‘জীবন খাতা’, ‘ছাড়িয়া যাইওনারে বন্ধু মায়া লাগাইয়া’, ‘আসমানে যাইয়ো না রে বন্ধু’, ‘আমি এক পাপিষ্ঠ বান্দা’, ‘রেলগাড়ির ইঞ্জিন’। শ্রোতাপ্রিয় এমন অসংখ্য গানের রচয়িতা ও শিল্পী সিলেটের মতিউর রহমান হাসান। সবার কাছে যিনি পরিচিত পাগল হাসান নামে। বৃহস্পতিবার সকালে এক সড়ক দুর্ঘটনায় বন্ধ হয়ে গেল পাগল হাসানের জীবন খাতা।
অগণিত ভক্ত অনুরাগীদের শোক সাগরে ভাসিয়ে তিনি চলে গেলেন পরপারে। একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার থেকে নিজ গ্রাম ছাতকের কালারুকা ইউনিয়নের শিমুলতলা মুক্তিরগাঁওয়ে ফিরছিলেন পাগল হাসান। পথিমধ্যে ছাতকের সুরমা সেতুর টোল প্লাজার কাছে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে দুমড়েমুচড়ে যায় অটোরিকশাটি।
ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান কণ্ঠশিল্পী হাসান (৩৫) ও সিএনজির আরেক যাত্রী আব্দুস সাত্তার (৪৫)। গুরুতর আহত হন সিএনজি চালকসহ আরও ৩ জন। মতিউর রহমান হাসানের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে সিলেট ও সুনামগঞ্জের সংস্কৃতি অঙ্গনে। তার মৃত্যুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে শোক প্রকাশ করেন অনেকে।
সুনামগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শামসুল আবেদিন বলেন, “পাগল হাসান একজন সম্ভাবনাময় শিল্পী ছিলেন। তার কণ্ঠে ফোকগান অন্যরকম আবেদন সৃষ্টি করত। সে নিজে গান বাঁধত, সুর করত এবং গাইত। তার গান যেমন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, তেমন সংগীত বোদ্ধারাও মুগ্ধ হয়েছেন। তাকে হারিয়ে শিল্পীসমাজ শোকে স্তব্ধ।”
সিলেটের সম্মিলিত নাট্য পরিষদের সভাপতি রজত কান্তি গুপ্ত ফেইসবুকে লিখেছেন, “শিল্পীর মৃত্যু নেই। তোমার কন্ঠ আমাদের কাছে চিরঞ্জীব হয়ে থাকবে। পরপারে ভালো থেকো ভাই।”
শোক প্রকাশ করে অধ্যাপক ও লেখক এনামুল কবীর ফেইসবুকে লিখেছেন, “লোকটা গানের মানুষ ছিলেন। ভিন্ন এক গায়কী ছিল আমাদের এই পাগল হাসানের। এই সময়ে পাগল হাসান আমাদের এতদঞ্চলে অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক শিল্পীসত্তার নাম হয়ে উঠেছিলেন। হাসান নিজে গান লিখতেন এবং সুর করে এসব গাইতেনও। স্বকীয় একটা স্বর এই মানুষটি যোগ করে নিতে সক্ষম হয়ে উঠেছিলেন। একটা লোকগ্রাহ্য ও বন্দনার জায়গায় নিজেকে স্থাপন করে নিয়েছিলেন। তাই এটা বলা যায় এই মানুষটা- পাগল হাসানকে আমরা সহজে ভুলছি না।”
হাসানের আত্মার শান্তি কামনা করে সুনামগঞ্জের সাংবাদিক ও লেখক শামস শামীম বলেন, “ছোট জীবনে, সঙ্গীত পরিভ্রমণে বিশাল অর্জন ছিল পাগল হাসানের। মঞ্চ মাতিয়ে রাখা, শ্রোতাদের মন বুঝে সঙ্গীত পরিবেশন করা; তাদেরকে বুদ রাখা ছিল তার অসাধারণ গায়কী গুণ। তুরুমতারাজ সময়ে এই অঞ্চল তথা নেট দুনিয়ার একটা বিশাল গোষ্ঠীকে গানে মাতিয়ে রেখেছিলেন পাগল হাসান। তার মর্মান্তিক মৃত্যুতে শোকে স্তব্দ আমি।”
সিলেটের সাংবাদিক ও লেখক ইয়াহইয়া ফজল ফেইসবুকে লিখেছেন, “সকালের সূর্যের মতো তিনি জানান দিচ্ছিলেন আলোকময় ভবিষ্যতের। ছাতকের শিমুলতলা গ্রামে বসে তার কলম আর বাদ্যযন্ত্রের কারুকাজ আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছিল ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে। কিন্তু এই অনিরাপদ সড়কের দেশ, এই খুনি সড়ক, সড়কের ‘মুর্খ’ চালকরা কী আর বুঝে মানুষের জীবনের মূল্য? আর তাই সড়কে প্রাণ দিতে হলো এই মেধাবী মানুষকে।”
এ প্রসঙ্গে লেখক আলমগীর শাহরিয়ার ফেইসবুকে লেখেন, “বেপরোয়া বাস ড্রাইভার কেড়ে নিল ভাটির বাউল গানের প্রতিভাবান শিল্পী পাগল হাসানের জীবন। এটা নিছক দুর্ঘটনা নয়, হত্যাকাণ্ড। আমি শুধু শোক নয়, এই ঘাতক ড্রাইভারদের দৃষ্টান্তমূলক বিচারও চাইছি। এদের জন্য বাংলাদেশের রাস্তাঘাট আজ ভয়ানক অনিরাপদ।”
ছাতক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “শিল্পী হাসানের মৃত্যুতে ছাতকের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তার পরিবারে দুই শিশু সন্তান, মা ও স্ত্রী রয়েছেন।”