সরকার পতনের পর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হচ্ছে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে; কিন্তু এই বিচার যেখানে চলবে, সেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হয়ে আছে অচল।
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত এই ট্রাইব্যুনালে এখন বিচারক আছে মোটে একজন, যেখানে তিনজন থাকার কথা।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন বিভাগে কেউ নেই, এখন পুরোটাই শূন্য। তদন্ত সংস্থার জনবলও নেমেছে অর্ধেকে।
একাত্তর সালে সংঘটিত হত্যা, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালে প্রণীত আইনের অধীনে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
আওয়ামী লীগ সরকার আমলে ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠার পর ১৪ বছরে এই ট্রাইব্যুনাল থেকে এসেছে ৫৫টি মামলার রায়। এর মধ্যে সর্বোচ্চ আদালত পেরিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াত-বিএনপির ছয় নেতার ফাঁসিও কার্যকর হয়েছে।
তবে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সেই ট্রাইব্যুনালেই এখন গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও তার প্রশাসনের কর্মকর্তাদের।
জুলাই-আগস্ট সময়ে আন্দোলন দমনে সরকারি বাহিনীর গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে যেমন মামলা হচ্ছে, আবার ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ পণ্ডের ঘটনার মামলাও হয়েছে।
বুধবার নাগাদ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় মোট সাতটি অভিযোগ জমা পড়েছে বলে কর্মকর্তাদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া গেছে।
এই আদালতে এসব মামলার বিচারের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলছেন, তারা আইনটি খতিয়ে দেখে বুঝেছেন এই ট্রাইব্যুনালে এবারের ঘটনার বিচারও সম্ভব।
১ জন মাত্র বিচারক
২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছিল হাইকোর্ট বিভাগের তিন বিচারককে নিয়ে। তদন্ত শেষে বিচারে আসা মামলার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় দুই বছর পর ২০১২ সালের ২২ মার্চ আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়।
এরপর দুজন বিচারপতির নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ ও ২ নাম নিয়ে কার্যক্রম চলতে থাকে।
অনেকগুলো মামলার রায় হয়ে যাওয়ায় ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দুটি ট্রাইব্যুনালকে একীভূত করে পুনরায় একটি করা হয়।
এরপর একটি ট্রাইব্যুনালেই বিচার চলছিল। তাতে চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম, সদস্য ছিলেন বিচারপতি আবু আহমেদ জমাদার ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলম।
বিচারপতি শাহীনুর ইসলাম হাইকোর্ট বিভাগ হয়ে আপিলে বিভাগে চলে গেলে বিচারপতি আবু আহমেদ জমাদার চেয়ারম্যান হন। সদস্য হিসাবে নতুন আসেন বিচারপতি এ এইচ এম হাবিবুর রহমান।
গত ১৩ জুন অবসরে যান বিচারপতি আবু আহমেদ জমাদার। এরপর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন বিচারপতি হাফিজুল আলম। এরপর তাকেও হাইকোর্ট বিভাগে ফেরানো হলে এখন কেবল বিচারপতি হাবিবুর রহমানই ট্রাইব্যুনালে রয়েছেন।
ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার এম এল বি মেছবাহ উদ্দিন আহমেদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এই মুহূর্তে ট্রাইব্যুনালে বিচারক সংকট থাকায় বিচার কাজ বন্ধ রয়েছে। তবে প্রশাসনিক কাজ চলছে।”
প্রসিকিউটর কেউই নেই
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিম গঠিত হয়েছিল প্রবীণ আইনজীবী গোলাম আরিফ টিপুর নেতৃত্বে। তিনি মারা যাওয়ার পর এই টিমে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন হায়দার আলী।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিমে বিভিন্ন সময়ে যোগ-বিয়োগ হয়েছে। সর্বশেষ ছিলেন ১৩ জন।
প্রসিকিউশন দলে নিয়োগ হয় সরকার থেকে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ১৩ জন প্রসিকিউটরের সবাই একযোগে পদত্যাগ করেছেন।
নতুন করে প্রসিকিউটর নিয়োগ দেওয়া ছাড়া পুরনো মামলার বিচার পরিচালনা করাও যাচ্ছে না, বলেছেন ট্রাইব্যুনাল সংশ্লিষ্টরা।
তদন্ত সংস্থা অর্ধেক
আব্দুল হান্নানকে প্রধান করে গঠিত হয় যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। তিনি মারা যাওয়ার পর সানাউল হক তদন্ত সংস্থার সমন্বয়কের দায়িত্বে আসেন। এখন তিনিও নেই।
মঙ্গলবার ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার অফিসে গিয়ে পাওয়া যায় তদন্ত কর্মকর্তা আতাউর রহমানকে।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, তদন্ত সংস্থায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া সাতজন কর্মকর্তা এরই মধ্যে বিদায় নিয়েছেন। এখন সমন্বয়কসহ বেশ কয়েকটি পদ শূন্য রয়েছে।
তদন্ত সংস্থায় মোট ১৪ জন সদস্য ছিলেন। সাতজন চলে যাওয়ায় এখন বাকি সাতজন রয়েছেন।
আতাউর বলেন, ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট অবধি সারাদেশে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে এবং ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে সংঘটিত গণহত্যার অভিযোগে মামলার আবেদনগুলো পেয়ে এখন যাচাই করছেন তারা।
“আমরা প্রাথমিকভাবে তদন্ত করার পর ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন হলেই গ্রেপ্তারের আবেদন করব। তবে তার আগে তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক, সহ সমন্বয়কসহ তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা দরকার।”
এক মামলার আইনজীবী গাজী এম এইচ তামিম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, দুটি সময় ধরে অভিযোগ এসেছে। সেক্ষেত্রে এবছরের জুলাই এবং আগস্ট মাসে সংঘটিত সবগুলো অভিযোগ একত্রে এবং ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে অপরাধের একত্রে বিচার করা যায়। তাহলে সারাদেশে সবগুলো মামলা একত্রে দুটি মামলায় নিয়ে তদন্ত হবে।
ট্রাইব্যুনালে যত বিচার
ট্রাইব্যুনাল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যুদ্ধাপরাধের দায়ে ট্রাইব্যুনাল থেকে মোট ১৫১ জনের সাজার রায় হয়। শিশু বয়স বিবেচনায় একজনকে এবং সার্বিক বিবেচনায় একজনকে খালাস দেওয়া হয়।
সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের অর্ধেকই পলাতক। বন্দি হয় ৮১ জন। তার মধ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় ছয়জনের।
বর্তমানে আপিল বিভাগে বিচারাধীন আছে ৫৩ আসামির আপিল। আর ট্রাইব্যুনালে চলমান রয়েছে ৩০টি মামলার বিচার।
২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি পলাতক আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির রায়ের মধ্য দিয়ে ট্রাইব্যুনালে রায় দেওয়া শুরু হয়। ওই বছরে দুটি ট্রাইব্যুনাল থেকে মোট ৯টি রায় হয়।
এরপর ২০১৪ সালে ৬টি, ২০১৫ সালে ৬টি, ২০১৬ সালে ৬টি, ২০১৭ সালে ২টি, ২০১৮ সালে ৬টি, ২০১৯ সালের ৬টি এবং ২০২১ সালে ২টি, ২০২২ সালে ৬টি ও ২০২৩ সালে ৫টি, ২০২৪ সালে আগাস্ট নাগাদ ১টি মামলার রায় হয়েছে। কোভিড মহামারীর মধ্যে ২০২০ সালে ট্রাইব্যুনাল থেকে কোনও মামলার রায় আসেনি।