“পুরান ঢাকার নারিন্দার পঞ্চাশ কামরার বিশাল বাড়ি ‘পাঠান মঞ্জিল’-এর ছাদে, কার্নিশে কতিপয় বানর পরিবারের ঠিকানা। সেখানে একটা বিশেষ প্রবীণ বানর তার খয়েরি রঙের লেজ ঝুলিয়ে চিন্তাশীল ভঙ্গিতে বসে থাকে। অন্যান্য বানরের মতো সে চঞ্চল নয়। কার্নিশে বসে যে জগৎ-সংসারকে দেখে।”
লেখাটুকু শাহদুজ্জামানের ‘চিন্তাশীল প্রবীণ বানর’ ছোট গল্পের। এ গল্পের মতো আরও অনেকের লেখায় উঠে এসেছে পুরান ঢাকার বানরদের নানা কাহিনী। সত্যজিৎ রায়ের লেখায়ও উঠে এসেছে বানরের গল্প। বানর পুরান ঢাকার ইতিহাস, ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
পুরান ঢাকায় বানরদের এখনও ভবনের রেলিং কিংবা তার বেয়ে এখানে সেখানে ছুটতে দেখা যায়। তাঁতিবাজার, শাঁখারীবাজার, লক্ষ্মীবাজার, নারিন্দা, গেণ্ডারিয়ায় দেখা মেলে তাদের। বিভিন্ন অলি-গলিতে তারা ধরে রেখেছে দাপট। বসবাস করে আসছে স্থানীয়দের সঙ্গে।
তবে বানরগুলো এখন ভালো নেই। ক্রমেই বিলুপ্তির পথে। কমছে বানরের সংখ্যা। আগের মতো মেলে না খাবার। রোগের কারণেও কমছে দলের বানর সংখ্যা।
কোভিডের পর তাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো তেমন কোনও সংগঠনের দেখা নেই। কোভিডের প্রথম দিকে সিটি করপোরেশন ও বিভিন্ন সংগঠন থেকে কিছু খাবার দেওয়া হলেও এখন স্থানীয় মানুষের খাবারের ওপরে নির্ভর করেই বানরগুলো বেঁচে আছে।
পুরান ঢাকায় বানর কবে থেকে
পুরান ঢাকার বানরের উপস্থিতি কবে থেকে- সে প্রশ্নের জবাব মিলেছে সাধনা ঔষধালয়ে প্রবীণ কর্মচারী ভবতোষ দের কাছে। বহু বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে তিনি। তার দাবি, পুরান ঢাকায় এই বানরদের আগমন প্রফেসর ড. যোগেশচন্দ্র ঘোষের সময় থেকে। যোগেশচন্দ্র ১৯১৪ সালে গেণ্ডারিয়ার দীননাথ সেন রোডে প্রতিষ্ঠা করেন সাধনা ঔষধালয়। নিজেদের কাজের কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য তিনি প্রচুর গাছ লাগান। এই গাছগুলোতেই এসে থাকা শুরু করল বানরগুলো।
তখন সাধনা ঔষাধালয়ের কারখানায় ওষুধ বানানোর কাজে ব্যবহার করা হতো গুড়। এই গুড়ের গন্ধে বানরগুলো কারখানায় চলে আসতো। লুকিয়ে গুড়ও খেতো। এই দেখে যোগেশচন্দ্র নিজেই তার কারখানার একটি ঘর বানরদের থাকার জন্য ছেড়ে দেন। তখন থেকেই বানরদের নিয়মিত খাবার দেওয়ার রেওয়াজও চালু করেন তিনি। বিকাল হলেই আশপাশের এলাকা থেকে দর্শনার্থীরা আসতেন বানরের খুনসুটি দেখতে।
একাত্তরের সময়, পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে যোগেশচন্দ্র ঘোষের নির্মম মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরিরাও নিয়মিত খাবার দিতেন বানরদের। এখনও এই প্রথা চলে আসছে। শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও সেই ঐতিহ্য বজায় রেখেছে সাধনা ঔষধালয়।
তবে এখন সব চলছে সীমিত পরিসরে। সময়ের বিবর্তনে আগের সেই জৌলুস হারিয়েছে সাধনা ঔষধালয়। সেইসঙ্গে সেখানকার বানরের অবস্থাও আগের মতো ভালো নেই। এখনও প্রতিদিন সকালে সাধনা এখানকার বানরদের দশ কেজি ছোলা খেতে দেয়। আগে বানরদের ছোলা-বুট, রুটি কিংবা কলা খেতে দেওয়া হতো। পরিমাণে কমে এলেও, এখন পর্যন্ত একদিনের জন্যও খাবার দেওয়া বন্ধ করেননি বলে জানান ভবতোষ।
পুরান ঢাকায় বানর কবে থেকে- এ নিয়ে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য।
তবে অনেকের বক্তব্য ও লেখা থেকে জানা যায়, ঢাকাকে এখন যে রূপে দেখা যাচ্ছে, এর সঙ্গে আদি ঢাকার মিল নেই। আগে এখানে বনজঙ্গলে হাতি, বুনো মহিষ, বড় বিড়ালেরও আনাগোনা ছিল। সতেরো শতকেও এখানকার বনাঞ্চলে বাঘের দেখা মিলত।
গত কয়েক দশকে ঢাকা একটু একটু করে শহর হয়ে উঠেছে। ধীরে ধীরে প্রাণিহীন হয়ে পড়েছে ঢাকা। যারা টিকে আছে তাদের মধ্যে রয়েছে বানরগুলো। তবে তাদের সংখ্যাও কমতে শুরু করেছে।
হারিয়ে যাচ্ছে বানরগুলো
শাঁখারীবাজার এলাকার বাসিন্দা টিটু দাস সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ছোট বেলায় যত বানর ছিল, এখন তো কিছুই নাই। আগে আমার বাসার ছাদে যত বানর থাকত, তা এখন এলাকাতে নাই।
“এখন যেসব বানর দেখা যায়, তাদের দেখলেই বোঝা যায় সব রোগা হয়ে গেছে। খাবার না পাওয়ায় এমন অবস্থা।”
আগে বিভিন্ন সংগঠন খাবার দিত, কিন্তু কোভিডের পর থেকে খাবার দেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানান টিটু। বলেন, “এলাকার মানুষজন কিছু খাবার দেয়, তা-ই ভরসা এই বানরদের।”
এত বছর ধরে মানুষের সঙ্গে সহাবস্থানে সহিষ্ণু দেখা গেছে বানরগুলোকে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে খাদ্যের অভাবে মাঝে মধ্যেই হিংস্র হয়ে উঠছে তারা। খাবারের আশায় প্রাণিগুলো ছুটে বেড়ায় এক গলি থেকে আরেক গলি। তবে সন্ধ্যা নামতেই সবাই ফিরে আসে আবাসস্থলে। শক্তি, সাধনা, দীননাথ সেন রোডের কবরস্থান, বিভিন্ন বাড়ির ছাদ, গাছে এদের বসবাস।
খাদ্য ও বাসস্থানের অভাবে বানরের সংখ্যা আজ অনেকটাই কম। আর এ কারণেই প্রাণিগুলো আক্রমণ করছে, খিটখিটে আচরণ করছে। ফ্রিজ খুলে খাবার-দাবার নিয়ে যাচ্ছে, জানালার গ্রিল থেকে নিয়ে যাচ্ছে কাপড়। বাড়িগুলোর দিকে তাকালে বোঝাই যায়, বানরের উৎপাতে বাসার দরজা, জানালায় আলাদা বেড়াজাল লাগিয়ে রেখেছেন বাসিন্দারা।
তাঁতিবাজার এলাকার বাসিন্দা লিটন মিয়া সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বানরগুলোর খাবারের বড্ড সংকট। মাঝে মাঝেই তারা জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে খাবার নিয়ে যায়। এছাড়া মানুষের কাপড় নিয়ে যায়। আমার বাসা থেকে একটি টি-শার্ট নিয়ে গেছে। আরেকবার ঘরে এসে কলা নিয়ে গেছে।
“স্থানীয় মানুষজন এদের একটু ভয় পায়। এরা মাঝে মাঝে বাসা-বাড়িতে ঢুকে পড়ে, বাচ্চারা ভয় পায়।”
গেন্ডারিয়া এলাকার ফল বিক্রেতা পরিমল দাস বলেন, “বানরের খুনসুটিতে বাচ্চারা খুবই আনন্দ পায়। বানর সাধারণত কোনও ক্ষতি করে না। বাইরের বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন বানর দেখতে আসে। তবে ঈদানিং পরিমাণ মতো খাবার না পেয়ে মানুষের দোকানঘর, বাসা বাড়িতে উৎপাত শুরু করেছে।
“আমি যখন সকালে দোকান খুলি তখন এরা আসে। এলাকার অনেকেই ফল কিনে ছুড়ে দেয়। এই ফলের আশায় ওরা আমার দোকানের আশেপাশের তার বেয়ে ঝুলে থাকে।”
“এরা রাতে বেশি তাণ্ডব করে, একবাড়ি থেকে অন্য বাড়ির ছাদে চলাচল করে। সকালবেলায় দেখা গেলেও সারাদিন ছায়ায় থাকে। আবার সন্ধ্যার দিকে বের হয়। মাঝে মাঝেই রাতে ওদের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়।”
বন্ধ হয়ে গেছে সিটি করপোরেশনের বরাদ্দ
গেণ্ডারিয়া অঞ্চলের বাসিন্দা ইকবাল কবির। এখানে আছেন তিন পুরুষ ধরে। তিনি বলেন, “ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন এখানকার বানরগুলোর জন্য প্রতিদিন ৩০ কেজি খাবার সরবরাহ করতেন। বর্তমান মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসের আমলে তা বন্ধ রয়েছে।
“বর্তমানে এলাকার বাসিন্দা ও সাধনার সরবরাহ করা খাবার দিয়েই কোনোরকমে দিনাতিপাত করছে গেণ্ডারিয়ার বানরগুলো।”
ঢাকা দক্ষিণের ৪২ নং ওয়ার্ডের জনপ্রতিনিধি আবুল কালাম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমি যতটুকু জানি এখন বানরদের খাবারের জন্য কোনও বরাদ্দ সিটি করপোরেশন থেকে আসে না।”
কেন আসে না প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “এটা তো আমার দেখার বিষয় না। এটা সিটি করপোরেশনের সমাজকল্যাণ বিভাগ দেখে। তারা কেন দেয় না তারাই জানে। আমার কাছে বরাদ্দ আসলে আমি তা কাজে লাগাব। আমার কাছে কিছু না আসলে আমি কী করতে পারি?”