দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস রেমিটেন্স প্রবাহে ফের উল্লম্ফন দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার রেমিটেন্সের যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টের প্রথম ২৮ দিনে (১ থেকে ২৮ আগস্ট) বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ২০৭ কোটি ১০ লাখ (২.০৭ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন।
আর এই রেমিটেন্সের ওপর ভর করে রিজার্ভও খানিকটা বেড়েছে। বৃহস্পতিবার দিনের শুরুতে আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার; এক সপ্তাহ আগে ছিল ২০ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার।
গত বছরের আগস্টের একই সময়ে ১৪৩ কোটি ১০ লাখ ডলার প্রবাসী আয় এসেছিল। সেই হিসাবে চলতি বছর একই সময়ে ৬৪ কোটি ডলার বেশি প্রবাসী আয় এসেছে।
বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১২০ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ২৪ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। প্রতিদিন গড়ে এসেছে ৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার; টাকার অঙ্কে ৮৮৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকা।
মাসের বাকি তিন দিনে (২৯ থেকে ৩১ আগস্ট) এই হারে এলে মাস শেষে এই অঙ্ক ২২৯ কোটি ২৮ লাখ (২.১৯ বিলিয়ন) বিলিয়ন ডলারে গিয়ে পৌঁছবে। টাকার অঙ্কে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ গিয়ে ঠেকবে ২৭ হাজার ৫১৪ কোটি টাকায়।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রবাহে যে ধাক্কা লেগেছিল তা কেটে গেছে; বাড়ছে দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক।
বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার বিপরীতে ডলারের দর আরও দুই টাকা বাড়ায় রেমিটেন্স প্রবাহে গতি বেড়েছে বলে মনে করছেন ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা। এছাড়া দেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার-পরিজনের কাছে বেশি অর্থ পাঠানো রেমিটেন্স বাড়ার একটি কারণ বলে জানিয়েছেন তারা।
গত ২০ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের দাম আরও ২ টাকা বেড়েছে। এখন আন্তঃব্যাংক মুদ্রা বাজারে প্রতি ডলার ১২০ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। ব্যাংকগুলোও নগদ ডলার বিক্রিসহ সব ক্ষেত্রেই ১২০ টাকা দরে ডলার লেনদেন করছে।
২০ আগস্টের আগে আন্তঃব্যাংক লেনদেনসহ সব ক্ষেত্রেই ১১৮ টাকায় ডলার লেনদেন হয়।
গত বছরের আগস্টে ১৬০ কোটি (১.৬ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রেমিটেন্স কমেছিল। ওই মাসে ১৯১ কোটি ৩৫ লাখ (১.৯৩ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছিল ৬ কোটি ১৭ লাখ ডলার। টাকার অঙ্কে যা ছিল ৭২৮ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে দেশজুড়ে সহিংসতা, মৃত্যু, ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ, মামলা, গ্রেপ্তার ও প্রবাসীদের উৎকণ্ঠার প্রেক্ষাপটে জুলাই মাসে রেমিটেন্স কমেছিল বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।
ওই সময় আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত-সহিংসতার জন্য সরকারকে দায়ী করে দেশে রেমিটেন্স না পাঠাতে সোশাল মিডিয়ায় কেউ কেউ প্রবাসীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।
১৯ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংকিং কার্যক্রম চলে মাত্র এক দিন। শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলনের মধ্যে দেশজুড়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তা নিয়ন্ত্রণে ১৯ জুলাই রাত থেকে কারফিউ জারি করে সরকার। এরপর ২৩ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংক বন্ধ ছিল।
ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় ব্যাংকের অনলাইন লেনদেনও বন্ধ ছিল। কয়েক দিন লেনদেন বন্ধের পর ২৪ জুলাই ব্যাংক চালু হয়। ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ১৯ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই বৈধ পথে তথা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে কোনো প্রবাসী আয় আসেনি।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর রেমিটেন্স প্রবাহে আরও ধীরগতি লক্ষ্য করা যায়। ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু হয় অন্তর্বর্তী সরকারের; রেমিটেন্স প্রবাহেও গতি ফেরে।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে ২৫৪ কোটি ১৬ লাখ (২.৫৪ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছিল ৮ কোটি ৪৭ লাখ ডলার; টাকার হিসাবে দৈনিক রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিল এক হাজার কোটি টাকা।
একক মাসের হিসাবে জুন মাসের রেমিটেন্স ছিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এর আগে ২০২০ সালের জুলাই মাসে ২৬০ কোটি (২.৬ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিল প্রবাসীরা। গত বছরের জুনের চেয়ে এই বছরের জুনে ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি রেমিটেন্স এসেছিল দেশে।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে, যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২২-২৩) চেয়ে ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি।
দেশে দীর্ঘদিন ধরে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট চলছে। কোভিড মহামারির সময়ে একপর্যায়ে দেশে রিজার্ভের পরিমাণ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছিল। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্বে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের আমদানি খরচ অনেক বেড়ে যায়। একই সাথে প্রবাসী আয় ও রপ্তানিতে যথেষ্ট প্রবৃদ্ধি না হওয়ায় রিজার্ভ দ্রুত কমতে থাকে।
সংকট কাটাতে ও রিজার্ভ বাড়াতে প্রবাসী আয়সহ বিদেশ থেকে অর্থ আনতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত কয়েক মাসে এসব পদক্ষেপের ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিল প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স দেশে আসার ক্ষেত্রে। তবে জুলাই মাসে সেই ধারায় কিছুটা ছন্দপতন হয়।
রিজার্ভ বাড়ছে
রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ায় বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ খানিকটা বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৃহস্পতিবার ‘উইকলি সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, বৃহস্পতিবার দিনের শুরুতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলার।
এর আগে গত ২১ জুন রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওইদিন হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংক বিপিএম-৬ হিসাবের রিজার্ভকে ‘তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য’ রিজার্ভ হিসাবে দাবি করে।
সবশেষ গত জুন মাসের আমদানির তথ্যও প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, ওই মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছিল।
সে হিসাবে ‘তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য’ বর্তমানের ২০ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ দিয়ে প্রায় সাড়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।