Beta
শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৫
বিশ্ব মা দিবস ২০২৪

জাহানারা বেগম দরজা খুলুন

জাহানারা বেগম। আলোকচিত্র লেখকের সৌজন্যে।

অক্ষরের সাথে পরিচয় তিনিই করিয়েছেন। ‘আ’-কার, ‘ই’-কার, ‘উ’-কার এসবও তিনিই শিখিয়েছেন। যে বইটি স্কুলে ভর্তি হবার আগেই আমাকে পড়তে হয়েছে তার নাম ‘বাল্যশিক্ষা’। বইয়ের নাম আর লেখকের নাম একাকার হয়ে যাওয়াতে তখন বলা হতো ‘রামসুন্দর বসাকের বাল্যশিক্ষা’। ১৯৬৩-র জুনে ঢাকা শহরের বেসরকারি রোটারি প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হই, বাংলা বই হিসেবে হাতে নিই ‘ছড়া ও পড়া’। কিন্তু তার আগেই ‘বাল্যশিক্ষা’ পড়ে আমি ‘সাক্ষর’ হয়ে উঠি; নামটা বেশ লিখতে পারি বানান করে পড়তেও পারি। 

স্কুলে ভর্তি হবার আগের সেই দিনগুলোর একদিন খাকি প্যান্ট ও খাকি ফুলশার্ট পরা ঘাড়ের উপর দিয়ে পিঠে ঝোলানো ব্যাগ নিয়ে ডাকপিয়ন দরজায় কড়া নাড়েন। তখনো ঢাকার সব এলাকার ডাকপিয়ন বাইসাইকেল পান নি। আর তখনো আমাদের ঘরের দরজায় কলিং বেল লাগেনি। কেবল আমাদের নয়, আশেপাশের অবস্থাপন্ন বাড়িগুলোতেও কলিং বেল ছিল না। কলিং বেল এসে কড়া নাড়ার ঐতিহাসিক গুরুত্ব হ্রাস করেছে।

দরজা খুলে চিঠি নিই। পাকিস্তান ডাক বিভাগের হলুদ খামের উপর প্রাপকের নাম ঠিকানা। আমার সদ্য উপার্জিত জ্ঞানের প্রয়োগ করে নামটার অর্ধেক পড়ে ফেলি—

অক্ষরগুলোর সাথে কেবলই ‘আকার’। সুতরাং চিঠি নিয়ে ছুটতে থাকি আর বলতে থাকি: জাহানারা, জাহানারা, জাহানারা,…।

ছেলের মুখে তিনি আম্মা শুনেছেন, মা শুনেছেন কিন্তু আগে কখনো জাহানারা শোনেননি। তিনি জানেন চিঠিটা কার কাছ থেকে এসেছে।

এসেছে তার বাবার কাছ থেকে— আমার নানা পাঠিয়েছেন। তিনি বলছেন, চিঠি দে, আর আমি এদিক ওদিক ছুটছি আর ডাকছি: জাহানারা, জাহানারা। ছেলেকে ‘বিদ্বান’ বানিয়ে আমার আম্মা বিপদে পড়ে গেলেন, ছেলে তাকে নাম ধরে ডাকে!

গুস্তাভ ক্লিম্ৎ-এর মা ও শিশু

আমিই প্রথম সন্তান। প্রথমটা বিদ্বান হলে পরেরগুলো এমনিতেই বিদ্বান হয়ে উঠবে। সুতরাং তার সাধ্যে যতোটা কুলোয় তিনি আমার মধ্যে বিদ্যে ঢুকিয়ে দিতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। নাম ধরে ডাকার দিনই আমার আম্মার শিক্ষা হওয়া উচিৎ ছিল যে ছেলেকে পণ্ডিত বানালে, ছেলে তার উপরই পাণ্ডিত্য ফলাবে, তাকে ঢের খেসারত দিতে হবে। কিন্তু জগত জুড়েই মায়েদের কখনো শিক্ষা হয় না। তারা ছেলেমেয়েদের শিখিয়ে পড়িয়ে পণ্ডিত বানান এবং ক্রমাগত খেসারত দিতেই থাকেন।

আম্মা বললেন, মাকে নাম ধরে ডাকতে নেই।
কেনো?
তাহলে গুনাহ হয়!

গুনাহ এবং সওয়াব সম্পর্কে ততদিনে আমার একটা নিজস্ব ধারণা তৈরি হয়ে গেছে। সওয়াব হলে বেহেশতে যাবো এবং আঙুর খেয়ে জীবন কাটাবো, মখমলের বিছানায় ঘুমাবো, আর গুনাহ হলে তো ভয়ঙ্কর অবস্থা, শরীরে আগুন ধরে যাবে, গায়ে ফোস্কা পড়বে।

আমি বললাম, তা হলে তো আমার নানা এবং আমার আব্বারও অনেক গুনাহ হবে কারণ তারাও তো এ নামেই আমার মাকে ডাকেন।
আম্মা বললেন, বাবা মেয়েকে নাম ধরে ডাকতে পারে। আর তোমার আব্বা যেহেতু ‘তোমার আব্বা’ সে জন্য আমাকে নাম ধরে ডাকলেও গুনাহ হবে না।

‘যেহেতু আমার আব্বা!’ কিন্তু আম্মার সাথে তার সম্পর্কটা কি মোটেও স্পষ্ট হলো না। সে বয়সে স্পষ্ট না হওয়াই ভালো।

বুগেরুর মা ও শিশু

আমি মেনে নিলাম, যেহেতু আমি আঙুর খেতে চাই তাই আমাকে বেহেশতেই যেতে হবে, সুতরাং নাম ধরে ডেকে গুনাহ কামাই করবো না। আমার এই বোধোদয়কে তিনি হৃষ্টচিত্তে গ্রহণ করলেন এবং বললেন, এ জন্যই, মানে আমি যে মায়ের কথা শুনি, সে কারণেই তিনি আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসেন।

মায়ের কথা শোনে এবং মেনে চলে এমন দু’জন বালকের কথাও তখন শোনালেন। তাদের একজন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অন্যজন হযরত আবদুল কাদের জিলানী। মায়ের দোয়া পেয়েছেন বলেই তারা এতো বিখ্যাত হয়েছেন।

অগত্যা আমি মুখে মুখে বিদ্যালাভের প্রমাণ দেওয়া বন্ধ করে খাতাকলম হাতে নিলাম। এক পৃষ্ঠার জায়গায় তিন পৃষ্ঠা বাংলা লিখে আম্মাকে আরো সন্তুষ্ট করে তার শুভেচ্ছাসহ বেহেশতে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার চেষ্টা চালালাম।

আমার লেখা দেখে আম্মা ‘থ’। হয়ত আমাকে মারতেই চেয়েছিলেন কিন্তু তা না করে কেঁদে ফেললেন। তার ভেজা চোখ দেখে আমিও ‘থ’। কিন্তু আমি ভুল কি কিছু করেছি?

নাম ধরে মাকে ডাকলে গুনাহ হবে তাই আমি খাতার তিন পৃষ্ঠা নিঃশব্দে লিখেছি : জাহানারা জাহানারা জাহানারা।

আমি নিশ্চিত হতে চাই হাজার বারও যদি মায়ের নাম লিখি যদি খাতা তার নাম দিয়ে ভরিয়েও ফেলি আমার গোনাহ হবে না।

মাকে নিয়ে এই ছোট্ট এপিসোডটি যখন লিখি তখন হঠাৎ মনে হলো, তা হলে আমি কি সেই দিন থেকেই লেখক যেদিন গুনাহ এড়াতে মুখে না বলে মায়ের নাম কাগজে লিখতে শুরু করলাম!

মাকে নিয়ে এই ছোট্ট এপিসোডটি যখন লিখি তখন হঠাৎ মনে হলো, তা হলে আমি কি সেই দিন থেকেই লেখক যেদিন গুনাহ এড়াতে মুখে না বলে মায়ের নাম কাগজে লিখতে শুরু করলাম!

সেদিন আম্মা কেনো কেঁদেছিলেন ছেলের জন্য না নিজের জন্য? নাকি দু’জনের জন্যই? ছেলেটা একটা আস্ত শয়তান, সরাসরি মায়ের আদেশ অমান্য না করে, অমান্য করার একটা বিকল্প পথ খুঁজে বের করেছে! মুখে না বলে কাগজে লিখছে। ঈশ্বরচন্দ্র কি কখনো এমন অবাধ্য হয়েছেন? কিংবা হযরত আবদুল কাদির জিলানী?

নাকি তিনি একসাথে এতো বেশি সংখ্যক জাহানারা দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েছেন? তিনি নিশ্চয়ই ভেবেছেন পুচকে এক রত্তি ছেলে যখন মায়ের আদেশ সরাসরি অমান্য না করে বিকল্প পথে করতে শিখেছে নিশ্চয়ই ভবিষ্যতেও এমন করবে, দোযখের দরজায় এসে বাইপাস রোড নিজেই বের করে নিয়ে ঐ জায়গাটা এড়িয়ে যেতে পারবে। যে ভাবনা থেকেই হোক সন্তানের জন্য মায়ের অশ্রু অনিবার্য, তা মঙ্গলই ডেকে আনে।

ক্লদ মনে-র মা ও শিশু

শামসুর রাহমানের কবিতা— ‘‘কখনো আমার মাকে কোনো গান গাইতে শুনিনি।’’ আমি আমার আম্মাকে ছড়াগান তো বটেই এমনকি গুন গুন করে ‘‘মধুমালতী ডাকে আয় ফুল ফাগুনের এ খেলায়’’ গাইতেও শুনেছি। একই কণ্ঠে শুনেছি ‘‘ফাবি আইয়ি আলা ইরাব্বিকু মা তুকাজ্জিবান।’’

পুরুষশাসিত সমাজে আমাদের মায়েরা যতোটা অসহায় ছিলেন বলে ফেমিনিস্ট ব্যাখ্যায় প্রতিভাত তার পুরোটা হয়ত সত্যি নয়। অত্যন্ত অনুগত বাধ্যগত স্ত্রী আমার আম্মার প্রথম নীরব বিদ্রোহ আমাকে ঘিরেই। আমার তখন স্কুলে ভর্তি হবার সময় এসে গেছে। কোনো একদিন কোনো এক বিশিষ্টজনের ওয়াজ শুনে এসে আব্বা বললেন, ছেলেকে মাদ্রাসায় ভর্তি করাবেন।
আমার আম্মা বললেন, না প্রশ্নই আসে না।
আমার আব্বার মুখের উপর এটাই তার প্রথম না। প্রথম নিরস্ত্র বিদ্রোহ।

পুরুষশাসিত সমাজে আমাদের মায়েরা যতোটা অসহায় ছিলেন বলে ফেমিনিস্ট ব্যাখ্যায় প্রতিভাত তার পুরোটা হয়ত সত্যি নয়। অত্যন্ত অনুগত বাধ্যগত স্ত্রী আমার আম্মার প্রথম নীরব বিদ্রোহ আমাকে ঘিরেই। আমার তখন স্কুলে ভর্তি হবার সময় এসে গেছে। কোনো একদিন কোনো এক বিশিষ্টজনের ওয়াজ শুনে এসে আব্বা বললেন, ছেলেকে মাদ্রাসায় ভর্তি করাবেন। আমার আম্মা বললেন, না প্রশ্নই আসে না। আমার আব্বার মুখের উপর এটাই তার প্রথম না। প্রথম নিরস্ত্র বিদ্রোহ।

আব্বা কর্মজীবনের শুরুতে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে কিছুদিন চাকরি করেছেন, করাচিতে। তারপর বেসামরিক সরকারি চাকরি নিয়ে ঢাকায়। ১৯৪৬-এর ম্যাট্রিকুলেট, একজীবনে নাটক করেছেন, পাকিস্তান আন্দোলন করে তিন দিন জেলও খেটেছেন। পঞ্চাশের দশকের বড় ফুটবল দল ‘বিজি প্রেস’-এর নিয়মিত ডিফেন্ডার মোতালেব-ই আমার আব্বা— এ এফ এম আবদুল মোতালেব। সেকালের ঢাকায় অনেক বিশিষ্টজন তার পরিচিত। ঢাকা শহরের যে অঞ্চলে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা সেই রাজাবাজারে তিনি বেশ সালাম পেয়ে থাকেন।

এ এফ এম আবদুল মোতালেব বললেন, আমার ছেলে আমি বুঝবো।
তার স্ত্রী জাহানারা বেগম বললেন, না, আমারও ছেলে। আমিও বুঝতে চাই।

শীতল যুদ্ধ চলল প্রায় ছয় মাস, বছরের মাঝামাঝি সময়ে তারই ‘ষড়যন্ত্রে’ তার বাবা, মানে আমার নানা, তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের একটি প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার, ঢাকায় এলেন। আমাকে গাঁটের পয়সা খরচ করে স্কুলে ভর্তি করে দিলেন এবং বছরের বাকি সময়ের বেতন ও আনুষঙ্গিক কিছু খরচও আম্মার হাতে তুলে দিলেন।

আমার আব্বা এটাতে পরাজয় হিসেবে না নিয়ে বললেন, আর একটা ছেলে হোক, তাকে মাদ্রাসায় পাঠাবো। কিন্তু আর একটি ছেলে হবার আগে আমার আরো তিনটি বোন হলো, ততোদিনে আমার আব্বার মাথা থেকে মাদ্রাসার পাঠ বিদায় নিয়েছে।

আমি এবং আমার ভাইবোনেরা ঢাকার শ্রেষ্ঠ স্কুল ও কলেজে পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছি অনেকটাই আম্মার কারণে।

আমার প্রাইমারি স্কুল জীবনের পড়াশোনায় আম্মা বেশ সাহায্য করতে পেরেছেন। ক্রমেই টের পেতে শুরু করি আম্মার দৌড় শেষ হয়ে আসছে, তিনি কখনো অ্যালজেব্রা পড়েননি, জ্যামিতি জানেন না, জটিল অঙ্ক পারেন না, ইংরেজি জ্ঞান খুব সীমিত— আমাকে হাতেখড়ি দেওয়া শিক্ষক আস্তে আস্তে আমাকে তার মুঠোর ভেতর থেকে ছেড়ে দিচ্ছেন— আমরা ভাগ্যবান, রিলে রেইসের ব্যাটনের মতো আব্বা ঠিক সেখানেই ব্যাটনটা তুলে নিয়েছেন, এবার তিনি আমাদের পড়াবেন।

মেট্রোপলিটান ঢাকা শহরে গ্যাসের চুলা সংযোজন তো সেদিনের ব্যাপার। লাকড়ির চুলাতেই রান্না হতো— এমনই একটি দৃশ্য আমার চোখে ফ্রিজড্ হয়ে আছে— আম্মার কোলে আমার বোন, এক হাতে  লোহার চুঙ্গি— চুলায় ফু দিচ্ছেন, ধোয়ার কারণে সৃষ্ট চোখের পানি অন্যহাতে মুছছেন, চুঙ্গি রেখে হাতের এক পাশে বড় কৌটার উপর রাখা বইয়ের পাতা উল্টে পড়তে শুরু করেছেন। নিঃসন্দেহে সেই বই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কোনো একটি উপন্যাস। মৃত্যুর দু’দিন আগেও খরের কাগজ প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটাই পড়েছেন। ক্যাটারেক্ট অপারেশনে রাজি হচ্ছিলেন না, যখন জানলেন বই পড়তে সুবিধে হবে সম্মত হলেন।

আমার আব্বা খুব গর্ব করে তার কয়েকজন পিএইচডি ডিগ্রিধারী বন্ধুর কথা বলতেন। তাদের একজন ডক্টর কুদ্দুস। ১৯৯৬ সালে বিলেত থেকে পিএইচডি নিয়ে আমিও ফিরলাম। বাধাই করা থিসিসটা আম্মাকে দিয়ে বললাম, এটার জন্যই ডিগ্রি পেয়েছি। আম্মা পাতা উল্টালেন এবং আবেগাপ্লুত স্বরে বললেন, তোরা তো কেউ আমাকে ইংরেজিটা শেখালে পারতি, তাহলে আমি পুরোটা পড়তে পারতাম। যাক এখন যদি তোর আব্বার ডক্টরেট বন্ধুদের গল্পটা একটু কমে!

আমার আম্মার সন্তানদের কেউ কেউ আমাকেও ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা কেউই ইংরেজি না জানা, জ্যামিতি না জানা আম্মাকে ছাড়িয়ে যেতে পারিনি, কোনোভাবেই না, কোনো কিছুতেই না।

আমার আব্বা খুব গর্ব করে তার কয়েকজন পিএইচডি ডিগ্রিধারী বন্ধুর কথা বলতেন। তাদের একজন ডক্টর কুদ্দুস। ১৯৯৬ সালে বিলেত থেকে পিএইচডি নিয়ে আমিও ফিরলাম। বাধাই করা থিসিসটা আম্মাকে দিয়ে বললাম, এটার জন্যই ডিগ্রি পেয়েছি। আম্মা পাতা উল্টালেন এবং আবেগাপ্লুত স্বরে বললেন, তোরা তো কেউ আমাকে ইংরেজিটা শেখালে পারতি, তাহলে আমি পুরোটা পড়তে পারতাম। যাক এখন যদি তোর আব্বার ডক্টরেট বন্ধুদের গল্পটা একটু কমে!

১৯৭১-এর অক্টোবরে আমাদের বাসার সবকিছু লুট হয়ে গেল। কারা লুট করেছে আমাদের অজানা নয়, কিন্তু বিস্মিত হয়ে জানতে পারি তারা পোশাক বদলে ফেলেছে, রাজনৈতিক কোট পরতে শুরু করেছে, আমরা তাদের ‘সিক্সটিন্থ ডিভিশন’ বললেও তারা সনদ-টনদ যোগাড় করে নিয়েছে। একেবারে শূন্য থেকে আবার আম্মাকেই সংসারের হাল ধরতে হয়। আমাদের জীবনের একটা ভয়াবহ কাল চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ— আম্মা যে কতোবেলা না খেয়ে থেকেছেন তিনিই বলতে পারবেন।

সময় দ্রুত বদলাতে শুরু করল। আমার আর পড়াশোনা করতে ইচ্ছে করছে না— সমাজতন্ত্রের ভুয়া বুলি দিয়ে আর কতোদিন? রাত করে বাসায় ফিরি। আব্বা হুকুম দিলেন, বাসায় ঢুকতে দিও না।

একরাতে বেশ দেরিতে ফিরেছি। দরজায় টোকা দিলে আব্বার মুখোমুখি হয়ে যেতে পারি। আম্মা বলে ডাক দিলে আম্মাও আব্বার বকা খেতে পারেন। আমি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে বলি, জাহানারা বেগম দরজা খুলুন। আমার বিড়বিড় এতোই অস্পষ্ট কারোই শোনার কথা নয়। কিন্তু আমিও বিস্মিত, আস্তে করে দরজা খুলে গেল। ফিস ফিস করে আম্মা বললেন, তোর টেবিলে ভাত রাখা আছে। শব্দ করিস না, খেয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়। তোর আব্বা  যেন টের না পায়।
খেয়ে আমি চুপচাপই শুয়ে পড়ি।
সে রাতেই হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায়, দরজা খোলার শব্দ শুনি। আব্বার গলাও শোনা যায়— শয়তানটা এখনো ফেরেনি? দিনকাল খারাপ, কখন কি হয়? টেনশন হচ্ছে।
তার মানে আব্বা চাচ্ছেন আমি বাসায় ফিরে আসি!
আমি ঝিম মেরে পড়ে থাকি।
আমি আম্মার কণ্ঠ শুনতে পাই, আব্বাকে বলছেন, একটুখানি মিথ্যে মিশিয়ে, অনেক আগেই তো এসেছে। ঘুমাচ্ছে।(আমি এখন ভাবি এই হচ্ছে মা)।
আব্বার কণ্ঠ শুনি: তাই নাকি? আলহামদুল্লিাহ।
(আমি এখন আরো ভাবি এই হচ্ছে বাবা)।

লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির মা ম্যাডোনা

১৯৯৯ সালে আমার আব্বা বিদায় নিয়েছেন, ২০১৫-তে আম্মা।

২০২০-র লকডাউন চলছে। গৃহবন্দী জীবন কাটছে আমাদের। এক রাতে স্বপ্নে কড়ানাড়ার শব্দ শুনতে পাই, দরজা খোল্।

আমার দরজায় তো কড়া নেই, কলিং বেল আছে। তাহলে কড়ানাড়ার শব্দ হচ্ছে কেনো? আমি দরজা খুলি।
দরজায় দাঁড়িয়েই আমার আম্মা জাহানারা বেগম কলাপাতা রঙ্গের অনেকগুলো মাস্ক তার শাড়ির কোচড় থেকে বের করে আমার হাতে দিলেন, বললেন, সেই শাড়িটা কেটে বানিয়েছি। সবার কাজে লাগবে, তুই সবাইকে মাস্কগুলো ভাগ করে দিয়ে আসবি।

সেই শাড়ি ১৯৭০ সালে আমার আব্বা কিনে দিয়েছিলেন, কিন্তু তাদের দাম্পত্য-সম্পর্কের কোনো অভিমানের কারণে আম্মা শাড়িটা এক দিনের জন্যও পরেন নি।
আমি মাস্ক হাতে নিয়ে বলি, আচ্ছা।
কী আশ্চর্য! আমি আম্মাকে ঘরে আসতে বলিনি, কিছু খেতে বলিনি। ছেলেরা এমনই হয়।

তারপরও আম্মা অদ্ভুত তৃপ্তির একটি হাসি দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে কোথায় যে বিলীন হয়ে গেলেন! কিন্তু আম্মার ঘ্রাণটা রয়েই গেলো।
আমারও ঘুম ভেঙ্গে গেল।

***

এখন প্রায়ই আমি আম্মাকে ডাকি। অবাধ্য সন্তান, প্রতিশ্রুতি ভুলে গিয়ে নাম ধরেই বলি, জাহানারা বেগম দরজা খুলুন।

কিন্তু কোন ঘরের দরজা খুলবেন?

২০১৫ সালে আমি নিজেই আম্মাকে আজিমপুর গোরস্তানে শুইয়ে রেখে এসেছি। এর মধ্যে কতো কী যে ঘটে গেছে। আম্মা কি সেসব জানেন?

আম্মা যেখানেই থাকুন না কেনো আমার জন্য দরজা না খুলে পারবেন না। বলবেন, শব্দ করবি না, চুপ করে ঢুকে পড়।আসছি আম্মা। আমি চুপচাপ চলে আসবো, আব্বা টের পাবেন না।।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক।
ইমেইল: momen98765@gmail.com

আন্দালিব রাশদী। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার
ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত