Beta
শুক্রবার, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী অলি, নেপালে কি স্থিতিশীলতা আসবে

নেপালের নতুন প্রধানমন্ত্রী কে পি অলি।
নেপালের নতুন প্রধানমন্ত্রী কে পি অলি।
[publishpress_authors_box]

নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিএন-ইউএমএল) চেয়ারপারসন কে পি শর্মা অলি চতুর্থবারের মতো দেশটির প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এর আগেও তিনি দেশটির প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আশা করা হচ্ছে, আগের মেয়াদে তিনি যেসব ভুল করেছেন সেগুলো এবার শোধরাবেন।

২০১৫ সালের অক্টোবরে তার প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সময় নেপালের নতুন সংবিধান প্রবর্তনের প্রেক্ষিতে তরাই/মাধেশ অঞ্চলে সহিংস বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল। ভারতের অবরোধের কারণে পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে উঠে।

অলির মেয়াদ শুরু হওয়ার কয়েক মাস পরে ভারত তার অবরোধ প্রত্যাহার করে নেয়। আন্দোলনকারী সম্প্রদায়গুলোর উদ্বেগ সমাধান করার জন্য সংবিধানও সংশোধন করা হয়েছিল। যদিও মাধেশ-ভিত্তিক দলগুলো সংবিধান সংশোধনের ওপর ভোট বর্জন করেছিল, কারণ এতে আংশিকভাবে ভিন্নমতের গোষ্ঠীগুলোর উদ্বেগের সমাধান করা হয়েছিল।

তার সরকার চীনের সঙ্গে একটি ঐতিহাসিক বাণিজ্য ও ট্রানজিট চুক্তিও স্বাক্ষর করেছিল। এর ফলে তৃতীয় দেশে বাণিজ্যের জন্য ভারতের ওপর নেপালের নির্ভরতার অবসান ঘটে।

অলি প্রথম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন ২০১৫ সালের অক্টোবরে এবং ২০১৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত ১০ মাস প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় অলির জাতীয়তাবাদী ভাবধারা এতটাই প্রভাব ফেলেছিল যে তার সিপিএন-ইউএমএল ২০১৭ সালের নির্বাচনে সবচেয়ে বড় দল হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার খুব কাছাকাছি আসন পায়।

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে অলি দ্বিতীয়বার আরও শক্তিশালী নির্বাচনী ম্যান্ডেট নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হন। দুই মাস পরে সিপিএন (মাওবাদী) এর সঙ্গে তার দল একীভূত হওয়ার পর পার্লামেন্টের প্রতিনিধি পরিষদে তিনি প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পান। এরপর পুষ্প কমল দাহাল প্রচন্ডের সঙ্গে যৌথভাবে তিনি নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে দিতে থাকেন।

প্রায় দুই দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে অলির প্রধানমন্ত্রিত্ব উচ্চ আশা এবং উত্তেজনার সঙ্গে শুরু হয়েছিল। অলি যেহেতু পূর্ণ পাঁচ বছরের জন্য সরকারের নেতৃত্ব দেবেন, আশা ছিল এক দশকের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার অবসান হবে, সংবিধান কার্যকর হবে এবং ফেডারেল ব্যবস্থা শক্তিশালী হবে।

কিন্তু সেই প্রত্যাশা অবশ্য স্বল্পস্থায়ী ছিল। নির্বাহী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই অলি তার স্বৈরাচারী আচরণ প্রদর্শন শুরু করেন। তিনি জাতীয় গোয়েন্দা বিভাগ, রাজস্ব তদন্ত বিভাগ এবং মানি লন্ডারিং বিভাগকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আওতায় নিয়ে আসেন।

ভিন্নমতের প্রতি তার অসহিষ্ণুতা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন তিনি সরকারের সচিবালয় ‘সিংহ দরবারের’ কাছে মাইতিঘরে বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করেছিলেন। তারপরে তার সরকার মিডিয়াকে স্তব্ধ করার, মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করার এবং নাগরিক অধিকার সংকুচিত করার লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি বিল প্রস্তুত করে।

তিনি বড় বড় স্বপ্ন বিক্রি করে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। যেমন, চীনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে রেলওয়ে নির্মাণ, সমুদ্রে নেপালের নিজস্ব জাহাজ ভাসানো, পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস বিতরণ ইত্যাদি। কিন্তু এসব স্বপ্নের কোনোটিই পূরণের কাছাকাছিও যেতে পারেননি।

ক্ষমতায় আসার দুই বছর পরও তিনি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছেন বুঝতে পেরে, তিনি আরেকটি জাতীয়তাবাদী কার্ড খেলেন। তিনি নেপালের মানচিত্রে কালাপানি, লিপুলেখ ও লিম্পিয়াধুরা দেখানোর জন্য সংবিধান সংশোধন করেন, যা তার পূর্বসূরিরা কখনো করতে সাহস করেননি। তার এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপে ভারত ক্ষুব্ধ হয়।

সরকার ও দলের নেতৃত্বে অলির স্বৈরাচারী কৌশল পুষ্প কমল দাহাল ও মাধব কুমার নেপালকে তার বিরুদ্ধে জোট বাধতে বাধ্য করে, যার ফলে নেপাল কমিউনিস্ট পার্টিতে বিভক্তি ঘটে। এনসিপিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে ব্যর্থ হওয়ার পরে, অলি ছয় মাসের মধ্যে দুবার পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।

সংবিধান লঙ্ঘন করার সিদ্ধান্তের কারণে ২০২১ সালের এপ্রিলে সরকার থেকে তাকে অপমানজনকভাবে সরে যেতে হয়েছিল। ২০২১ সালের মে থেকে জুলাই পর্যন্ত আবার তাকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, তবে পরে সুপ্রিম কোর্টের আদেশে পদচ্যুত করা হয়।

এবার চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসলেন তিনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অলির সামনে আগের ভুলগুলো শোধরানোর ঐতিহাসিক সুযোগ এসেছে।

কাঠমান্ডু বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক উদ্ধব প্যাকুরেল কাঠমাণ্ডু পোস্টকে বলেছেন, “কংগ্রেস-ইউএমএল জোট উচ্চ আশা জাগিয়েছে এবং অলিকে তার অতীতের ভুলগুলো সংশোধনের সুযোগ দিয়েছে।

“তবে, অলির সাম্প্রতিক বিবৃতি [পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার বিষয়ে] দেখায় যে, তিনি এখনও তার গতিপথ সংশোধনের মেজাজে নেই। নিজের অন্যায়ের জন্য তার কোনও অনুশোচনা নেই।”

এমনকি গত মাস পর্যন্ত অলি বারবার সংসদ ভেঙে দেওয়ার তার পদক্ষেপের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন।

প্যাকুরেল বলেন, কংগ্রেস-ইউএমএল জোট স্থিতিশীলতার ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু যে ব্যক্তি সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারের নেতৃত্বে থেকেও স্থিতিশীলতা দিতে পারেনি তিনি এখন স্থিতিশীল সরকার কীভাবে নিশ্চিত করবেন।

“নতুন সরকারের প্রতি আস্থা কম হবে কারণ দলগুলো এমনকি যে, চুক্তির মাধ্যমে সরকার গঠন করেছে তাও গোপন রেখেছে।”

অন্যদিকে কিছু বিশ্লেষক বলছেন, এবার সরকারকে অনেক দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করতে হবে।

ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের পিএইচডির শিক্ষক সঞ্জীব হুমাগাইন বলেন, “কংগ্রেস ও ইউএমএল উভয়ের মধ্যেই একটি জোরালো অভিমত রয়েছে যে, এমন সরকার গঠন করা বৃথা যা স্থিতিশীলতা দিতে পারে না। তাই ক্ষমতাসীন জোট ও বিরোধী- উভয়পক্ষ থেকেই ভালো করার চাপ আসবে।”

সঞ্জীব হুমাগাইন বলেন, “কংগ্রেস-ইউএমএল জোটের কাছে রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে, যা স্থিতিশীলতা আনার জন্য প্রয়োজন। আমলাতন্ত্রের জন্যও দুটি প্রধান দলের সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা না করা কঠিন হবে। ফলে আমি ইতিবাচক পরিবেশ দেখতে পাচ্ছি।”

গত শুক্রবার পার্লামেন্টে আস্থা ভোটে হেরে ক্ষমতা ছেড়েছেন প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দাহাল প্রচন্ড। সোমবার দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন কে পি শর্মা অলি।

২০০৮ সালে নেপালের ২৩৯ বছরের পুরোনো রাজতন্ত্র বিলুপ্ত করা হয়। এরপর থেকেই দেশটি অস্থিতিশীল অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।

রাজতন্ত্র বিলুপ্তির পর কে পি শর্মা অলির নেতৃত্বাধীন জোট সরকার হতে যাচ্ছে নেপালের ১৪তম সরকার।

তথ্যসূত্র: কাঠমান্ডু পোস্ট

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত