Beta
বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ, ২০২৫
Beta
বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ, ২০২৫

১৬ ডিসেম্বরে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে কেন ছিলেন না ওসমানী

জেনারেল এম এ জি ওসমানী।
জেনারেল এম এ জি ওসমানী।
[publishpress_authors_box]

নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী যখন আত্মসমর্পণ করে, সেই অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানীর না থাকাটা এখনও প্রশ্ন হয়ে আছে অনেকের মনে।

১৯৭১ সালের সেই দিনটিতে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ সামরিক কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী।

ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) যে অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে লাল-সবুজ পতাকার বিজয় সূচিত হয়েছিল, সেখানে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান এ কে খন্দকার।

ওই অনুষ্ঠানে ওসামানীর না থাকাটা নিয়ে নানা গুঞ্জন চলছে এখনও। ওই ঘটনা ধরে ওসমানীকে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর প্রয়াসও দেখা যায় অহরহ।

অথচ সামরিক বাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর ১৯৭০ সালের নির্বাচনেও ওসমানী আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের প্রথম সংসদেও আওয়ামী লীগ থেকে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। মন্ত্রীও হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সরকারে। বাকশাল গঠন নিয়ে দ্বন্দ্বে সংসদ থেকে পদত্যাগ করলেও ১৯৭৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক ঐক্য জোটের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হয়ে লড়াইয়ে নেমেছিলেন এক সময়ে তারই অধীনস্ত সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর পর ওসমানীকে সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব দেয় মুজিবনগর সরকার। কারণ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তিনিই ছিলেন সর্বোচ্চ পদধারী সামরিক কর্মকর্তা। স্বাধীনতার পর তাকে জেনারেল হিসাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ১৯৭২ সালের ৭ এপ্রিল তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন।

ওসমানীর যুদ্ধ পরিচালনার পদ্ধতি নিয়ে জিয়াসহ অন্য সমরনায়কদের সঙ্গে তার মতবিরোধ থাকলেও নীতিকে কঠোর ও প্রবল আত্ম মর্যাদাবোধ তাকে বৈশিষ্ট্যে স্বতস্ত্র করে তোলে বলে সমালোচকরাও স্বীকার করেন।

তাহলে কী কারণে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক সেই অনুষ্ঠানে ওসমানী অনুপস্থিত ছিলেন? তিনি কি এভাবে চাননি? তিনি কি ইচ্ছা করেই এড়িয়ে গেছেন? নাকি ভারত তাকে যেতে দিতে চায়নি? তার হেলিকপ্টারটি দুর্ঘটনায়ই বা কেন পড়েছিল? নিজে ১৯৮০ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কী বলেছিলেন ওসমানী?

চলুন খুঁজে দেখা যাক, এর কী উত্তর মেলে।

যা বলেছেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী

প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর এক স্মৃতিচারণে উঠে এসেছে ওসমানীর অনুপস্থিত থাকার বিষয়টি, যা ‘নতুন দিগন্ত’ সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়।

জাফরুল্লাহ বলেছেন, যুদ্ধ চলাকালীন লক্ষ্ণৌতে তিনি গিয়েছিলেন চিকিৎসাধীন সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফকে দেখতে। সেখান থেকে কলকাতায় ফেরার পথে বিমানে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুস সামাদ আজাদের সঙ্গে তার দেখা হয়। তিনি দিল্লি থেকে কলকাতায় ফিরছিলেন। সামাদ আজাদ তাদের দেখা হওয়ার বিষয়টি জাফরুল্লাহকে গোপন রাখতে বলেছিলেন।

এতে জাফরুল্লাহর সন্দেহ হওয়ায় তিনি কলকাতায় ফিরেই ওসমানীকে সব বলে দেন। যা শুনে ক্ষুব্ধ হন ওসমানী। তিনি ছুটে যান প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কাছে।

জাফরুল্লাহর ভাষায়- “ওসমানী সাহেব সোজা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেবের ঘরে ঢুকে উচ্চস্বরে বললেন- ‘You sold the country. I will not be a party to it.’ তাজউদ্দীন সাহেব ওসমানীকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন, নিচু স্বরে কী বললেন, আমি শুনতে পেলাম না। আমি দরজার বাইরে ছিলাম।”

জাফরুল্লাহ জানান, কয়েকদিন পর তাজউদ্দীন ও ওসমানীর মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয় ভারতীয় একটি প্রস্তাব নিয়ে। ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীন হলে আইন-শৃঙ্খলা স্থাপনের জন্য বেশ কয়েকজন ভারতীয় প্রশাসনিক ও পুলিশ অফিসার বাংলাদেশের সব বড় শহরে নির্দিষ্ট মেয়াদে অবস্থান নেবেন বলে ওই প্রস্তাবে ছিল। ওসমানী তার বিরোধিতা করে বলেন, ‘এটা হতে পারে না, আমাদের বহু বাঙালি অফিসার আছেন। কেউ কেউ পাকিস্তানে আটকা পড়েছেন। তারা নিশ্চয়ই ফিরে আসবেন।’

জাফরুল্লাহ বলেন, ওসমানীর সঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীদের মতপার্থক্যের কথা জেনে ভারতীয়রা সতর্ক হয়ে যায়। কাগজে-কলমে যৌথ কমান্ডের কথা থাকলেও বস্তুত তারা ওসমানীকে একাকী করে দেয়।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ-ভারত যৌথ সামরিক কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী। এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন এ কে খন্দকার।

জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ভাষ্য মতে, “১৬ ডিসেম্বর সকালে ব্রিগেডিয়ার গুপ্ত’র কাছে তারা প্রথম জানতে পারেন যে ওই দিন বিকালে ঢাকায় পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করবে। এ খবর শোনার পর জেনারেল ওসমানী ছিলেন চুপচাপ, কোনও কথা বলেননি।”

সেদিনের ঘটনার বর্ণনায় জাফরুল্লাহ বলেন, “জেনারেল ওসমানীর এডিসি আমাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ছেলে শেখ কামাল আমাকে বলল, ‘স্যার কখন রওনা হবেন, তা তো বলছেন না। জাফর ভাই, আপনি যান, জিজ্ঞেস করে সময় জেনে নিন।’

“আমি গিয়ে জিজ্ঞেস করায় ওসমানী সাহেব বললেন, ‘I have not yet received PM’s order to move to Dacca.’ আমি বললাম, আপনাকে অর্ডার দেবে কে? আপনি তো মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক। ওসমানী সাহেব বললেন, I decide tactics, my order is final for firing, but I receive orders from the cabinet through PM, Mr. Tajuddin Ahmed.’

তাজউদ্দীন আহম্মেদের কাছ থেকে কোনও বার্তা না পাওয়ার পর এই কথাগুলো অত্যন্ত বিষণ্ণ কণ্ঠে ওসমানী বলেছিলেন বলে জাফরুল্লাহর ভাষ্য। কারণ ওসমানী এটা মানতেন যে তিনি সরকারের অধীন। তার সিদ্ধান্তের বাইরে তিনি যেতে পারেন না।

তবে এরপর ওসমানী শেখ কামালকে ডেকে সবাইকে তৈরি হতে বললেন জানিয়ে জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, “আধা ঘণ্টার মধ্যে আমাদের আকাশে নিরুপদ্রব যাত্রা। ভারতীয় হেলিকপ্টারে সিলেটের পথে চলেছি।”

দুর্ঘটনায় হেলিকপ্টার

১৬ ডিসেম্বরের তিন দিন আগে কলকাতা থেকে সিলেট অঞ্চল সফরে বেরিয়েছিলেন ওসমানী। ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড গঠিত হওয়ার পর বাংলাদেশের অনেক এলাকা যৌথবাহিনীর দখলে চলে আসে। ওইসব এলাকাকে মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করা হয়। কলকাতায় থাকা ওসমানী সিদ্ধান্ত নেন তিনি মুক্তাঞ্চল পরিদর্শনে যাবেন। ভারতের সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার উজ্জ্বল গুপ্তের তত্ত্বাবধানে একটি এম-৮ হেলিকপ্টারে চড়ে ১৩ ডিসেম্বর বিকালে তিনি কুমিল্লায় পৌঁছান, যা পাওয়া যায় এ কে খন্দকারের বইয়ে।

ওসমানী ১৩ ডিসেম্বর সিলেটের মুক্তাঞ্চল পরিদর্শনের পরিকল্পনা করেন। তখন তাকে যুদ্ধের পরিণতি আসন্ন বলে কোথাও না যেতে সহকর্মীরা বললেও তিনি শোনেননি।

১৯৮০ সালে সাপ্তাহিক রোববারের স্বাধীনতা দিবস সংখ্যায় ওসমানীর একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। পরে সেটি ‘বঙ্গবীর ওসমানী’ নামের পুস্তিকা হিসাবে মুদ্রিত হয়েছিল।

সেখানে ওসমানীর জবানিতে সেই দুর্ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়। সাক্ষাৎকারে ওসমানী বলেন, “১৬ ডিসেম্বর দুপুরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল স্বাগত সিংয়ের সাথে মধ্যাহ্ন ভোজন করি। দুপুরের পর তদানীন্তন লেফটেন্যান্ট কর্নেল সফিউল্লাহর অধিনায়কত্বে ‘এস’ ফোর্স রণাঙ্গন পরিদর্শন করার জন্য আমার যাওয়ার কথা ছিল। জেনারেল স্বাগত সিং সেদিন না যেতে অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, যে ‘এস’ ফোর্স পরিদর্শনে অসুবিধা হতে পারে, যেহেতু তারা অগ্রসর হচ্ছেন। আমি তখন আমার সফরসূচি পরিবর্তন করে সিলেট ‘জেড’ ফোর্স পরিদর্শনে যাবার সিদ্ধান্ত নিই।”

১৬ ডিসেম্বরই ওসমানীর হেলিকপ্টারে গুলি করা হয়। সেই ঘটনার স্মৃতি তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর দুটি ছোট হেলিকপ্টার আগরতলা বিমানঘাঁটিতে পৌঁছালে স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ জানান, আমাদের ছোট দুটি হেলিকপ্টারের পরিবর্তে তিনি ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি বড় রুশী হেলিকপ্টার বন্দোবস্ত করেছেন। বিমানঘাঁটিতে হঠাৎ করে কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিক আমাকে ঘিরে ধরলে সময় নষ্ট হয়। তারপর সমবেত বৈমানিকদের নিকট থেকে বিদায় নেওয়ার জন্য সুলতান কিছু সময় নষ্ট করে ফেললেন। কেন যেন কী মনে হলো, তাই সুলতানকে বললাম, ‘আমাদেরকে রেখে এই হেলিকপ্টার যদি সময় মতো না ফেরে তবে খবর নিও। প্রয়োজন হলে নিজে হেলিকপ্টার নিয়ে এসো।”

জেনারেল ওসমানী বলেন, “হেলিকপ্টারে উঠতে বিকাল ৪টার বেশি বেজে যায়। হেলিকপ্টারের পেছনের ‘রাম্প’ খোলা ছিল। হেলিকপ্টারে ভারতীয় বিমানবাহিনীর দুজন তরুণ অফিসার, একজন পাইলট এবং আরো একজন সহ-পাইলট, তৎসহ কেরালার অধিবাসী একজন ওয়ারেন্ট অফিসার ছিলেন। পাইলটদের বললাম যে, সিলেট বিমানঘাঁটিতে যাব না, মাইন বা বাধা থাকতে পারে। আমরা যাব ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১ম ব্যাটালিয়ানের হেডকোয়ার্টারে। 

“আমার জানা মতে, ওই হেডকোয়ার্টার সিলেট ‘কেটল ফার্মের’ সন্নিকটে। এর কাছেই কলেজের হোস্টেল, সামনে বিরাট খেলার মাঠ, হেলিকপ্টার নামার উপযোগী। পাইলটকে বললাম, সিলেট শহরের নিকটে সুরমা নদীর কাছে পৌঁছলে আমাকে ডাকবে, আমি তোমাকে গাইড করব। ছেলেটি চলে গেল তার ‘ককপিটে’। আমার সঙ্গে ছিলেন মুক্তিবাহিনীর চিফ-অফ-দি-স্টাফ’ রূপে আমার সহকারী ও মুক্তিযুদ্ধের উপ-সর্বাধিনায়ক লে. কর্নেল (পরে মেজর জেনারেল) এম.এ.রব বীরউত্তম, ভারতীয় কমান্ডের ‘লিয়াজোঁ অফিসার’ ব্রিগেডিয়ার উজ্জ্বল গুপ্ত, ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী, সাময়িকভাবে আমার গণসংযোগ অফিসার মোস্তফা আল্লামা এবং আমার এডিসি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট শেখ কামাল।”

ওসমানী বলেছেন, “হেলিকপ্টার তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার ফুট উপর দিয়ে শান্তভাবে চলছিল। আমি দাঁড়িয়ে আমার চিফ-অফ-স্টাফ কর্নেল রবের সঙ্গে কথা বলছি, তিনি আমার নিকট বসা। হঠাৎ একটা মৃদু বিস্ফোরণের শব্দে সকলেই চমকে উঠলাম। মশার মতো আমার কানের ধার দিয়ে কয়েকটি গুলি গেল। সাথে সাথে হেলিকপ্টারটা উভয় পাশে গড়ান দিল। খোলা রাম্প দিয়ে যেন পড়েই গিয়েছিলাম বলে মনে হলো। কর্নেল রব গুলিবিদ্ধ হয়ে মেঝেতে পড়ে যান। আমি ছাড়া মনে হলো অন্যরা সকলেই আহত। ডাক্তার জাফরউল্লাহ তৎক্ষণাৎ মেঝেতে পড়া কর্নেল রবের পাশে বসে তাকে দেখছেন, বেশ রক্তপাত হচ্ছে। আমার ধ্যান তেলের ট্যাঙ্কের দিকে, দুটি ছিদ্র দিয়ে তেল বয়ে পড়ছে। নির্বোধের মতো হাত দিয়ে থামাতে গিয়ে আমার হাতে ফোসকা পড়ল। তখন প্রবাসী বাঙালিদের প্রেরিত আমার বৃষ্টি ও বাতাস হতে রক্ষাকারী জ্যাকেট দিয়ে তেলপ্রবাহ থামাবার আপ্রাণ চেষ্টা করি। এদিকে ওয়ারেন্ট অফিসার যন্ত্রপাতি চেক করছেন। ডা. জাফরউল্লাহ হাত দিয়ে দেখলেন কর্নেল রব নাড়ীহীন। তবুও তিনি তার বুকে কী যেন করছিলেন।

“হেলিকপ্টার গতি পরিবর্তন করে যেন ঘুরছে। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে। কিছুক্ষণেই তেলপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেল এবং সকলেই আমার দিকে তাকাচ্ছেন। তারা যেন আমার মনোবল কী বা কতটুকু তা মাপছেন। এড়াবার জন্য পাইলটের ‘ককপিটে’ গিয়ে বললাম : ‘Son our number seems to up.’ তরুণ পাইলট গেজ-এর দিকে তাকয়ে বললো: ‘শেষ হয়েছে’। আমি তার কাঁধে হাত দিয়ে বললাম: ‘Don’t worry, take it easy, it has to come for every one. Why did you go into a swing?’ (ঘাবড়িয়োনা, সকলকেই একদিন যেতে হবে। তুমি হেলিকপ্টারকে গড়িয়েছিলে কেন?)। সহ-পাইলট বললো: ‘There is something in the air, Sir.’ (আকাশে কী যেন ছিল, স্যার)। আমি তখন বেশ চিন্তিত। বললাম : ‘See if you come get down any where’ (দেখে একটি জায়গায় নেমে যাও)। তখনও আমার হাতটা ছেলেটার ঘাড়ে, জানি না এতে সে স্বস্থিবোধ করছিল কি না?”

“আমরা ঘুরে ঘুরে নামারই চিন্তা করছিলাম, এমন সময় একটা উজ্জ্বল নগরী যেন কোথা হতে নিচে ভেসে উঠলো। হঠাৎ মাথায় ঢুকলো না, এটা কোন জায়গা। শুধুই চিন্তা, কোনও সময় হেলিকপ্টারের ইঞ্জিন বন্ধ হবে বা আগুন লেগে খাড়াভাবে ভূমিতে পড়ে একটা বিস্ফোরণ হবে। অন্ধকারে পাইলট নামার চেষ্টা করলে আমি একবার বিরাট জলাশয় ও একবার বিরাট পাহাড় দেখে উপরে উঠে যেতে বললাম। হঠাৎ মনে হলো ‘Landing light’ এর কথা। বলতেই পাইলট সেটা জ্বালালো এবং আমরা একটা ধানশূন্য ক্ষেতের উপর নিজেদের পেয়ে বললাম, ‘এখানেই নামো’। পাইলট অতি স্থির ও শান্তভাবে হেলিকপ্টার নামাল।”

হেলিকপ্টার থামার পর ওসমানী নেমে বুঝতে পারেন, তারা সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ সেতুর কাছে। ততক্ষণে লোকজন জড়ো হয়ে গেছে। মিত্র বাহিনীর মাউন্টেন ডিভিশনের একজন কর্নেলও এসে উপস্থিত হন। তিনি হেলিকপ্টারটি নামতে দেখে ছুটে আসেন। তিনিই অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করে দিয়েছিলেন।

আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ওসমানীর অনুপস্থিতি সম্পর্কে ভারতীয় সাবেক কূটনীতিক জে এন দীক্ষিত তার ‘ইন্ডিয়া-পাকিস্তান ইন ওয়ার অ্যান্ড পিস’ বইয়ে লিখেছেন, ওসমানীর হেলিকপ্টার বিপাকে পড়ায় তিনি সময়মতো ঢাকায় আসতে পারেননি। আর সেই কারণেই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে প্রচারের আলোর সবটুকু গিয়ে পড়ে ভারতের কমান্ডারের ওপর।

ভারতীয় মেজর জেনারেল জে আর এফ জ্যাকব পাকিস্তানি বাহিনীর অধিনায়ক নিয়াজীকে আত্মসমর্পণে রাজি করানো এবং এ সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন ও তদারকির দায়িত্বে ছিলেন।

তিনি তার লেখা ‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা : বার্থ অব এ নেশন’ বইয়ে লিখেছেন, “দুর্ভাগ্যবশত ওসমানী এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননি। তার জন্য পাঠানো হেলিকপ্টার পথে শত্রুর গুলির আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সময়মতো সেটা মেরামত করে তোলা সম্ভব হয়নি। তার অনুপস্থিতির ভুল ব্যাখা করা হয়, পরবর্তীকালে তা অনেক সমস্যার জন্ম দেয়।”

কলকাতায় ওসমানীর খোঁজ

বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের অফিস ছিল কলকাতা নগরীর ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে। সেই অফিসেই বসতেন জেনারেল ওসমানী।

পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠান যখন প্রস্তুত, তখন তাজউদ্দীন ওসমানীর খোঁজ করছিলেন বলে বিভিন্নজনের ভাষ্য পাওয়া যায়।

তাজউদ্দীন আহমদের একান্ত সচিব ফারুক আজিজ খান তার ‘বসন্ত ১৯৭১’ বইয়ে লিখেছেন, ১৬ ডিসেম্বর দুপুর সাড়ে ১২টায় তিনি কর্নেল দাসের কাছে জানতে পারেন, ফোর্ড উইলিয়াম থেকে খবর এসেছে, ওইদিন বিকালেই ঢাকায় পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করবে। তিনি এ খবরটি প্রধানমন্ত্রীকে দেন এবং তার কাছে জানতে চান, বাংলাদেশের পক্ষে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে কে প্রতিনিধিত্ব করবে?

ফারুক আজিজ খানের ভাষায়, “প্রধানমন্ত্রী নিচু স্বরে জানতে চাইলেন, ‘কর্নেল ওসমানী কোথায়?’ আমি জানালাম, তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার উজ্জ্বল গুপ্ত এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ (সিজিএস) আবদুর রবের সঙ্গে কলকাতার বাইরে গেছেন। তারা একটা হেলিকপ্টারে চেপে সিলেটের দিকে গেছেন। আমরা এপর্যন্ত জানতাম।

“হাউ আনলাকি হি ইজ- প্রধানমন্ত্রী বললেন। তারপর বললেন- সারাটা বছর তিনি নিজের অফিসে কাটালেন, আর আজ এমন দিনে তিনি এখানে নেই’। একটু বিরতি দিয়ে তিনি বললেন, ‘জেনারেল অরোরার সঙ্গে গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার যাবেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করতে।”

প্রাবন্ধিক আনোয়ার পারভেজ হালিম তার এক নিবন্ধে লিখেছেন, ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের হেড কোয়ার্টার ছিল ফোর্ট উইলিয়ামে। সেখানে বসতেন জেনারেল অরোরা। কিন্তু ওসমানীর সঙ্গে তার দেখা হতো কদাচিৎ। নয় মাসে ওসমানী ফোর্ড উইলিয়ামে গিয়েছিলেন মাত্র একবার। তবে দুই বাহিনীর মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানের জন্য একজন লিয়াজোঁ অফিসার ছিল। আর ফোর্ট উইলিয়ামের যে কোনও সিদ্ধান্ত আগে আসত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের কাছে, তার মাধ্যমে যেত ওসমানীর কাছে।

নানা বিষয়ে ওসমানীর সঙ্গে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তাদের বনত না। একজন ভারতীয় জেনারেল মনে করতেন, ‘অহংকারী’ ওসমানীর সঙ্গে মানিয়ে চলা বেশ কঠিন।

মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ ও এম এ জি ওসমানী।

যুদ্ধ কৌশল নিয়ে ওসমানীর সঙ্গে জিয়া কিংবা খালেদ মোশাররফের দ্বন্দ্বের খবরও নানা লেখায় পরে এসেছে। কারণ ওসমানী চাইতেন, যুদ্ধ হবে প্রথাগত পদ্ধতিতে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ ছিল গেরিলানির্ভর। কিন্তু ওসমানীর সেদিকে আগ্রহ ছিল না। তিনি যুদ্ধের ময়দানেও যেতেন না।

সেক্টর কমান্ডারদের সঙ্গে ওসমানীর বিরোধ মধ্যস্ততা করে সামাল দিতেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন।

 আনোয়ার পারভেজ হালিম লিখেছেন, “পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ৩৭ বছরের চাকরি জীবনে ওসমানী বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন দাপ্তরিক কাজে। স্বভাবতই যুদ্ধের ময়দানে অপারেশনাল কমান্ড, বিশেষ করে গেরিলাযুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তার ছিল না। হয়ত সে কারণেই প্রধান সেনাপতি গেরিলা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন।

“আবার কর্নেল রব সদর দপ্তরে নিয়মিত অফিস করতেন না। তিনি বেশিরভাগ সময় থাকতেন আগরতলায়। তার অবর্তমানে চিফ অব স্টাফের কাজগুলো করতে হতো এ কে খন্দকারকে।”

খন্দকারের ভাষায়, “রব সাহেব যুদ্ধের শুরু থেকেই আগরতলায় অবস্থান করছিলেন। চিফ অব স্টাফ হিসেবে তাকে আমি কখনও থিয়েটার রোডে দায়িত্ব পালন করতে দেখিনি। সদর দপ্তরে না থাকায় প্রধান সেনাপতিকে তিনি যুদ্ধের বিষয়ে কোনও পরামর্শ দেওয়ার সুযোগ পাননি। প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশ বাহিনীর চিফ অব স্টাফের সব দায়িত্ব যুদ্ধের শেষদিন পর্যন্ত আমাকেই পালন করতে হয়।”

বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক আইজি ও স্বরাষ্ট্র সচিব আবদুল খালেকের এক লেখায় বলা হয়, “বিজয় যখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট, তখন আত্মসমর্পণ উৎসবে আমাদের যোগদান সম্পর্কে যে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়, তাতে স্থির করা হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর কর্নেল ওসমানী, রুহুল কুদ্দুস ও আমি হেলিকপ্টারে ভারতীয় কমান্ডারকে নিয়ে ঢাকায় পৌঁছবো। দমদম এয়ারপোর্টে পৌঁছার জন্য যে সময় দেওয়া হয়েছিল, তার ঘণ্টাখানেক আগে আমাদের প্রশাসনে কী যেন একটি হাঁসফাঁস পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। আমি তার কিছুই আঁচ করতে পারিনি। রুহুল কুদ্দুস শুধু জানালেন যে কর্নেল ওসমানীকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কাজেই ডেপুটি কমান্ডার ইন চিফ এ কে খন্দকারকে খুঁজে বের করা হয়েছে। শুধু তিনি ঢাকায় যাবেন। আমরা দুজন যাব না। কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে কার কী মতভেদ ঘটেছিল, তা আর জানতে পারিনি।”

আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে জেনারেল ওসমানীর অনুপস্থিতি প্রসঙ্গে কে এম শফিউল্লাহ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “১৬ ডিসেম্বর আমি ছিলাম ঢাকার ডেমরা এলাকায়। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জেনারেল অরোরা। যদিও থাকার কথা ছিল ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশের। ওসমানী ছিলেন বাংলাদেশের প্রধান সেনাপতি।

“তবে জেনারেল ওসমানী আগে কোনও এক সময় বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘ভারতীয় সেনাপ্রধান যদি আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত না থাকেন, তাহলে বাংলাদেশের উপ সেনাপ্রধান থাকবেন। কারণ, এটা প্রটোকলের প্রশ্ন। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে এ কে খন্দকার উপস্থিত ছিলেন। আমিও ছিলাম।”

প্রটোকলই মুখ্য?

সামরিক বাহিনীর আচার পুরোপুরি মেনে চলতে অভ্যস্ত ছিলেন জেনারেল ওসমানী, সেটাই তার অনুপস্থিতির কারণ বলে অনেকে মনে করেন।

মুক্তিযুদ্ধকালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন নজরুল ইসলাম। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ‘একাত্তরের রণাঙ্গন : অকথিত কিছু কথা’ নামে একটি বই লিখেছেন তিনি। তুলে ধরা হয়েছে।

সেখানে তিনি লিখেছেন, “পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্ব শেষ হওয়ার দুদিন পর জেনারেল ওসমানী বিক্ষুব্ধ-উত্তপ্ত মুজিবনগর সরকারের সদর দপ্তরে ফিরে আসেন। ঢাকায় পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে তার অনুপস্থিতিকে কেন্দ্র করে এক অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষোভ ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়, যা মুজিবনগর সরকারের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের এই অতিগুরুত্বপূর্ণ সময়ে মুজিবনগরে জেনারেল ওসমানীর  অনুপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলা সরকারের নেতারাও তার ওপরে কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলা সরকারের সদর দপ্তরে পা রেখে জেনারেল ওসমানী উত্তাপ কিছুটা টের পেয়েছিলেন।

“জেনারেল ওসমানীর এডিসি (শেখ কামাল) সবিস্তারে জেনারেল সাহেবের অনুপস্থিতিতে তাকে ঘিরে কে কী মন্তব্য করেছেন, সব কথা তাকে রিপোর্ট করেন। পরিস্থিতি সম্পর্কে আরও অবহিত হওয়ার জন্য জেনারেল সাহেব আমাকে তার কক্ষে ডাকেন। খুব ধীরস্থির হয়ে বসে জেনারেল ওসমানীকে জানালাম, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আপনার অনুপস্থিতি নিয়ে এখানে রাজনৈতিক মহলে বিরূপ সমালোচনা হয়েছে।”

নজরুল ইসলাম লিখেছেন, “জেনারেল ওসমানী কিছুটা কর্কশ কণ্ঠে বললেন, ‘দেখুন, আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে যাচ্ছি। কিন্তু দুঃখ হলো স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধ সম্পর্কে কোনও চেতনা এখনও জন্ম হয়নি। আমাকে নিয়ে রিউমার ছড়ানোর সুযোগটা কোথায়? কোনও সুযোগ নেই। তার অনেক কারণ রয়েছে।

“নাম্বার ওয়ান- পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কবে আত্মসমর্পণ করবে, আমি জানতাম না। আমি কলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তাদের আত্মসমর্পণের প্রস্তাব এসেছে। নাম্বার টু- ঢাকায় আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আমার যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ, এই সশস্ত্র যুদ্ধ ভারত-বাংলাদেশের যৌথ কমান্ডের অধীনে হলেও যুদ্ধের অপারেটিং পার্টের পুরো কমান্ডে ছিলেন ভারতীয় সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল শ্যাম মানেকশ। সত্যি কথা আমি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনও নিয়মিত সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধানও নই। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুযায়ী পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমার কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারে না। কারণ, বাংলাদেশ জেনেভা কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী কোনও দেশ নয়। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে জেনারেল মানেকশকে রিপ্রেজেন্ট করেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরা। জেনারেল মানেকশ গেলে তার সঙ্গে আমার যাওয়ার প্রশ্ন উঠত। সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে আমার অবস্থান জেনারেল মানেকশর সমান। সেখানে জেনারেল মানেকশর অধীনস্থ আঞ্চলিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল অরোরার সফরসঙ্গী আমি হতে পারি না। এটা দেমাগের কথা নয়, এটা প্রটোকলের ব্যাপার।”

নজরুলের ভাষ্যে ওসমানী আরও বলেছিলেন, “পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে যৌথ কমান্ডের অধীনে ভারতীয় বাহিনীর কাছে। আমি সেখানে (ঢাকায়) যাব কি জেনারেল অরোরার পাশে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখার জন্য? হাও ক্যান আই? আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করবেন জেনারেল মানেকশর পক্ষে জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আর পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে জেনারেল নিয়াজী। সেখানে আমার ভূমিকা কী? খামোখা আমাকে নিয়ে কেন টানা-হেঁচড়া করা হচ্ছে?”

নজরুল ইসলাম তার বইয়ে লিখেছেন, পাকিস্তানি বাহিনী কেন মুক্তিবাহিনীর পরিবর্তে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন সিলেটের আওয়ামী লীগ নেতা দেওয়ান ফরিদ গাজী। তখন দেওয়ান গাজীর ওপরও ক্ষেপে গিয়েছিলেন ওসমানী।

তিনি বলেছিলেন, “তোমরা লোকজনকে অন্ধকারে রেখেছো। দুনিয়ার রীতিনীতি সম্পর্কে মানুষকে কিছু জানতে দাও। বাংলাদেশ জেনেভা কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ নই। এই কনভেনশনের স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে রাজি হবে না। কারণ, তাদের (পাক বাহিনী) ধারণা, আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করলে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের হত্যা করে ফেলবে। কিন্তু জেনেভা কনভেশন অনুযায়ী পরাজিত আত্মসমর্পণকারী সৈন্যদের হত্যা করা বা কোনও রূপ নির্যাতন করা যায় না। তাদের নিরাপত্তায় আইনি প্রটেকশন দিতে হয়। সামরিক রীতিনীতি অনুযায়ী তাদের সঙ্গে আচরণ করতে হয়। উন্নত খাবার, নানান সুযোগ-সুবিধা দিতে হয়। বন্দিকালীন সময়ে নিরস্ত্র অবস্থায় এক্সারসাইজ, খেলাধুলা ইত্যাদির সুযোগ-সুবিধা দিতে হয়।

“কিন্তু আমরা তো এখনও ভারতের মাটিতেই রয়ে গেছি। বাংলাদেশই তো আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। আমাদের সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কোনও নিয়মিত সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী নেই। এমনকি পুলিশ বাহিনীও নেই। এ অবস্থায় ৯০ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করলে, আমরা তাদের রাখব কোথায়? তাদের প্রটেকশন দেব কীভাবে?”

দ্বন্দ্ব কী নিয়ে?

নজরুল ইসলামের বইয়ে উল্লেখ করা্ হয়েছে, “স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য ওসমানী একটি ভাষণ লিখেছিলেন ইংরেজিতে। যার অনুবাদে কমান্ডার ইন চিফের বাংলা মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি করা হয়েছে দেখে ক্ষেপে যান তিনি। নির্দেশ দেন সর্বাধিনায়ক লিখতে। বিব্রত নজরুল তথ্য মন্ত্রণালয়ে গেলে ভারপ্রাপ্ত সদস্য আব্দুল মান্নান প্রধান সেনাপতি লিখতে বলেন। ক্ষুব্ধ ওসমানী এরপর স্বাধীন বাংলা বেতারে কোনও ভাষণ দেননি গোটা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে।”

লেখক মহিউদ্দিন আহমেদের ‘তাজউদ্দীন নামে একজন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন’ বইয়ে উল্লেখ রয়েছে, “তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিবাহিনীর কমান্ডারদের একটি সম্মেলন ডাকেন। সম্মেলন হয় ১১-১২ জুলাই। সেনা কমান্ডারদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর প্রধান ওসমানীর দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। এই সম্মেলনে তার প্রতিফলন দেখা যায়। ওসমানী ক্ষুব্ধ হয়ে পদত্যাগ করেছিলেন। পরে তিনি পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করে নেন। ওই সম্মেলনে বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে প্রত্যেক সেক্টরের জন্য আলাদা কমান্ডার নিয়োগ দেওয়া হয়।”

এ কে খন্দকারের ভাষ্যে জানা যায়, ভারতের সঙ্গে যৌথ সামরিক নেতৃত্বের বিরোধিতা করতেন ওসমানী।

“তার মনোভাব ছিল, আমাদের সামরিক তৎপরতা আমরা করব, মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় বাহিনীর যৌথ নেতৃত্ব হবে না। রাজনৈতিক পর্যায়ে এই যৌথ সামরিক নেতৃত্ব গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে কর্নেল ওসমানী পদত্যাগ করেন। এর আগে তিনি কয়েকবার পদত্যাগ করেছেন মৌখিকভাবে। যুদ্ধের এই চূড়ান্ত ও সংকটজনক পর্যায়ে মৌখিকভাবে পদত্যাগের কথা বলার পর ওসমানী সাহেবকে তাজউদ্দীন আহমদ লিখিতভাবে পদত্যাগ করতে বলেন। তখন তিনি আর লিখিত পদত্যাগপত্র দেননি। এরপর থেকে বলা যায়, তিনি নিষ্ক্রিয় থাকতেন এবং কোনো বিষয়ে কোনো উৎসাহ দেখাতেন না।”

ওসমানীর সঙ্গে প্রবাসী সরকারের এমন নানা দ্বন্দ্বের খবর আলোচনায় আসে বিভিন্ন সময়।

১৯৭০ সালের ভোটের প্রচারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জেনারেল এম এ জি ওসমানী। ছবি : জনযুদ্ধের সৌজন্যে
১৯৭০ সালের ভোটের প্রচারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জেনারেল এম এ জি ওসমানী। ছবি : জন্মযুদ্ধের সৌজন্যে

স্বাধীনতার পর জেনারেল ওসমানী বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রী থাকাকালে তার এপিএস ছিলেন শাহনূর চৌধুরী। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “জেনারেল ওসমানী প্রখর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ও ন্যায়-নীতির মানুষ ছিলেন। পদমর্যাদার কারণে তিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে তিনি যান বলে আমার ধারণা। এছাড়া এখানে অন্য কোনও কিছু ছিল না।”

ভারতীয় কোনও বাধা ছিল না কি না- প্রশ্নে তিনি বলেন, “এ নিয়ে তাকে (ওসমানী) কখনও কিছু বলতে শুনিনি। তাজউদ্দীন সাহেবসহ মুজিবনগর সরকারে দায়িত্ব পালনকারী সকলের সঙ্গে তার চমৎকার সম্পর্ক দেখেছি। সকলেই তাকে সম্মান করতেন। নীতিগত কারণে তিনি মন্ত্রিত্ব ছাড়লেও মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করার সকল অপচেষ্টার তিনি তীব্র প্রতিবাদ করতেন।”

শাহনূর চৌধুরী বলেন, “১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নৃশংস ঘটনার পর দেশের বাস্তবতায় তিনি খন্দকার মোশতাক সরকারকে সহযোগিতা করলেও বঙ্গবন্ধুর প্রতি ছিলেন সবসময়ই শ্রদ্ধাশীল। পরে আওয়ামী লীগের চরম দুঃসময়ে ১৯৭৮ সালে তিনি গণ ঐক্যজোটের প্রার্থী হিসেবে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে নৌকা প্রতীক নিয়ে রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আওয়ামী লীগকে ভোটের রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনেন।”

ওসমানীর পাণ্ডুলিপিটি কই?

নানা মত, তথ্য থাকলেও এসব ক্ষেত্রে ওসমানী কী বলে গিয়েছিলেন, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।

আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে অনুপস্থিতি নিয়ে ১৯৮০ সালে রোববারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমি তখন রণাঙ্গনে সফররত। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, বিশেষ করে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রী জানতেন আমাকে কোথায় পাওয়া যাবে? তাছাড়া মিত্রবাহিনীর উচ্চতম কর্মকর্তারাও জানতেন আমি কোথায়?

“তা সত্ত্বেও আমাকে কোনও খবর দেওয়া হয় নাই। বরং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রধান আমার ডেপুটি চিফ অব স্টাফ তদানীন্তন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারকে পাঠান।”

জেনারেল ওসমানী তার সাক্ষাৎকারে আরও বলেছিলেন, “ভারতীয় ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ উভয় সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের মহান ব্যক্তিবর্গ (স্ব স্ব কারণে বা উদ্দেশ্যে) চাইতেন না যে এই আত্মসমর্পণ বাংলাদেশ তথা মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়কের নিকট হোক, যদিও মুক্তিবাহিনী (নিয়মিত ও অনিয়মিত) সুদীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করেছিল এবং তাদের সর্বাধিনায়ক কেবিনেট মন্ত্রী সমপর্যায়ের মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।”

তবে এই বিষয়ে বিস্তারিত কিছু আর সাক্ষাৎকারে বলে যাননি ওসমানী।

এ প্রসঙ্গে জেনারেল ওসমানীর ঘনিষ্ঠজন, সাংবাদিক ইব্রাহিম চৌধুরী খোকন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এসব ঘটনা নিয়ে তাকে প্রশ্ন করলে তিনি বলতেন- ‘এখনও অনেক কথা বলার সময় বা পরিবেশ আসেনি। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলীভিত্তিক স্মৃতিকথামূলক ইতিহাস লিখছি আমি; সেখানে সব পাবেন’।”

১৯৮৪ সালে ওসমানীর মৃত্যুর পর তার লেখা পাণ্ডুলিপি আর পাওয়া যায়নি।

“এনিয়ে কেউ কেউ খোঁজ-খবর নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কেউ পাণ্ডুলিপিটির খোঁজ পাননি। ধারণা করা হয়, এটি গায়েব করে দেওয়া হয়েছে,” বলেন খোকন।

জেনারেল ওসমানীর এক আত্মীয় সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, ইংরেজি টাইপ রাইটারে এক আঙুলে টাইপ করে তিনি পাতলা কাগজে বইটির পান্ডুলিপি তৈরির কাজ শেষ করেছিলেন। পান্ডুলিপির পাঁচটি কপিও করা হয়েছিল। বিলেতের একটি প্রকাশনী থেকে বইটি প্রকাশের আলোচনাও চূড়ান্ত হয়েছিল। চিকিৎসার জন্য লন্ডন যাওয়ার সময়ে জেনারেল ওসমানী বইটির দুটি কপি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। বাকি তিনটি কপি সিলেট শহরের নাইওরপুলে তার বাসা ‘নূর মঞ্জিল’-এ রেখে গিয়েছিলেন।

“লন্ডন থেকে তার লাশের সঙ্গে পান্ডুলিপির কপি দুটি ফেরেনি। সিলেটের বাসার কপিগুলোও আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত