কেজি চিনি, দুই কেজি আটা; চার কেজির বিনিময়ে একটি মাছ, এক লিটার সয়াবিন তেল; ছয় কেজি প্লাস্টিকের বিনিময়ে একটি মুরগি পাওয়া যাবে।
ভোগ্যপণ্যের পাশাপাশি পাওয়া যাবে শিক্ষা উপকরণও। যেমন এক কেজি প্লাস্টিক বা পলিথিনের বিনিময়ে ১২টি কলম, কিংবা চারটি পেন্সিল অথবা খাতা সংগ্রহ করা যাবে। আট কেজি প্লাস্টিক বা পলিথিন দিলে মিলবে একটি স্কুল ব্যাগ।
অর্থাৎ সব ধরনের গ্রাহক যেন পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের বিনিময়ে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী পণ্য নিতে পারেন সেজন্য বিদ্যানন্দ স্টোরে রাখছে ২২ ধরনের সামগ্রী।
বাকলিয়া স্টেডিয়ামে ‘প্লাস্টিকের বিনিময়ে বাজার’ কর্মসূচির কথা আগেই জানতে পেরেছিলেন স্থানীয়রা। পলে সকাল থেকেই স্টেডিয়ামে ভিড় করেন বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ ও শিশুরা। প্রায় প্রত্যেকের হাতেই ছিল বড় বড় ব্যাগ। বাজার করতে আসা বেশিরভাগই ছিলেন নিম্ন আয়ের মানুষ, অবশ্য শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষও দেখা গেছে।
বাজার করতে আসা মানুষের মধ্যে যেমন ছিলেন রিকশাচালক, তেমনি ছিলেন ভাসমান মানুষও। আবার স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদেরও দেখা মিলেছে।
কথা হয় রিকশাচালক রকিব উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি সঙ্গে এনেছিলেন অনেকগুলো পানির পুরনো জার, বেশকিছু ভাঙা প্লাস্টিকের গাড়ি।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ভালো বিনিময়মূল্য মিলবে শুনে এসেছি, দেখা যাক কেমন দাম পাই।”
নিয়মিত ভাঙারির দোকানে প্লাস্টিক পণ্য বিক্রি করেন রহিমা খাতুন। বিভিন্ন বাসায় কাজ করতে গিয়ে এসব সংগ্রহ করেন তিনি।
রহিমা বললেন, ভাঙারির দোকানের চেয়ে এখানে বেশি দাম পেয়েছি। ভাঙারি দোকানে এক কেজি প্লাস্টিক বিক্রি করি প্রতি কেজি ৩২ টাকায়। এখানে তার দ্বিগুণের বেশি দাম পেয়েছি।
এমন দাম মিললে নগরবাসী বেশি লাভের আশায় এখানেই বাজার করতে আসবে বলে মনে করেন রহিমা খাতুন।
বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের বোর্ড সদস্য জামাল উদ্দিন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “হাউজহোল্ডে যারা প্লাস্টিক সংগ্রহ করেন তাদের উপস্থিতি ছিল প্রথমদিন উল্লেখ করার মতো। কারণ তারা সাধারণত ভাঙারির দোকানে যান না। এখানে দাম বেশি পাবেন আশায় এসেছেন এবং বেশি দামই পেয়েছেন। আমরা সব ধরনের পলিথিন নিচ্ছি যেমন কালো পলিথিন যার কোনও দাম নেই সেটি নিচ্ছি আবার বেশিদামি-কমদামি সব প্লাস্টিকও নিচ্ছি।
“ফলে একটা গড় দাম ধরে কেজি প্রতি ৬০-৮০ টাকা পর্যন্ত দাম দিচ্ছি; যেখানে ভাঙারি দোকান দিচ্ছে ২০-৩০ টাকা গড়ে। এরফলে মানুষ আগ্রহভরেই এই বাজারে বিক্রির জন্য আসছে।”
কেবল সচেতনতা নয়, জনগণের সম্পৃক্ততা চাইছেন জানিয়ে জামাল উদ্দিন বলেন, “ধরুন এই প্রচার যদি বাড়ে যে এখানে আমরা সব প্লাস্টিক নিই এবং দাম বেশি দিই তাহলে দেখবেন বাসার কাজের সহকারী জিনিসগুলো জমিয়ে রাখার পর আমাদের কাছে নিয়ে আসবেন। এতে প্লাস্টিক বা পলিথিন বর্জ্য হিসেবে ড্রেন নালা-খাল-রাস্তাঘাটে পড়ার আগেই আমরা সংগ্রহ করে ফেলছি। ফলে নালা বন্ধ হয়ে বিপর্যয় তৈরির আগেই সেগুলো আমাদের কাছে চলে আসছে।”
এই উদ্যোগের মাধ্যমে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কাজেও বিদ্যানন্দ সহযোগিতা করতে পারছে, জানালেন তিনি।
চট্টগ্রামে প্রতিবছর দুই লাখ কেজি পরিত্যক্ত প্লাস্টিক সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে জানিয়ে জামাল উদ্দিন বলেন, “নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডে পর্যায়ক্রমে এ ধরনের আয়োজন করা হবে। প্রথম বছর দুই লাখ কেজি প্লাস্টিক সংগ্রহের জন্য আমরা এক কোটি ২০ লাখ টাকার পণ্য দিচ্ছি। প্লাস্টিকগুলো রিসাইকেলকারী কোম্পানিকে দেওয়ার পর তারা সেই পণ্য কিনে আমাদের দেবে ৬০ লাখ টাকা। পরবর্তী বছর এই ৬০ লাখ টাকা আমাদের ফান্ডে থাকবে। বাকি ৬০ লাখ টাকা আমরা ভর্তূকি দিবো। পুরো টাকাই আমরা নিজেদের তহবিল থেকে যোগান দিচ্ছি।”
প্রকল্পটিকে বিদ্যানন্দ একটি সাসটেইনেবল বিজনেস মডেল হিসেবে দাঁড় করাতে চায়। ধীরে ধীরে ভর্তুকির পরিমাণ কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে। সংগঠনটির হিসেবে, প্রতিবছর অর্ধেক টাকা উঠে আসায় সরশেষ চতুর্থ বছরে গিয়ে এই প্রকল্পে আর কোনও ধরনের ভর্তুকি দিতে হবে না। ফলে চতুর্থ বছরেই প্রকল্পটি স্বাবলম্বী হবে।
জামাল উদ্দিন বললেন, “২০২২ সালে আমরা সেন্ট মার্টিন দ্বীপ দিয়ে প্রথম এই কার্যক্রম শুরু করেছিলাম। পরবর্তীতে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের সাথে মিলে পর্যটন মৌসুমে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এছাড়া দেশজুড়ে ৬৪ জেলায় একই ধরনের কার্যক্রম চলছে।
“এখন চট্টগ্রাম শহরে প্রথম কার্যক্রম শুরু করলাম। কিন্তু চট্টগ্রামে আমরা নিজেদের ফান্ড দিয়েই কার্যক্রম চালাচ্ছি। সিটি করপোরেশন আমাদের কাছ থেকে ভেনু ভাড়া নিচ্ছে না, নিরাপত্তা দিচ্ছে অর্থ্যাৎ লজিস্টিক সাপোর্ট দিচ্ছে।”