ফারাক্কা ব্যারেজের ফটকগুলো খুলে দেওয়ার পর বাংলাদেশে পদ্মা নদীতে পানির সমতল বাড়লেও তা এখনও বিপৎসীমার অনেক নিচে রয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশে সমালোচনা ওঠার প্রেক্ষাপটে ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বর্ষা মৌসুমে ফারাক্কা ব্যারেজের সব ফটক খোলা ‘স্বাভাবিক’।
অভিন্ন নদী গঙ্গার ওপর পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় ভারত ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মাণের পর বাংলাদেশকে ভুগতে হচ্ছে। ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বণ্টনে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হলেও বাংলাদেশ শুষ্ক মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি পায় না।
এবার বর্ষায় ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরা থেকে নেমে আসা ঢলে বাংলাদেশের কুমিল্লা-ফেনী তলিয়ে যাওয়ার পর ভারতের সমালোচনা হচ্ছে। তারমধ্যে ফারাক্কার সব ফটক খুলে দেওয়ার পর পশ্চিমাঞ্চলেও বন্যার আশঙ্কা দেখে নতুন করে ভারতের সমালোচনা হচ্ছে।
হিমালয় থেকে আসা গঙ্গা নদী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলায় পাংখা পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পদ্মা নদী নাম নেয়। পদ্মা আরও এগিয়ে যমুনার সঙ্গে মেলার পর মিলিত স্রোত মেঘনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে।
বর্ষার মধ্যে টানা বৃষ্টিতে ভারতের বিহার ও ঝাড়খণ্ডে বন্যার জেরে ফারাক্কা ব্যারাজের ১০৯টি ফটক সম্প্রতি খুলে ভারত খুলে দেয়। এই ব্যারেজের সব গেইট খুলে দেওয়া হলে ১১ লাখ কিউসেকের বেশি পানি পদ্মায় যুক্ত হবে বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র মঙ্গলবার সকালে বিভিন্ন নদীর পানি সমতলের যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে গত ২৪ ঘণ্টায় গঙ্গায় পানি বাড়ার চিত্র ফুটে উঠেছে।
পাংখা পয়েন্টে পানির সমতল ৭ সেন্টি মিটার বেড়েছে, রাজশাহী পয়েন্টে বেড়েছে ২ সেন্টি মিটার। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানির সমতল না বাড়লেও তালবাড়িয়া পয়েন্টে ১ সেন্টি মিটার বেড়েছে।
পদ্মা নদীর গোয়ালন্দ, ভাগ্যকূল, মাওয়া ও সুরেশ্বর পয়েন্টে পানি উল্টো কমেছে।
বাংলাদেশে গঙ্গা ও পদ্মার পানি কোথাও বিপৎসীমার কাছাকাছি নেই। পাংখায় বিপৎসীমার ১৫০ সেন্টি মিটার নিচে, রাজশাহী পয়েন্টে ১৭৫ সেন্টি মিটার নিচে, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে ১৮২ সেন্টি মিটার নিচে, তালবাড়িয়া পয়েন্টে ১৬৩ সেন্টি মিটার নিচে রয়েছে।
গোয়ালন্দ, ভাগ্যকূল, মাওয়া ও সুরেশ্বর পয়েন্টেও পদ্মার পানি বিপৎসীমার যথাক্রমে ১৩২, ১৪৬, ১৪০ ও ১২০ পয়েন্ট নিচে রয়েছে।
বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের সদস্য ড. মোহাম্মদ আবুল হোসেন মঙ্গলবার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, পানি যেটুকু বেড়েছে, তাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই।
“গত ১৭ তারিখে যে পরিমাণ পানি ছিল। সেরকমই আছে। এনিয়ে চিন্তার কোনও কারণ নেই। বন্যা হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই।”
ফারাক্কা ব্যারেজের ফটকগুলো খুলে দেওয়া নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল সোমবার দিল্লিতে সাংবাদিকদের বলেন, ফারাক্কা ব্যারেজের সব গেইট খোলা বর্ষা মৌসুমে ‘স্বাভাবিক ঘটনা’।
“সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন আমাদের চোখে পড়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ফারাক্কার গেইট খুলে দিলে নদীর ভাটিতে থাকা গঙ্গা/পদ্মা নদীর স্বাভাবিক প্রবাহপথে ১১ লাখ কিউসেকের বেশি পানি যুক্ত হবে।
“এটি বর্ষা মৌসুমের স্বাভাবিক ঘটনা। এসময় ভারি বৃষ্টিতে উজানে থাকা গঙ্গা নদীর অববাহিকায় পানির প্রবাহ বেড়ে যায়। এর ফলে গঙ্গা/পদ্মা নদীর স্বাভাবিক প্রবাহপথে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পায়।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের বুঝতে হবে, ফারাক্কা বাঁধ নয়, ব্যারেজ। এটি কেবল একটি কাঠামো, যা ফারাক্কা খালে ৪০ হাজার কিউসেক পানি সরানোর জন্য নির্মিত। মূল নদী গঙ্গা/পদ্মার ওপর গেইটের সাহায্যে সতর্কতার সঙ্গে এই পানি সরানোর কাজ করা হয়। এসময় বাড়তি পানি মূল নদীতে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে চলে যায়।”
প্রটোকল অনুযায়ী পানিপ্রবাহের তথ্য ঠিক সময়ে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট যৌথ নদী কমিশনের কর্মকর্তাদের জানানো হয় দাবি করে জয়সোয়াল বলেন, “এবারও এর ব্যত্যয় ঘটেনি।”
অভিন্ন নদী নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সমস্যা দীর্ঘ দিনের। এবিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য ভারতের কাছ থেকে কখনও পাওয়া যায় না বলে বাংলাদেশের যৌথ নদী কমিশনের কর্মকর্তাদের অভিযোগ।
সম্প্রতি ত্রিপুরায় ডম্বুর বাঁধে আটকে থাকা পানি ছেড়ে দেওয়ার আগেও ভারত কোনও তথ্য দেয়নি বলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়।
এবার ফারাক্কার ফটক খোলার আগেও বাংলাদেশকে জানানো হয়নি বলে জানান যৌথ নদী কমিশনের সদস্য ড. আবুল হোসেন।
তিনি মঙ্গলবার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ফারাক্কা বাঁধের গেট খোলার অগ্রিম কোনও তথ্য ভারত আমাদেরকে দেয়নি।”
এবার আগে না জানালেও বর্ষাকালে ভারত নিয়মিতভাবেই ফারাক্কা ব্যারেজের ফটক খুলে দেয় বলে তিনি জানান।
কুমিল্লা-ফেনী অঞ্চলে বন্যার জন্য বিশেষজ্ঞরা অতি বৃষ্টিকে কারণ দেখালেও সোশাল মিডিয়ায় ভারতের ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। এখন ফারাক্কা ব্যারেজ নিয়েও সমালোচনা চলছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জয়সোয়াল বলেন, আন্তর্জাতিক নদীর পানি নিয়ে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির ক্ষেত্র তৈরি করা হচ্ছে।
“ভুয়া ভিডিওর মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে অহেতুক আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। এ ধরনের তৎপরতা তথ্য দিয়ে দৃঢ়ভাবে মোকাবেলা করা দরকার।”