Beta
মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
Beta
মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

অভি খালাস : তিন্নিকে কে মেরেছিল, জানা গেল না

তানিয়া মাহবুব তিন্নি
তানিয়া মাহবুব তিন্নি
[publishpress_authors_box]

২৩ বছর আগের এক সকাল; ঢাকার পোস্তগোলায় বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর নিচে পিলারের উঁচু জায়গায় পড়েছিল এক তরুণীর লাশ। কে এই তরুণী, জানা যাচ্ছিল না তখন।

২০০২ সালের ১০ নভেম্বর লাশ উদ্ধারের কয়েকদিন পর জানা গেল, নিহত তরুণী সৈয়দা তানিয়া মাহবুব তিন্নি। মডেল হিসাবে টিভির পর্দায় কিংবা সংবাদপত্রের পাতায় তার ছবি সবার সামনে থাকলেও অপমৃত্যু তার চেহারা অচেনা করে তুলেছিল।

তখন পরিচয় জানা গেলেও খুনি কে, তা জানা যাচ্ছিল না। তাই অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে মামলা করেন কেরানীগঞ্জ থানার তৎকালীন এএসআই মো. সফি উদ্দিন।

তদন্ত শুরুর কিছুদিন পরই অভিযোগের আঙুল ওঠে গোলাম ফারুক অভির দিকে। গত শতকের ৮০ এর দশকে ছাত্রদলের এই দাপুটে নেতা ততদিনে দল পাল্টে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে সংসদ সদস্যও হয়ে গেছেন।

বেশ কয়েকজন তদন্ত কর্মকর্তার হাত ঘুরে সিআইডি কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক ২০০৮ সালের ৮ নভেম্বর অভিকে একমাত্র আসামি করে মামলাটিতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

দু্ই বছর পর পলাতক অভিকে অভিযুক্ত করে ২০১০ সালের ১৪ জুলাই শুরু হয় এই মামলার বিচার। তারও ১৪ বছর পর ৪১ জন সাক্ষীর মধ্যে ২৬ জনের সাক্ষ্য নিয়ে বুধবার রায় দিয়েছে আদালত।

ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মোছা. শাহীনুর আক্তার রায়ে আসামি অভিকে খালাস দিয়েছেন। রায়ে তিনি বলেন, আসামির বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে না পারায় তাকে বেকসুর খালাস দেওয়া হলো।

ফলে তিন্নিকে কে হত্যা করল, তা অজানাই থেকে গেল। অমীমাংসিত এমন মামলার ধারায় যুক্ত হলো আলোচিত এই মামলাও।

এই মামলার বিচার প্রক্রিয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যস্ত অভি পলাতকই ছিলেন। রায়টিও হয়েছে তার অনুপস্থিতিতে। তিনি কানাডায় স্থায়ী হয়েছেন বলে অনেক দিন আগেই খবর আসে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অভি গত শতকের ৮০ এর দশকে ছিলেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক। ক্যাম্পাসে ‘ক্যাডার’ হিসাবে পরিচিত অভি ১৯৮৯ সালে একটি হত্যা মামলা গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন।

১৯৯০ এর গণ আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে তিনি ছাত্রদল ছেড়ে সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের হাত ধরেন। আন্দোলনের মধ্যে ডা. শামসুল হক মিলনকে হত্যায় অভিকেও দায়ী করা হয়ে থাকে।

১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বরিশাল-২ (বাবুগঞ্জ-উজিরপুর) আসনে ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান মেননকে হারিয়ে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন লাঙল প্রতীকের অভি।

৫ দিন পর লাশ শনাক্ত

তিন্নির লাশের এই ছবি দেখে পরিবার তাকে শনাক্ত করেছিল।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে ২০০২ সালে সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে চলছিল যৌথ অভিযান। তখন স্থানীয়দের কাছে খবর পেয়ে বুড়িগঙ্গা সেতুর নিচ থেকে তিন্নির লাশ উদ্ধার করতে গিয়েছিলেন কেরানীগঞ্জ থানার এএসআই মো. শফিউদ্দিন। তিনিই পরে মামলা করেন।

শফিউদ্দিন লাশ নদীর তীরে তুলে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন। তারপর ময়নাতদন্তের জন্য লাশ নিয়ে যান মিটফোর্ড হাসপাতাল মর্গে।

ময়নাতদন্ত শেষে কোনও দাবিদার না থাকায় বেওয়ারিশ হিসাবে দাফনের জন্য লাশটি আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামকে দেওয়া হয়। লাশ দাফন করা হয় জুরাইন কবরস্থানে।

সুরতহাল প্রতিবেদনে লাশের শরীরের বিভিন্ন অংশে থেঁতলানো জখমের কথা উল্লেখ ছিল। মাথার খুলিতে ছিল ভোঁতা অস্ত্রের আঘাত। আঘাতের চিহ্ন দেখে পুলিশ নিশ্চিত হয় যে এটি হত্যাকাণ্ড।

এএসআই শফিউদ্দিনের করা মামলায় বলা হয়েছিল, আগের দিন রাতের আঁধারে অজ্ঞাতনামা তরুণীকে হত্যা করে লাশ গোপন করার জন্য বুড়িগঙ্গা সেতুর নিচে ফেলে দেওয়া হয়।

মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গ থেকে লাশটি আঞ্জুমান মুফিদুলকে দেওয়ার সময় তুলে রাখা ছবি ২০০২ সালের ১৫ নভেম্বর দৈনিক জনকণ্ঠে ছাপা হয়েছিল।

পত্রিকায় ওই ছবি দেখে তিন্নির চাচা সৈয়দ রেজাউল করিম জানান যে নিহত তরুণী তারই ভাইয়ের মেয়ে।

তিনি একটি সাধারণ ডায়েরি করার পর তিন্নির লাশ কবর থেকে তোলা হয়, পরে পারিবারিকভাবে পুনরায় দাফন করা হয়।

জনকণ্ঠের সেদিনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, সাত দিন ধরে নিখোঁজ ছিলেন তিন্নি। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তাকে পাচ্ছিল না পরিবার। তিন্নির স্বামী সাফকাত হোসেন পিয়ালও কিছু বলতে পারছিলেন না।

তিন্নি বিজ্ঞাপনচিত্রের পরিচিত মুখ হয়ে উঠছিলেন তখন; পাশাপাশি নাটকও করতেন। ‘আনন্দ মেলা’ নামে একটি অনুষ্ঠানের শুটিংয়ের কথা বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হন তিনি।

তিন্নির বাবার নাম সৈয়দ মাহবুবুল করিম, তার বাসা ঢাকার কলাবাগানে।

ফ্যাশন ডিজাইনার স্বামী পিয়ালের সঙ্গে তখন তিন্নির দাম্পত্য কলহের খবর এসেছিল জনকণ্ঠে। তিনি বাসা ছেড়ে ফুপুর বাসায় উঠেছিলেন। সেখান থেকে বেরিয়েই নিখোঁজ হন তিনি।   

মামলার দীর্ঘ পথ

পাঁচ দিন পর তিন্নির পরিচয় শনাক্ত হলে খবর ছাপায় সংবাদপত্রে।

২০০২ সালের ২৪ নভেম্বরই তিন্নি হত্যামামলার তদন্তভার পায় সিআইডি। প্রথমে তদন্তের দায়িত্ব পান সিআইডির পরিদর্শক সুজাউল হক। পরে একে একে আসেন সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) গোলাম মোস্তফা, এএসপি আরমান আলী, এএসপি কমল কৃষ্ণ ভরদ্বাজ। সবশেষে আসেন এএসপি মোজাম্মেল হক।

তদন্ত কর্মকর্তারা তিন্নির গৃহকর্মী, গাড়িচালকসহ নানাজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে অভির সংশ্লিষ্টতা পেয়েছিল।

তদন্তকারীরা জানতে পারেন, তিন্নির সঙ্গে অভির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠছিল। সেই কারণে তিন্নির সঙ্গে তার স্বামী পিয়ালের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। তিন্নি অভিকে বিয়ের জন্য চাপ দেওয়ায় তাকে খুনের শিকার হতে হয়।

সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা মোজাম্মেল হকই ২০০৮ সালের ৮ নভেম্বর অভিকে একমাত্র আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। এরপর ২০১০ সালের ১৪ জুলাই অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বিচার। অভিযোগপত্রে সাক্ষী করা হয় ৪১ জনকে।

২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর তিন্নি হত্যা মামলায় রায়ের তারিখ ধার্য করেছিল আদালত। কিন্তু সেদিন গুরুত্বপূর্ণ দুই সাক্ষী তিন্নির বাবা ও চাচা সাক্ষ্য দিতে চাইলে আদালত রায় মুলতবি করে পুনরায় সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু করে।

তিন্নির বাবা মাহবুবুল করিম আদালতে সাক্ষ্যে বলেছিলেন, তিন্নির সঙ্গে তিনি অভিকে প্রথম দেখেছিলেন হত্যাকাণ্ডের পাঁচ দিন আগে ৫ নভেম্বর পিয়াল ও তিন্নির বাসায়। সেদিন তিন্নি তাকে বলেছিলেন যে তিনি অভিকে বিয়ে করতে চান।

মাহবুবুল করিম বলেছলেন, “আমি তিন্নিকে তার স্বামী পিয়ালের কথা বলি। তাকে বলি, এখন তুমি কীভাবে অভিকে বিয়ে করব? তিন্নি বলে, ‘আমি পিয়ালের সাথে থাকতে চেয়েছি, কিন্তু সে আমাকে ধরে রাখতে পারেনি’।”

সেখানে পিয়ালও ছিলেন জানিয়ে মাহবুবুল সাক্ষ্যে বলেন, অভি সেদিন পিয়ালকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, তিনি যেন তিন্নিকে ডিভোর্স দিয়ে দেন।

সেদিন অভি মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তাকেও হুমকি দিয়েছিলেন বলে তিন্নির বাবা সাক্ষ্যে জানান।

তারপর আর তিন্নির বাসায় যাননি জানিয়ে মাহবুবুল বলেছিলেন, ১০ তারিখ সন্ধ্যার পর তিন্নি বাসায় এসে ১০ মিনিটের মতো ছিলেন। তাকে ‘সরি’ বলে চলে যাওয়ার সময় বলেছিলেন, অভির কাছে যাচ্ছেন তিনি।

মাহবুবুল বলেন, “পরে আমরা পত্রিকায় এবং মানুষের মুখে শুনতে পারি যে অভিই হত্যা করেছে তিন্নিকে। তিন্নির লাশ যেদিন পত্রিকায় ছাপা হয়, সেদিন সকাল বেলা কলাবাগানে অভির সাথে আমার ভাইয়ের দেখা হয়। অভি বলে- ‘তিন্নিকে খুঁজতে হবে না।”

অভি কোথায়?

গোলাম ফারুক অভি

তিন্নি যখন খুন হন, তখন অভি সংসদ সদস্য ছিলেন না। কারণ ১৯৯৬ সালে জিতলেও ২০০১ সালের নির্বাচনে হেরে যান তিনি।

তিন্নি খুনে তার জড়িত থাকার ইঙ্গিত মেলার পর তিনি দেশ ছাড়েন। খুনের এই মামলার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়ায় রাষ্ট্রীয় খরচে তার জন্য আইনজীবী নিযুক্ত করা হয়েছিল।

পরে খবর আসে যে অভি কানাডায় পাড়ি জমিয়েছেন। অভির জন্য বাংলাদেশ পুলিশ ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিসও জারি করেছিল।

২০০৯ সালে অভি দেশে ফেরার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমার আবেদন করেন। তার মা হাই কোর্টে একটি রিট আবেদনও করেন, যাতে দেশে ফিরতে অভিকে বাধা দেওয়া হয়। তবে সফল হয়নি সেই চেষ্টা।

বিএনপি সরকার আমলে ১৯৯৩ সালে অস্ত্র মামলায় অভির ১৭ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। তিন বছর কারাভোগের পর জামিন পান তিনি। সেই মামলা আর এগোয়নি।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত