“পায়ের রিকশায় খাটনি (পরিশ্রম) বেশি, ইনকাম কম; আর ব্যাটারি রিকশায় খাটনি কম, ইনকাম বেশি। তাই পায়ের রিকশা আর চালাইতে মন চায় না।” প্যাডেল রিকশা বাদ দিয়ে ব্যাটারি রিকশা চালানো শুরু করার কারণ এভাবেই বর্ণনা করছিলেন বদরুল খন্দকার।
৩৫ বছর বয়সী বদরুল খন্দকারের বাড়ি রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলায়। বর্তমানে ঢাকার কল্যাণপুরের পোড়া বস্তিতে থাকেন তিনি। কিছুদিন আগেও প্যাডেল রিকশা চালাতেন, তবে এখন ব্যাটারি রিকশাই চালান।
বদরুল সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “পায়ে টানা রিকশা দিনে ৭-৮ ঘণ্টার বেশি চালানো যায় না। একদিন চালাইলে শরীর ব্যথায় আরেকদিন বইসা থাকা লাগে। তার ওপর যাত্রীরা এখন ওই রিকশায় উঠতে চায় না। তাই অটো চালানো শুরু করছি।”
শনিবার সকালে কল্যাণপুর নতুনবাজার এলাকায় একটি চায়ের দোকানে বসে কথা হয় বদরুলের সঙ্গে। তিনি জানান, তার সঙ্গে আরও অনেকেই প্যাডেল রিকশা ছেড়ে ব্যাটারি রিকশা চালাচ্ছেন।
রাস্তায় তাকাতেই এর সমর্থন মেলে। ব্যাটারি রিকশার ভিড়ে এখন প্যাডেল রিকশার কমই দেখা যাচ্ছে। শুধু কল্যাণপুরই নয়, গোটা ঢাকার চিত্র একই।
অথচ এই ব্যাটারি রিকশার সরকারিভাবে কোনও অনুমোদনই নেই। গত বছরের মে মাসে একবার আওয়ামী লীগ সরকার, গত নভেম্বর মাসে আবার অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাটারি রিকশা বন্ধ করতে চেয়েছিল। কিন্তু বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ করে সড়কে চলাচলের দাবি আদায় করে নেয় চালকরা।
তারপর থেকে ব্যাটারি রিকশার বাড়-বাড়ন্তে বিপদে পড়েছে প্যাডেল রিকশার গ্যারেজের মালিকরা। আগে যেখানে রিকশা নিয়ে চালকদের টানাটানি চলত, এখন সেখানে খুঁজেও চালক পাচ্ছে না তারা। ফলে দিনরাত গ্যারেজেই পড়ে থাকছে প্যাডেল রিকশাগুলো।
মোহাম্মদপুরের জহুরি মহল্লার একটি গ্যারেজের মালিক বাবু বিশ্বাস। ৪৫ বছর আগে তার বাবা ইস্কান্দার বিশ্বাসের হাত ধরে গড়ে উঠেছিল এই গ্যারেজ। সেসময় সারা ঢাকায় এটি ‘বিশ্বাসের গ্যারেজ’ নামে পরিচিত ছিল। পরিচিতি এখনও ্আছে, কিন্তু ব্যবসা আগের মতো নেই।
বাবু বিশ্বাস সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমাদের গ্যারেজে এক সময় দেড়শর বেশি রিকশা ছিল। এত রিকশা থাকার পরও চালকদের টানাটানি পড়ে যেত। একজন চালক রিকশা জমা দেওয়ার আগেই তা নেওয়ার জন্য আরেকজন বসে থাকত।
“আর এখন গ্যারেজে রিকশায় আছে মাত্র ৫০টি। কিন্তু সেগুলোও গ্যারেজেই পড়ে আছে, চালকের দেখা পাচ্ছি না।”
প্যাডেল রিকশা সারা দিনের জন্য নিলে একজন চালককে ১২০ টাকা দিতে হয় এই গ্যারেজের মালিককে। আধা বেলার (সকাল ৫টা থেকে দুপুর ২টা কিংবা দুপুর ২টা থেকে রাত ১২টা) জন্য মালিক পান ৭০ টাকা।
গ্যারেজে বসে কথা বলার সময়ই বাবু বিশ্বাস সার বেঁধে তালা দিয়ে রাখা রিকশাগুলোকে দেখান।
তিনি বলেন, “বছর খানেক আগেও চালকের অভাব ছিল না। পরিচিত-অপরিচিত চালকরা সকাল দুপুর গ্যারেজে ধরনা দিত রিকশার জন্য। সেই সময় দুপুরে গ্যারেজে চালক থাকত, রিকশা থাকত না।
“আর এখন দেখেন, সবগুলো রিকশা পড়ে আছে। আজ মাত্র ৮টা রিকশার চালক পাইছি। অনেক রিকশা গ্যারেজে বসে থাকতেই থাকতেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”
প্যাডেল রিকশার চালক না পাওয়ার জন্য ব্যাটারি রিকশাকে দায়ী করেন বাবু বিশ্বাস।
“চালক পাইবেন কীভাবে? কে আর চায় পরিশ্রম বেশি করতে? আরামের জন্য সবাই অটো চালাইতেছে। তাদের তো আর দোষ দিতে পারি না। কিন্তু আমাদের ব্যবসা তো শেষ! গত ১৫ দিনে গ্যারেজের মিস্ত্রি আর সিকিউরিটির বেতন দিয়ে ১ হাজার টাকাও ঘরে নিয়ে যাইতে পারি নাই।”
“সরকার হয় অটো রিকশা তুলে দিক, না হয় নিবন্ধন দিয়ে চালানোর অনুমতি দিক। অটো চলবে, না কি বন্ধ হবে, সেই সিদ্ধান্ত না আসায় আমরা অটো রিকশা বানানোরও সাহস পাচ্ছি না,” ক্ষোভের সুরে বলেন তিনি।
বাবু বিশ্বাস কোনোরকমে ব্যবসা ধরে রাখলেও মো. আলাউদ্দীন সেটাও পারেননি। চালকের অভাবে গ্যারেজ বন্ধই করে দিয়েছেন। রিকশাগুলো বেচতে না পেরে নামমাত্র দামে বিক্রি করেছেন ভাঙারির দোকানে।
হতাশ কণ্ঠে আলাউদ্দীন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “একেকটা রিকশা বানাইতে আমার খরচ পড়ছিল ২৫ হাজার টাকার মতো। কিন্তু সেই রিকশা আমি কেজি দরে বেচছি ভাঙারির দোকানে।
“আগে পুরান রিকশার দামও ১০ হাজার টাকার বেশি ছিল, এখন ব্যবসা আর নাই বইলা কেউ পুরান রিকশা কিনতে চায় না। পরে ভাঙারির দোকানে বেইচা একেকটা রিকশার দাম পাইছি ১৫০০ টাকার মতো। ২০টা রিকশা বেইচাও একটা অটোরিকশার দাম পাই নাই!”
গ্যারেজ ছেড়ে রিকশা বিক্রির অর্থে এখন ফুটপাতে কাপড়ের দোকান দিয়েছেন আলাউদ্দীন।
ঢাকা শহরের রাস্তায় একসময় বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে কয়েক লাখ প্যাডেল রিকশা চললেও এখন সেই সংখ্যা ৫০ হাজারের আশপাশে নেমে এসেছে বলে দাবি করেছেন রিকশা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং রিকশা মালিক ঐক্য জোটের সহ সাধারণ সম্পাদক মো. মজিবুর রহমান মজিদ।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমাদের সমিতির হিসাব মতে ঢাকায় এখনও ৩ লাখ প্যাডেলচালিত রিকশা আছে। কিন্তু রাস্তায় চলে ৫০ হাজারের মতো। চালকের অভাবে বাকি সব রিকশা গ্যারেজে বসা। আমার গ্যারেজেই ১০০ রিকশা আছে, কিন্তু আজ সড়কে বাইর হইছে মাত্র ২০টা।”
৩০ বছর ধরে রিকশার গ্যারেজ চালাচ্ছেন মজিদ, আদাবরে ৯ কাঠা জায়গার ওপর তার গ্যারেজ। প্রতি মাসে তাকে এখন ৭০ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়।
তিনি হিসাব দেন, আগে গ্যারেজে মিস্ত্রি ছিল দুজন, এখন আছে একজন। তার মাসিক বেতন ২১ হাজার টাকা। দুই শিফটে দুজন ম্যানেজার, তাদের বেতন ২৭ হাজার টাকা। এছাড়া প্রতি মাসে গ্যারেজে বিদ্যুৎ বিল ৩০ হাজার টাকা, পানির বিল ৬ হাজার টাকা, ও গ্যাস বিল দিতে হয় ৪ হাজার টাকা।
সব মিলিয়ে গ্যারেজে প্রতি মাসে খরচ দেড় লাখ টাকার বেশি হয় জানিয়ে মজিদ বলেন, “এখন প্রতি মাসে খরচের টাকাও উঠে না। লোন করে ব্যবসাটা টিকিয়া রাখছি। এভাবে তো আর বেশিদিন চালাইতে পারুম না।”
রিকশার মালিকদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাইলে সমিতির নেতা মজিদ বলেন, “ঢাকা শহরে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের আদেশ দিয়েছিলেন হাই কোর্ট। কিন্তু গত ২৫ নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের এক আবেদনের শুনানি শেষে হাইকোর্টের আদেশে ১ মাসের সিস্থাবস্থা দেন চেম্বার আদালত। সেই হিসেবে গত ২৫ ডিসেম্বর এক মাস শেষে হয়েছে। এরপর তো আর কোনো কিছু শুনছি না।
“আমরা আগামীকাল (৫ জানুয়ারি) আবারও আদালতে যাব। আমরা অটোরিকশার বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত চাই। অটো রিকশা চলাচলের অনুমতি দিলে আমরাও প্যাডেলচালিত রিকশা বাদ দিতে চাই। কিন্তু সেক্ষেত্রে নিবন্ধনের ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা চাই বৈধভাবে ব্যবসা করতে।”