শক্তি ও গতি বাড়িয়ে বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হেনেছে ঘূর্ণিঝড় রেমাল। বাংলাদেশ সময় রাত ৮টার কিছু পরে মোংলার দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে খেপুপাড়া উপকূল অতিক্রম শুরু করে ঝড়টি।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রের ৬৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৯০ কিলোমিটার। যা দমকা বা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছে।
ঘূর্ণিঝড়টির কেন্দ্র আরও উত্তর দিকে এগিয়ে এক-দুই ঘণ্টার মধ্যে উপকূল অতিক্রম করে সম্পূর্ণ ঝড়টি পরবর্তী পাঁচ থেকে সাত ঘণ্টার মধ্যে পুরো উপকূল অতিক্রম করে যাবে বলে আবহাওয়ার বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত না হলেও রেমালের আওতা বেশ বড়। ফলে ভারতের বিভিন্ন এলাকা ছাড়াও বাংলাদেশের খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটসহ পুরো উপকূলে প্রবল বৃষ্টি ঝরতে শুরু করেছে; সঙ্গে আছে ঝড়ো বাতাসও।
ঘূর্ণিঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের উপপরিচালক মো. শামীম আহসান রবিবার রাত সোয়া ৮টার দিকে রেমাল সংক্রান্ত ব্রিফিং করেছেন।
তিনি জানিয়েছেন, রেমালের আকার প্রায় ৪০০ কিলোমিটার। এর অগ্রভাগ সন্ধ্যা ৬টার দিকেই খুলনা উপকূলের কাছে সুন্দরবনের দিকে প্রবেশ করে। এর প্রভাবে উপকূলে ব্যাপক বৃষ্টি হচ্ছে।
যা ছিল পূর্বাভাসে
রাত ৯টার দিকে বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলাগুলোয় যখন জোয়ার থাকবে পূর্ণ মাত্রায় ঠিক তখনই সর্বোচ্চ গতি নিয়ে রেমালের আঘাত হানার কথা আগেই জানিয়েছিলেন কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ক গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ।
রেমালের প্রভাবে পুরো বাংলাদেশেই রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হবে, একথাও জানিয়েছিলেন এই আবহাওয়াবিদ। ফলে ঢাকায় জলাবদ্ধতার আশঙ্কাও করা হচ্ছে।
মোস্তফা কামাল পলাশের তথ্য অনুযায়ী, রেমাল অস্বাভাবিক ধীরগতিতে বাংলাদেশ ছাড়বে। ফলে ঘূর্ণীয়মান মেঘমালা বা ক্লাউড লেন মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বাংলাদেশের উপরে থাকার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। আর এ কারণেই অন্য ঘূর্ণিঝড়গুলোর চাইতে রেমালের প্রভাবে দেশের আট বিভাগেই ব্যাপক বৃষ্টি হতে পারে।
বিপৎসংকেত
সকাল থেকেই রেমালের প্রভাবে উপকূলের বিভিন্ন স্থানে বাতাস-বৃষ্টি শুরু হয়। এসময় পায়রা ও মোংলা সমুদ্র বন্দরকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখাতে বলেছিল আবহাওয়া অধিদপ্তর। এই সংকেতের আওতায় ছিল উপকূলীয় জেলা খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা এবং আশপাশের দ্বীপ ও চরগুলো।
এছাড়া চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ও কক্সবাজারকে ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়। যার আওতায় পড়ে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, চাঁদপুর এবং এসব জেলা সংলগ্ন দ্বীপ ও চর।
জলোচ্ছ্বাসের শঙ্কা
প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমালের কারণে দেশের উপকূলীয় জেলা বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, ঝালকাঠি, ফেনী, নোয়াখালী, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং সংলগ্ন দ্বীপ ও চরগুলোর নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে অন্তত আট থেকে ১২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে, এমন শঙ্কার কথা জানিয়েছিল আবহাওয়া অধিদপ্তর।
কেবল উপকূলই নয়, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে রাজশাহী, রংপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা ও সিলেট বিভাগেও দমকা থেকে ঝড়ো হাওয়াসহ ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টির কথাও বলা হয়েছিল। অতি ভারী বৃষ্টির কারণে কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলের কোথাও কোথাও ভূমিধ্বস হতে পারে, এমন আশঙ্কাও জানানো হয়েছিল।
শঙ্কা নিয়ে দিনভর রেমালের অপেক্ষা
রেমাল আঘাত হানলে কী হবে তা নিয়ে দিনভর বেশ উৎকণ্ঠায় দিন কাটিয়েছেন দেশের মানুষ। বাংলাদেশের মধ্যভাগ ঢাকাতেও আকাশ ছিল মেঘলা। কোথাও কোথাও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিও হয়েছে। বিকালের পর থেকে ছিল দমকা হাওয়ার আনাগোনা।
উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টি হয়েছে, ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটেছেন মানুষ। আবার বিকাল পর্যন্ত রেমাল আঘাত না হানায় অনেকেই ফিরে গেছেন বাড়িতে। যদিও তাদের আবারও বুঝিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে বলে বিভিন্ন স্থান থেকে খবর এসেছে।
খুলনা-চট্টগ্রামের মতো বন্দরনগরীর আকাশও ছিল মেঘলা। প্রবল বৃষ্টির শঙ্কায় সারাদিন কেটেছে নগরবাসীর।
শহরগুলোতেও রেমালের কারণে অতিবৃষ্টির ফলে পানি জমে যেন জলাবদ্ধতা সৃষ্টি না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে স্থানীয় প্রশাসন।
রাতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম রেমাল মোকাবেলায় জরুরি কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। সেখানে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সব ধরনের ছুটি বাতিল করা হয়েছে, দ্রুত পানি নিষ্কাশনে কুইক রেসপন্স টিম প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে, ঝড়ে কোথাও গাছ পড়ে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হলে দ্রুত সময়ের মধ্যে অপসারণসহ নগরবাসীর সব ধরনের সহযোগিতায় সিটি করপোরেশ কর্মীদের এগিয়ে আসতে বলা হয়েছে।
এছাড়াও জরুরি প্রয়োজনে নগরবাসীকে ডিএনসিসির হটলাইন নাম্বার ১৬১০৬ নাম্বারে ফোন করতেও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনও খুলেছে কন্ট্রোল রুম। উপকূলীয় এলাকা থেকে নাগরিকদের সরে যেতে করা হচ্ছে মাইকিং।
সাগরে বেড়েছে পানি, ঝড় দেখতে সৈকতে ভীড়
রেমালের কারণে কক্সবাজারে সাগর যখন উত্তাল, তখন ঝড়ের রূপ দেখতে সমুদ্র সৈকতে ভিড় জমিয়েছিলেন হাজারো মানুষ। এদের মধ্যে কক্সবাজার ঘুরতে যাওয়া পর্যটক যেমন ছিলেন, ছিলেন স্থানীয়রাও।
তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ঝড়ের সময় সাগর দেখতে কেমন হয় সেটাই দেখতে গিয়েছেন তারা। অনেকে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নেমেছেন উত্তাল সমুদ্রে।
অথচ সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে টানানো হয়েছে লাল পতাকা। যার অর্থ, এ মুহূর্তে সমুদ্রে নামা যাবে না।
সী সেফ লাইফ গার্ড সংস্থার কর্মী জয়নাল আবেদীন জানালেন, তারা কাউকে সমুদ্রস্নানে নামতে দিচ্ছেন না। যদিও সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অসংখ্য মানুষ ভীড় করেছেন সৈকতে।
কক্সবাজার আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, সাগরে পানির উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে সাড়ে ৩ ফুট বেড়েছে। ফলে পানি প্রবেশ করেছে সাগর তীরবর্তী এলাকাগুলোয়। পানির উচ্চতা বাড়ায় প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের কয়েকটিও ঢুকে পড়েছে পানি।
নিরাপদে উপকূলের মানুষ
প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের হাত থেকে রক্ষা করতে দেশের উপকূলীয় এলাকার আট লাখের বেশি মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তাদের সহায়তার জন্য প্রস্তুত রয়েছেন কয়েক হাজার স্বেচ্ছাসেবী।
দুপুরে সচিবালয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা শেষে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান জানিয়েছেন, দেশে সব মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।
জোয়ারের সঙ্গে রেমাল মিলে সৃষ্টি হতে পারে জলোচ্ছ্বাস
সকাল থেকে রেমালকে সাগর থেকে সরল রেখায় উপকূলের দিকে এগোতে দেখা গেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলেছিল, পশ্চিমবঙ্গের সাগর দ্বীপ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের পটুয়াখালীর খেপুপাড়া পর্যন্ত এলাকা দিয়ে উপকূলে আঘাত হানতে পারে রেমাল। তখন এর কেন্দ্র থাকবে বাগেরহাটের মোংলায়।
ভারতের আবহাওয়া বিভাগ ও জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টারের রেমালের যে গতিচিত্র দেখিয়েছিল, সেটি অনুযায়ী সাতক্ষীরা দিয়েই প্রবেশ করেছে রেমাল। আগেই সতর্কতা ছিল যে, ঝড়ের মূল ধাক্কাটি যাবে সাতক্ষীরার ওপর দিয়ে।
আগের ঘূর্ণিঝড়গুলোর তুলনায় রেমাল উপকূলের কাছে তৈরি হয়েছে বলে জানালেন ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফিক অ্যান্ড মেরিটাইম ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. মোহন কুমার দাশ। তবে এই কাছাকাছি দূরত্বের পরিমাণও প্রায় ৭০০ কিলোমিটার।
তিনি বলেন, এবারের সাইক্লোন বাতাসের গতিপথের দিক দিয়ে শক্তিশালী না হলেও এটি যেসময় আঘাত হানবে তখন জোয়ারের সম্ভাবনা আছে। বিশেষ করে মেঘনার মোহনায়। জোয়ারের সময়ের সঙ্গে যদি রেমালের আঘাতের সময় মিলে যায় তাহলে এখন পর্যন্ত যে পূর্বাভাস আছে সে অনুযায়ী তিন মিটারের বেশি জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। সম্ভাবনার কথা বললে, মেঘনার মোহনা ও এর আশপাশের এলাকায় বড় ধরনের জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি হতে পারে।
বন্দরে বন্দরে সতর্ক দৃষ্টি
রেমালের ঝুঁকি থেকে বাঁচতে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে নিজস্ব অ্যালার্ট-৪ জারি করেছে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দরের ভেতরে ও বাইরে পণ্য ওঠানামার সব ধরনের কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে।
বন্দরের ভেতর জেটিতে থাকা জাহাজগুলোকে বহির্নোঙরে নিরাপদে চলে যেতে বলেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। আর বহির্নোঙরে থাকা সব ধরনের জাহাজকে নিরাপদে থেকে ইঞ্জিন সচল রাখতে বলেছে।
এছাড়া জেটি ও টার্মিনালে থাকা বড় যন্ত্রগুলোকে গুটিয়ে ঝুঁকি থেকে বাঁচার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যা এরই মধ্যে কার্যকর করা হয়েছে।
একইভাবে মোংলা বন্দরেও স্থগিত রাখা হয়েছে সব কার্যক্রম।
মোংলা বন্দরের বর্হিনোঙ্গরে ছয়টি জাহাজ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে দুটি গ্যাসবাহী, অন্য চারটিতে আছে সিমেন্ট তৈরীর কাঁচামালসহ অন্য মালামাল।
দেশের আরেক সমুদ্র বন্দর পায়রায় থাকা সব জলযানকেও নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বন্ধ রয়েছে সব কার্যক্রম।
রেমালের কারণে সব ধরনের উড়োজাহাজের ওঠানামা বন্ধ ঘোষণা করেছে চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। রবিবার বেলা ১২টা থেকে সোমবার ভোর ৫টা পর্যন্ত এই বিমানবন্দরের সব কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ রাখা হয়েছে।
মোংলায় ট্রলারডুবি
ঘুর্ণিঝড়ের সতর্কবার্তার মধ্যে যখন উপকূলীয় এলাকায় নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণার মধ্যেই অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে সকালে পশুর নদী পারাপারে নেমেছিল একটি ট্রলার। ঘাটের কাছাকাছি স্থানেই সেটি ডুবে যায়। তবে এ ঘটনায় কেউ হতাহত হয়নি, নিখোঁজও নেই কোনও যাত্রী।