পরিচালক-প্রযোজক করন জোহরের ধর্মা প্রোডাকশন ২০২৪ সালের অক্টোবরে তাদের হিন্দি ভাষার চলচ্চিত্র জিগরা (সাহস) প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। খুব কম লোকই জানতেন ৪৫ বছর বয়সী প্রযোজনা সংস্থা ধর্মা টিকে থাকার জন্যই সংগ্রাম করছিল। ২০১৯ সাল থেকে ধর্মার বেশিরভাগ চলচ্চিত্র ভালো ব্যবসা করেনি, এবং ২০২৪ সালে এই প্রযোজনা সংস্থার চারটি সিনেমার মধ্যে মাত্র একটি বিনিয়োগের কিছু অর্থ পুনরুদ্ধার করতে পেরেছিল।
ধর্মার নিট মুনাফা ২০২৩ অর্থবছরে ১২ লাখ মার্কিন ডলার থেকে ২০২৪ সালে এসে ৬৮,১৩৫ ডলারে নেমে যায়। জানা গেছে, এর ব্যবস্থাপক এবং পরিচালকদের কয়েক মাস ধরে বেতন দেওয়া হয়নি।
দুই দশক আগে ২০০৪ সালে নিজের বাবার মৃত্যুর পর ধর্মা প্রযোজনা সংস্থার উত্তরাধিকারী হন বর্তমানে ৫২ বছর বয়সী করন জোহর। প্রযোজনা সংস্থা টিকিয়ে রাখতে লগ্নি বাড়াতে তিনি ৫০ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করার জন্য আলোচনা করছিলেন।
থাইল্যান্ডে নির্মিত থ্রিলার সিনেমা ‘জিগরা’ তৈরিতে ৮০ কোটি রুপি (৯.২ মিলিয়ন ডলার) খরচ হয়েছে। এতে বলিউড অন্যতম শীর্ষ অভিনেত্রী আলিয়া ভাট অভিনয় করেন, যিনি সহ-প্রযোজক হিসেবেও যুক্ত ছিলেন। প্রযোজনা সংস্থা ধর্মার ভেতরে এবং বক্সঅফিসে কানাঘুষা ছিল যে ‘জিগরা’ বক্স অফিসে সাফল্যা নাও পেতে পারে।
সংক্ষেপে, ধর্মা প্রোডাকশন আর্থিক সংকটে ভুগছিল এবং তাদের আসন্ন চলচ্চিত্র জিগরা নিয়েও অনিশ্চয়তা ছিল।
তবে, জিগরা একটি হিট সিনেমা হতে চলেছে এমন একটি ধোঁয়াশা বজায় রাখার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল প্রযোজনা সংস্থা ধর্মা। মুক্তির কয়েক সপ্তাহ আগে, তারা চলচ্চিত্রের পোস্টার এবং ট্রেইলার প্রকাশ করে। নিজেদের সামাজিক মাধ্যমের অ্যাকাউন্টে তারা দাবি করে যে ট্রেলারটি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৪০ মিলিয়নেরও বেশি ভিউ পেয়েছে এবং ভক্তরা উত্তেজিত প্রতিক্রিয়া শেয়ার করেছে। ট্রেলার দেখে কেউ লিখেছেন- ‘সর্বাঙ্গে কাঁপুনি’, কেউ লিখেছেন ‘একেবারে দুর্দান্ত’।
কিন্তু এই মন্তব্যগুলোর বেশিরভাগই ছিল কন্টেন্ট ক্রিয়েটর এবং সিনেমা বা এর তারকাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের।
৭ অক্টোবর, চলচ্চিত্র মুক্তির চার দিন আগে, জোহর ‘প্রিয় মিডিয়া সদস্যদের’ উদ্দেশ্যে একটি বিবৃতিতে বলেন, এখন থেকে ধর্মা তাদের চলচ্চিত্রের মুক্তির আগে সমালোচকদের জন্য আয়োজিত প্রি-রিলিজ স্ক্রিনিং করবে না, যা সাধারণত চলচ্চিত্রের মুক্তির এক বা দুই দিন আগে অনুষ্ঠিত হয়।
এটি ইউটিউবার, ভ্লগার এবং চলচ্চিত্রের রিভিউ দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের জন্য একটি বড় ধাক্কা ছিল। জোহর মূলত তাদের বলছিলেন যে তিনি আর ইতিবাচক পর্যালোচনার জন্য অর্থ দিবেন না। অর্থাৎ পেইড পিআর- এ তিনি নেই।
দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গের মতো হিট সিনেমার জন্য পরিচিত বলিউডের পরিচিত প্রযোজনা সংস্থা যশ রাজ ফিল্মস (ওয়াইআরএফ)- এর একজন সিনিয়র এক্সিকিউটিভ নাম গোপন রাখার শর্তে আল-জাজিরাকে বলেন, “চলচ্চিত্র শিল্পে এটি একটি ওপেন সিক্রেট যে ৭০-৮০ শতাংশ পর্যালোচনা পেইড রিভিউ। অন্যান্য ব্যবসার মতো পেইড রিভিউ এই ব্যবসার একটি অংশ।”
আল জাজিরা ২০ জনেরও বেশি চলচ্চিত্র পেশাদার, সমালোচক, পিআর এক্সিকিউটিভ এবং সোশ্যাল মিডিয়া পর্যালোচকদের সঙ্গে কথা বলেছে, যারা নিশ্চিত করেছেন বলিউডে অর্থ নিয়ে সিনেমার ব্যাপারে ইতিবাচক রিভিউ দেওয়া একটি সাধারণ ব্যাপার। অর্থ ছাড়া কোন সিনেমার রিভিউ তারা করেছেন- সেটির নাম মনে করতেই তারা হিমশিম খেয়েছেন।
তবে এদের বেশিরভাগই একমত হয়েছেন যে প্রচুর ইতিবাচক রিভিউও বাজে সিনেমাকে বক্সঅফিসে হিট বানাতে পারে না। তবে তারা বলছেন, যে ইতিবাচক রিভিউ প্রথম সপ্তাহে একটি চলচ্চিত্রের ব্যবসাকে ১০-১৫ শতাংশ বাড়াতে বা কমাতে পারে। আর এখন চলচ্চিত্রের মুক্তির আগেই রিভিউ ভাইরাল হয়ে যায়।
প্রযোজক এবং অভিনেতারা ইতিবাচক পর্যালোচনার জন্য অর্থ দেন এই আশায় যে, মানুষের মুখে মুখে ইতিবাচকতা ছড়িয়ে পড়বে, যা চলচ্চিত্র বিপণনের ‘হলি গ্রেইল’ আর এই প্রচরণাই প্রথম সপ্তাহে সিনেমাটিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
প্রযোজনা সংস্থা ওয়াইআরএফ নির্বাহী আল জাজিরাকে জানান, এমনকি পেইড প্রচারণার জন্য ‘একটি মেনু কার্ড রয়েছে। আপনি যা চান তা বেছে নিন এবং সবকিছুর জন্য একটি নিদির্ষ্ট হার নির্ধারণ করা রয়েছে।”
ওয়াইআরএফ নির্বাহী দাবি করেন, তাদের প্রযোজনা সংস্থাই একমাত্র যারা প্রি-রিলিজ স্ক্রিনিং করে না এবং রিভিউ-এর জন্য অর্থ দেন না।
প্রযোজক এবং চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কাছে পাঠানো পিআর এবং মার্কেটিং সংস্থাগুলোর পাঠানো কিছু ‘রেট কার্ড’ আল জাজিরার কাছে এসে পৌঁছেছে। ওই রেট কার্ডটি একটি নির্দিষ্ট চলচ্চিত্রের প্রচারের জন্য তৈরি করা হয়েছে। প্রচারের তালিকার মধ্যে রয়েছে ভারতের কিছু শীর্ষস্থানীয় সংবাদ সংস্থা, বিনোদন পোর্টাল, বাণিজ্য বিশ্লেষক, সোশ্যাল মিডিয়া পর্যালোচক এবং কন্টেন্ট নির্মাতাদের দ্বারা ধার্য করা ফি। বেশিরভাগ সংস্থা ইতিবাচক নিবন্ধ এবং সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টের জন্য বিভিন্ন সেবা এবং প্যাকেজ ডিল অফার করে।
মুক্তি দেওয়ার দিনে সিনেমা হল থেকে লাইভ টুইট করা, উচ্চ তারকা রেটিং দেওয়া, ভালো রিভিউ দেওয়া এবং হ্যাশট্যাগ এবং মেম দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রেন্ড তৈরি করার জন্য চুক্তি করা হয়।
প্রযোজকরা তাদের সিনেমা মুক্তির আগে এবং পরে একটি চলচ্চিত্র সম্পর্কে গুঞ্জন তৈরি করার জন্য তিন থেকে ছয় মাস দীর্ঘ প্যাকেজও বেছে নিতে পারেন। এই চুক্তিগুলোতে, চলচ্চিত্রের পোস্টার, এর ট্রেলার, গান এবং বক্স অফিস পূর্বাভাস থেকে শুরু করে সবকিছু নিয়ে আলোচনা করা হয় এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রেন্ড করা হয়।ৱ
প্রতিষ্ঠিত মিডিয়া সংস্থা, কিছু বিনোদন পোর্টাল এবং কয়েকজন সুপরিচিত বাণিজ্য বিশ্লেষকের সঙ্গে পেইড নিবন্ধের চুক্তিগুলো আনুষ্ঠানিক। এগুলো আগে থেকে করা হয় এবং পাঁচ মিলিয়ন রুপি (৫৭,৭৪১) থেকে ৫০ মিলিয়ন রুপি (৫৭৭,৪১০) পর্যন্ত খরচ হতে পারে।
প্রতিষ্ঠিত মিডিয়া সংস্থাগুলোর সঙ্গে চুক্তিগুলোতে সাধারণত চলচ্চিত্রের পর্যালোচনা অন্তর্ভুক্ত থাকে না, তবে চুক্তি হলে খারাপ পর্যালোচনা বা রিভিউ এর সুর নরম হয়ে যায়।
চলচ্চিত্রের প্রভাবশালী এবং কিছু স্বতন্ত্র সমালোচকদের সঙ্গে চুক্তিগুলো প্রায়ই নগদ-ভিত্তিক হয়। চলচ্চিত্র প্রিভিউয়ের আগে-পরে এই আলোচনা করা হয়। একটি চলচ্চিত্র সম্পর্কে উত্তেজনা যত কম, রিভিউয়ার বা সমালোচকের দাম তত বেশি।
কিন্তু সম্প্রতি, সেই ব্যবসায়িক মডেলে কিছু ফাটল দেখা দিতে শুরু করেছে।
এটি ‘সম্পূর্ণ চাঁদাবাজি’
বলিউডের প্রযোজনা সংস্থাগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচক এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পেছনে ছুটছে, প্রিভিউয়ের জন্য তাদের মুম্বাইয়ে উড়িয়ে আনছে, হোটেলে রাখছে, আইফোন উপহার দিচ্ছে এবং ইতিবাচক পর্যালোচনা লেখার জন্য অর্থ দিচ্ছে।
কিন্তু প্রতি সপ্তাহে আরও বেশি নতুন নতুন লোক গজিয়ে উঠছে। এবং এখন এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছেছে যে আপনি যদি এই লোকদের মধ্যে কয়েকজনকে অর্থ না দেন, তবে তারা আপনার সিনেমাকে আঘাত করতে শুরু করবে। “এটি সম্পূর্ণ চাঁদাবাজি,” একজন চলচ্চিত্র পরিচালক বলেছেন।
ধর্মা প্রোডাকশনেরও একই অভিজ্ঞতা হয়েছে। ধর্মার ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র আল জাজিরাকে জানায়, তাদের আর্থিক অবস্থা ইতিমধ্যে খারাপ ছিল, হয়রানি এবং অতিরিক্ত খরচগুলো তাদের জন্য পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছিল। যার ফলে কোম্পানি সিদ্ধান্ত নেয় যে এটি বন্ধ করার সময় এসেছে।
গত বছরের ১১ অক্টোবর জিগরা মুক্তি পায় এবং বেশিরভাগ নেতিবাচক পর্যালোচনা এবং ট্রল এর শিকার হয়। ধর্মা প্রোডাকশন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের এড়িয়ে চললেও, তারা প্রতিষ্ঠিত মিডিয়া প্রকাশনাগুলোর সঙ্গে তাদের চুক্তি বজায় রেখেছিল। তাদের সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেলে, তারা সেই মিডিয়া হাউস এবং পর্যালোচকদের কাছ থেকে উচ্চ তারকা রেটিংসহ পোস্টার প্রচার করেছে।
কিছু ইতিবাচক সোশ্যাল মিডিয়া পর্যালোচনার মধ্যে একটি আলাদাভাবে চোখে পড়ার মতো ছিল। এটি কেবল উজ্জ্বল ছিল না, বরং এমন একজনের কাছ থেকে ছিল যিনি বলিউডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন।
ক্রিকক্রেজিজনস, এক্স-এ ৬০০,০০০ এরও বেশি ফলোয়ার সহ একটি ক্রিকেট প্রভাবশালী হ্যান্ডেল, প্রতি টুইটের জন্য ৩০,০০০ রুপি পর্যন্ত চার্জ করে। এটি দক্ষিণ ভারতের এক যুবক চালান, যিনি হিন্দি খুব বেশি বোঝেন না। তবুও তাকে মাঝে মাঝে চলচ্চিত্র এবং অভিনেতাদের অভিনয় সম্পর্কে টুইট করার জন্য বলিউড নিযুক্ত করে। কী বলতে হবে সেটি সাধারণত তাকে সরবরাহ করা হয়।
১১ অক্টোবর, তিনি টুইট করেছেন: “জিগরা একটি গেম-চেঞ্জার। আলিয়া ভাট উজ্জ্বল … এই আবেগপূর্ণ রোলারকোস্টারটি অবশ্যই দেখার মতো।”
সিনেমা হলে দর্শকরা ভিড় করছে, টিকেট পাওয়া যাচ্ছে না- এটি দেখাতে বাজাকৌশল হিসেবে জিগরার প্রযোজকরা এমনকি থিয়েটারের টিকেট পর্যন্ত কিনেছিল। “কিন্তু মোট ব্যবসা এত কম ছিল যে এটি সত্যিই কোনো পার্থক্য তৈরি করেনি,” প্রবীণ চলচ্চিত্র পরিবেশক রাজ বনসাল আল জাজিরাকে বলেন।
জিগরা ফ্লপ হয়, এর ব্যয়ের এক তৃতীয়াংশও পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। কেউ কেউ এর হতাশাজনক পারফরম্যান্সের কারণ হিসেবে এটিকে একটি নিস্তেজ চলচ্চিত্র বলে মনে করেন। কিন্তু অন্যদের জন্য, জিগরার ভাগ্য তাদের বিশ্বাসকে আরও শক্তিশালী করেছে যে বলিউড এখন তাদের তৈরি করা ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের হাতে জিম্মি।
‘এটি কর্মফল’, প্রযোজক এবং বাণিজ্য বিশ্লেষক গিরিশ জোহর আল জাজিরাকে বলেছেন।
তিনি বলেন, “এই প্রযোজনা সংস্থাগুলোই তথাকথিত চলচ্চিত্র সমালোচকদের লালন-পালন, আদর এবং পৃষ্ঠপোষকতা করেছে।”
এটি নিয়ে আল জাজিরার বিশদ প্রশ্নাবলীর কোনও জবাব দেননি করন জোহর।
গত ছয় থেকে সাত বছর ধরে বলিউড সংগ্রাম করছে। কারণ বলিউডের বেশিরভাগ উচ্চাভিলাষী, বড় বাজেটের চলচ্চিত্র ফ্লপ হয়েছে। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি আয় করা সিনেমাগুলো এসেছে দক্ষিণের প্রযোজনা সংস্থা এবং পরিচালকদের কাছ থেকে। কিন্তু ভালো সিনেমা তৈরির জন্য তাদের সম্পদ বিনিয়োগ করার পরিবর্তে, বলিউড সবকিছু ঠিক আছে এমন একটি ‘ভ্রম’ তৈরি করতে বিনিয়োগ করছে।
“যারা ধারণা পরিচালনা করতে চাযন তাদের অনেকেই এই ধরনের কাজ করে। পুরো ইকোসিস্টেম অর্থ উপার্জন করে, তবে এটি বক্স অফিসের দিক থেকে একটি চলচ্চিত্রের ভাগ্য পরিবর্তন করে না,” ওয়াইআরএফ-এর সিনিয়র এক্সিকিউটিভ বলেছেন। “ওয়াইআরএফ এটি করে না ( রিভিউ এর জন্য অর্থ দেওয়া), কারণ তাহলে ভালো অর্থ খারাপ অর্থের পেছনে ছুটবে। (এবং) একবার আপনি সেই খেলা খেললে, তাতে ঢুকে যাবেন।”
জিগরা মুক্তির প্রায় দুই সপ্তাহ পরে, করণ জোহর ১০ বিলিয়ন রুপি (১১৬ মিলিয়ন ডলার) এর বিনিময়ে বিশ্বের বৃহত্তম ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক, সিরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আদার পুনাওয়ালার কাছে ধর্মা প্রোডাকশনের ৫০ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করেন। বলিউডের আরও বেশ কয়েকটি প্রযোজনা সংস্থাও তহবিল সংগ্রহের জন্য তাদের কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করতে চাইছে।
ওয়াইআরএফ-এর সিনিয়র এক্সিকিউটিভ এইসব বিনিয়োগাকারীদের বলছেন, ‘অপ্রাসঙ্গিক, অভিজ্ঞতাহীন লোক’।
ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্প বিশ্বের দ্বিতীয় প্রাচীনতম। বিশ্বের বৃহত্তম চলচ্চিত্র প্রযোজকও দেশও ভারত। এটি প্রায় ২০টি ভাষায় প্রতি বছর ১,৭০০-১,৮০০টি চলচ্চিত্র তৈরি করে, যা প্রায় ২০০ বিলিয়ন রুপি (২.২ বিলিয়ন ডলার) মোট আয় করে। এর মধ্যে মাত্র এক দশমাংশ বলিউড চলচ্চিত্র। তবুও, বলিউডের অতি-নাটকীয় মেলোড্রামাগুলো শুধু আয়ের বৃহত্তম অংশেই অবদান রাখে না, বরং বিশ্বজুড়ে একটি অন্ধ ভক্তগোষ্ঠী তৈরি করেছে, যা এটিকে ভারতের শক্তিশালী ‘সফট পাওয়ার’ এ পরিণত করেছে।
মুম্বাই– ভারতের আর্থিক রাজধানী, যা হিন্দি ভাষার চলচ্চিত্র শিল্পের কাছ থেকে ‘স্বপ্নের শহর’ উপাধি পেয়েছে। বলিউড চলচ্চিত্র ম্যাগাজিন, সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার, জনসংযোগ এবং বিপণনসংস্থাগুলোর একটি সহায়ক পরিবেশের জন্ম দিয়ে শোবিজকে করে তুলেছে আকর্ষণীয়। এটি চলচ্চিত্র এবং চলচ্চিত্র তারকাদের সম্পর্কে ভারতীয়দের অতৃপ্ত কৌতূহল মিটিয়ে আসছে।
১৯৬০, ৭০ এবং ৮০-এর দশক জুড়ে, যখন চকচকে চলচ্চিত্র ম্যাগাজিনগুলো নিউজস্ট্যান্ডে আধিপত্য বিস্তার করত, তখন বলিউড সিনেমাগুলো বড় একক পর্দার থিয়েটারে কয়েক মাস ধরে চলত, তাদের সাফল্য রৌপ্য এবং স্বর্ণ জয়ন্তী (যথাক্রমে ২৫ এবং ৫০ সপ্তাহ) দ্বারা পরিমাপ হতো।
কিন্তু বড় তারকা, ব্লকবাস্টার হিট এবং রাতারাতি তারকা হওয়ার ঝলমলে আড়ালের পিছনে নিরাপত্তাহীনতা, ভঙ্গুর অহংকার, ঈর্ষা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা লুকিয়ে ছিল। বলিউডে সর্বদা দল এবং গোষ্ঠী ছিল এবং মাঝে মাঝে অর্থ লেনদেন সম্পর্কে গুজব ছড়িয়ে পড়ত। কিন্তু সেইসব দিনগুলোয় এগুলো কেবল অভিনেতা, পরিচালক এবং প্রযোজকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, যারা নিজেদের চলচ্চিত্রে ভালো প্রচারণার জন্য ‘সার্ভিস ফি’ হিসেবে কম বেতনের চলচ্চিত্র সাংবাদিকদের হাতে সামান্য নগদ অর্থের খাম দিতেন।
২০০০-এর দশকের শুরুতে এটি পরিবর্তন হওয়া শুরু করে।
২০০৩ সালে, ভারতীয় সরকার চলচ্চিত্রকে ‘শিল্প’ মর্যাদা দেওয়ার দুই বছর পরে, প্রাতিষ্ঠানিক অর্থের পথ প্রশস্ত হয়। বিশ্বের অন্যতম সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজি ভাষার দৈনিক পত্রিকা দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া মিডিয়া নেট চালু করে, যা চলচ্চিত্রের গল্প, চলচ্চিত্র তারকা, ফ্যাশন, জীবনধারা এবং ইভেন্টগুলো অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করতে শুরু করে।
এই পেইড নিউজ মডেলটি– এমন এক সময়ে যাত্রা শুরু করে যখন মাল্টিপ্লেক্সগুলো একক পর্দার থিয়েটারগুলোকে প্রতিস্থাপন করছিল এবং চলচ্চিত্রগুলোর অর্থ পুনরুদ্ধারের সময়সীমা ছোট হয়ে আসছিল। এটি তখন লাভজনক প্রমাণিত হয়েছিল। শিগগিরই অন্যান্য বেশ কয়েকটি সংবাদপত্রের মিডিয়া নেটের নিজস্ব সংস্করণ চালু করে।
একজন চলচ্চিত্র প্রচারক, যিনি এই নিবন্ধে উদ্ধৃত অনেকের মতো পরিচয় গোপন রাখার অনুরোধ করেছেন, বলেন, “এটি খুব সংগঠিত হয়ে ওঠে। বেশ কয়েকটি সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন এবং তাদের অনলাইন ডিজিটাল সংস্করণে, আপনি অর্থ প্রদান না করলে একটি চলচ্চিত্রের মুক্তির ১০-২০ দিন আগে এবং পরে [সিনেমা সম্পর্কিত কোনো লেখা] পেতেন না।”
ভারতের কিছু শীর্ষস্থানীয় প্রকাশনায় পেইড নিবন্ধগুলোর জন্য সাধারণত একটি বিজ্ঞাপনের তুলনায় ২০ থেকে ৫০ শতাংশ বেশি খরচ হয়। ওইসব প্রকাশনাগুলোকে অবশ্য পাঠককে বিভ্রান্ত করা এড়াতে অস্বীকৃতি এবং স্বতন্ত্র বিন্যাস যোগ করে পেইড গল্পগুলোকে নিয়মিত সংবাদ থেকে আলাদা করতে হয়। কিন্তু অস্বীকৃতিগুলো সবসময় স্পষ্ট নয়, বিশেষ করে যখন এটি বিনোদন এবং বলিউড সংবাদ সম্পর্কে হয়।
গত বছর, বলিউড ১৭০-১৮০টি চলচ্চিত্র মুক্তি দিয়েছে, যার মধ্যে শীর্ষ তারকাদের নিয়ে অনেক বড় বাজেটের চলচ্চিত্রও ছিল। বেশিরভাগ চলচ্চিত্র নিয়ে প্রচুর প্রচার এবং উচ্ছ্বসিত পর্যালোচনাও হয়। কিন্তু মাত্র চারটি সত্যিকারের হিট ছিল। মজার বিষয় হচ্ছে এর সবগুলোই হরর চলচ্চিত্র।
“যদি স্ত্রী ২, মুঞ্জা, শয়তান এবং ভুল ভুলাইয়া ৩ কাজ না করত, তবে ২০২৪ সাল শোকের বছর হত,” চলচ্চিত্র প্রদর্শক এবং পরিবেশক সঞ্জয় মেহতা আল জাজিরাকে বলেন।
বলিউডের দ্বিধা হলো চলচ্চিত্রের নির্মাণ খরচ বাড়লেও বিনিয়োগকৃত অর্থ উঠিয়ে আনার উপায় সঙ্কুচিত হয়ে গেছে।
একটি চলচ্চিত্রের আয়ের প্রায় ৬০ শতাংশ আসে দেশীয় থিয়েটার থেকে। একটি চলচ্চিত্রের ভাগ্য প্রথম সপ্তাহে নির্ধারিত হয়ে যায় এবং সেটাই তাদের বিনিয়োগ তুলে নিয়ে আসার সময়সীমা।
নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন, ডিজনি এবং অন্যান্য স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম, যারা তারকা কাস্ট বা পরিচালকের উপর ভিত্তি করে চলচ্চিত্র কিনত, ২০২৪ সালে সেই সিস্টেম পরিবর্তন করেছে। কারণ তারা বড় অঙ্কের বিনিময়ে যেসব বলিউড চলচ্চিত্রগুলো কিনেছিল সেগুলো বক্স অফিসে ফ্লপ হয়।
একজন সিনিয়র চলচ্চিত্র সমালোচক আল জাজিরাকে বলেছেন, “স্ট্রিমাররা এখন সিনেমা হলে মুক্তির পর ডিজিটাল স্বত্ব কেনে। তাই যখন আপনার সিনেমা ফ্লপ হয়, তখন শুধু থিয়েটারের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, স্ট্রিমারদের কাছ থেকে আপনি যে পরিমাণ অর্থ পান তাও কমে যায়। প্রথম সপ্তাহান্তে একটি সিনেমার ভালো পারফর্ম করার জন্য ঝুঁকি অনেক বেশি হয়ে গেছে।”
প্রবীণ চলচ্চিত্র বাণিজ্য বিশ্লেষক এবং সমালোচক কোমল নাহাতা বলেন, তিনি একটি সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টের জন্য ৬০,০০০ থেকে ৭০,০০০ রুপি (৭০০−৮০০) চার্জ করেন। “যদি এটি একটি চলচ্চিত্রের প্রচারের জন্য বাল্ক ডিল হয়, যেমন ১৪-১৫টি পোস্টের একটি প্যাকেজ, তাহলে চার্জ ৫,০০,০০০ রুপি থেকে ৭,০০,০০০ রুপি পর্যন্ত হতে পারে,” তিনি আল জাজিরাকে বলেছেন।
নাহাতা তার বাবার কাছ থেকে ফিল্ম ইনফরমেশন নামের একটি বাণিজ্য পত্রিকা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন। কিন্তু কোভিড বিশ্বকে আঘাত করার ঠিক আগে মুদ্রণ সংস্করণ বন্ধ করে ডিজিটাল হয়ে যান। তিনি জানান, আগে তিনি বিজ্ঞাপনের জন্য চার্জ করতেন এবং এখন তিনি সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টের জন্য চার্জ করেন, যাকে তিনি ‘বিজ্ঞাপন’ বলে উল্লেখ করে তাত্ত্বিকভাবে তার অন্যান্য পোস্ট থেকে তাদের আলাদা করেন। কিন্তু বাহ্যিকভাবে, তার পেইড পোস্ট এবং আনপেইড পোস্টের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যেটি আবার নাহাতার দাবি অনুযায়ী ‘নিরপেক্ষ’।
তিনি বলেন, “আপনি বিজ্ঞাপনের জন্য [৫ মিলিয়ন রুপি] খরচ করতে পারেন, কিন্তু সিনেমাটি ভালো না হলে, আমি লিখব যে এটি ভালো নয়… ভালো, খারাপ বা বিশ্রি যাই হোক না কেন, পর্যালোচনা আমার পাঠকদের জন্য একটি পরিষেবা।”
নাহাতা দাবি করেন যে তাকে জিগরা সম্পর্কে টুইট করার জন্য অর্থ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তিনি তার পর্যালোচনাতে এটিকে “বিষণ্ণ এবং একঘেয়ে” বলে অভিহিত করেছেন।
নাহাতা বলেন, “কিন্তু অনেক পিআর এজেন্সি এই তথাকথিত বাণিজ্য বিশ্লেষক এবং পর্যালোচকদের সাথে কথা বলে। একটি নীরব সমঝোতা রয়েছে। …তারা সিনেমাটিকে ৪ তারা, ৪.৫ তারা দেবে এবং (নগদ অর্থের) প্যাকেট তাদের কাছে পৌঁছাবে। এটি জঘন্য।”
আল জাজিরা রিভিউ করার রেট কার্ডে তালিকাভুক্ত ৩১টি সংবাদ সংস্থা, সোশ্যাল মিডিয়া প্রভাবশালী, বাণিজ্য বিশ্লেষক, সমালোচক এবং বিনোদন পোর্টালকে প্রশ্নাবলী পাঠিয়েছে। মাত্র দুটি উত্তর দিয়েছে।
ভারতের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়িক সংবাদপত্র দ্য ইকোনমিক টাইমস বলেছে, তাদের মালিক বিসিসিএল গ্রুপের অন্যান্য প্রকাশনা অর্থের বিনিময়ে নিবন্ধ প্রকাশ করলেও, দ্য ইকোনমিক টাইমস এই ধরনের কোনো কাজ করে না।
ব্যবসা ম্যাগাজিন এন্টারপ্রেনার ইন্ডিয়া বলেছে যে তারা সেলিব্রিটি বা তাদের সংস্থাগুলোর কাছ থেকে গল্পের জন্য চার্জ নেয় না।
আল জাজিরার এই প্রতিবেদনটির প্রতিবেদক প্রায় ১৫ বছর ধরে চলচ্চিত্র সমালোচনা করে আসছেন। একবার একটি পিআর সংস্থা একটি চলচ্চিত্রের রিভিউ-তে ‘সহযোগিতা’ করার জন্য যোগাযোগ করেছিল এবং জানতে চেয়েছিল পর্যালোচনার জন্য কত অর্থ দিতে হবে।
এই ‘দানব’ ঠেকানো যাবে?
নিজস্ব শৈলীতে চলচ্চিত্র বিশ্লেষণ ও সমালোচনার জন্য পরিচিত কামাল আর খান, সংক্ষেপে কেআরকে। ২০২৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর একটি মানহানির মামলায় মুম্বাই বিমানবন্দরে গ্রেপ্তার হওয়ার পর তিনি টুইট করেন, “সালমান খান বলছেন যে তার সিনেমা #টাইগার৩ আমার কারণে ফ্লপ হয়েছে। যদি আমি কোনো পরিস্থিতিতে থানায় বা জেলে মারা যাই, তবে আপনাদের সবার জানা উচিত যে এটি খুন।”
এটি তার প্রথম গ্রেপ্তার বা তার বিরুদ্ধে প্রথম মানহানির মামলা ছিল না।
২০০৮ সালে কেআরকে বলিউডের অন্যতম বাজে সিনেমা ‘দেশদ্রোহী’র চিত্রনাট্য লিখেন ও প্রযোজনা করেন। এতে তিনি অভিনয়ও করেন। প্রায় দুই বছর পরে, তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রল হওয়ার জন্য অভিনয় ত্যাগ করেন।
দুবাই এবং মুম্বাইয়ের মধ্যে নিয়মিত যাতায়াতকারী কেআরকে নিয়মিত অভিনেতাদের গালিগালাজ করতেন। কাউকে কাউকে তিনি ‘বুড়ো’, ‘মাদকাসক্ত’, ‘দুই টাকার মানুষ’ বলে অভিহিত করতেন। তার ১১ মিলিয়নেরও বেশি ফলোয়ারের কাছে সবচেয়ে জঘন্য ভাষায় চলচ্চিত্রের সমালোচনা করতেন।
২০১৬ সালের অক্টোবরে, বহুল আকাঙ্ক্ষিত দিওয়ালি সপ্তাহান্তে দুটি বড় চলচ্চিত্র মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল – করন জোহর প্রযোজিত এবং পরিচালিত অ্যায় দিল হ্যায় মুশকিল এবং অজয় দেবগন প্রযোজিত, পরিচালিত এবং অভিনীত ‘শিবায়’।
চলচ্চিত্র মুক্তির প্রায় এক মাস আগে, দেবগন একটি কথোপকথনের অডিও ক্লিপ শেয়ার করেছিলেন, যেখানে কেআরকে দেবগনের চলচ্চিত্রের সমালোচনা করার জন্য জোহরের কাছ থেকে ২৫ লাখ রুপি ($২৮,৮৬৫) পাওয়ার দাবি করেন। এর জবাবে জোহর বলেছিলেন, যে এ দাবির বিপরীতে প্রতিক্রিয়া জানানোর ভাষা তার নেই।
“কামাল আর খান নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিলেন কারণ চলচ্চিত্র শিল্প তাকে সুযোগ দিয়েছিল,” একজন সিনিয়র চলচ্চিত্র সমালোচক আল জাজিরাকে বলেছেন।
“তাকে প্রেস শোতে ডাকা হত এবং ভিআইপি হিসেবে গণ্য করা হত। [বলিউড সুপারস্টার] অমিতাভ বচ্চন সহ বেশ কয়েকজন পরিচালক এবং অভিনেতা তার পর্যালোচনা পুনরায় পোস্ট করতেন এবং তার কনটেন্ট প্রচার করতেন। চলচ্চিত্র শিল্প থেকে তিনি বৈধতা পেয়েছিলেন কারণ তারা সবাই আপনাকে সমর্থন করতে ইচ্ছুক যখন আপনি অন্য কাউকে টেনে নামাচ্ছেন,” তিনি যোগ করেন।
কেআরকে-এর তারকাখ্যাতি এবং বলিউডে তার প্রভাব অন্যান্য সামাজিক মাধ্যম তারকা এবং ইউটিউবারদের জন্য একটি খারাপ উদাহরণ এবং অর্থ উপার্জনের পথ তৈরি করেছে।
২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৪৪ বছর বয়সী অ্যাকশন হিরো বিদ্যুৎ জামওয়াল বি-গ্রেডের আসন্ন চলচ্চিত্র ক্র্যাকের প্রচারে সুমিত কাদেল নামের একজন সোশ্যাল মিডিয়া চলচ্চিত্র সমালোচক এবং বাণিজ্য বিশ্লেষককে অভিযুক্ত করেন।
“ঘুষ চাওয়া একটি অপরাধ এবং দেওয়াও একটি অপরাধ। আমার অপরাধ কি না দেওয়া? তাই প্রতিবার যখন আপনি কারও প্রশংসা করেন, আমরা অপরাধীকে জানি,” তিনি কাদেলকে ট্যাগ করে টুইট করেন, যিনি তাকে ব্লক করেছিলেন। কাদেল অর্থ চাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন।
পাঁচ মাস পরে জুলাই মাসে, অমিতাভ বচ্চন, প্রভাস এবং দীপিকা পাড়ুকোন অভিনীত ছয় বিলিয়ন রুপির (৬৯ মিলিয়ন ডলার) সায়েন্স ফিকশন চলচ্চিত্র কাল্কি ২৮৯৮ এডি- এর নির্মাতারা কাদেল এবং অন্য বাণিজ্য বিশ্লেষক রোহিত জয়সওয়ালকে আইনি নোটিশ পাঠান। তাদের অভিযোগ ছিল, সোশ্যাল মিডিয়ায় কাদেল প্রচার করেছেন যে, চলচ্চিত্র নির্মাতারা নকল বক্স অফিস সংখ্যা রিপোর্ট করছে।
স্বনামধণ্য এক প্রবীণ পরিচালক এ প্রসঙ্গে বলেন, “সত্য হলো চলচ্চিত্র শিল্প এই দানবকে খাইয়েছে। তারা এই প্রভাবশালীদের তৈরি করেছে, তারা এমন লোকদের তৈরি করেছে যাদের তারা কিনে নিতে পারে।”
কেআরকে, কাদেল এবং জয়সওয়াল আল জাজিরার পাঠানো প্রশ্নের উত্তর দেননি।
‘যারা ইতিবাচক গল্প লেখার জন্য চার্জ নেয় তাদের বিলবোর্ড হিসেবে বিবেচনা করুন’
৪৫ বছর বয়সী প্রভাত চৌধুরীর কিছু বড় এবং সবচেয়ে সফল চলচ্চিত্র প্রচারণার জন্য কৃতিত্ব রয়েছে। তাকে প্রায়ই বলিউডের প্রধান কৌশল কর্মকর্তা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। স্পাইস পিআর-এর সিইও, বলিউডের শীর্ষস্থানীয় বিপণন সংস্থা, চৌধুরীর ক্লায়েন্ট তালিকায় বলিউডের এ-লিস্টাররা রয়েছে, যাদের তিনি ইমেজ বিল্ডিং, ব্র্যান্ডিং, সোশ্যাল মিডিয়া এনগেইজমেন্ট এবং #মিটু-এর মতো বিতর্কিত বিষয়ে কী বলতে হবে- সেই সম্পর্কে পরামর্শ দেন। তার কোম্পানি, স্পাইস, বলিউডে রিভিউ কেনার জন্যও সুপরিচিত।
তবে একজন প্রবীণ পরিচালক আল জাজিরাকে বলেছেন, “স্পাইসের লোকেরা এতটাই নির্লজ্জ যে এখন তারা ইমেল পাঠিয়ে বলে যে আমরা পর্যালোচনার জন্য সহযোগিতা করতে চাই।”
স্পাইস পিআর-এর সঙ্গে নিয়মিত কাজ করা একজন পিআর এজেন্ট আল জাজিরাকে জানান, তারা নিয়মিত তাকে জিজ্ঞাসা করে যে পর্যালোচনাগুলো বাড়ানো যেতে পারে কিনা। তিনি বলেন, “তারা সাংবাদিকদের ফোন করে জিজ্ঞাসা করে, ‘আপনার সিনেমাটি কেমন লেগেছে?’ আপনি যদি বলেন ভালো ছিল, তবে তারা প্রযোজক, অভিনেতার কাছ থেকে আপনার পক্ষ থেকে অর্থ তুলে নেবে।” এই অর্থ সমালোচকের কাছে যেতেও পারে, নাও যেতে পারে।
গত বছরের আগস্টে, একজন শীর্ষস্থানীয় তরুণ অভিনেত্রীর অভিনীত একটি স্পাই থ্রিলার মুক্তির আগে গুঞ্জন ছিল যে সিনেমাটি ভালো চলবে না। একজন চলচ্চিত্র শিল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মতে, চৌধুরী অভিনেত্রীকে ফোন করে কিছু ইতিবাচক রিভিউয়ের অর্থ দেওয়ার জন্য এক মিলিয়ন রুপি (১১,০০০ ডলার) চেয়েছিলেন। তিনি তাকে সমালোচকদের নাম এবং তিনি ব্যক্তিদের কত টাকা দেবেন তা জিজ্ঞাসা করেছিলেন। “তিনি (অভিনেত্রী) বলেছিলেন, ‘না, আমি তা করতে পারি না, কারণ তাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক রয়েছে।”
অভিনেত্রী শেষ পর্যন্ত রিভিউয়ের জন্য অর্থ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
স্পাইস পিআর এবং চৌধুরী আল জাজিরার প্রশ্নের উত্তর দেননি।
চলচ্চিত্র রিভিউ কেনা এবং ইতিবাচক নিবন্ধের জন্য অর্থ দেওয়ার অভ্যাস বলিউডে স্বাভাবিক এবং ব্যাপক। সম্প্রতি স্মিতা প্রকাশের এএনআই পডকাস্টের সাক্ষাৎকারে, বলিউডের তরুণ অভিনেত্রী তাপসী পান্নু খোদ বলিউড বাদশাহ শাহরুখ খানকে জড়িয়েই এই বিষয়ে একটি স্মৃতিচারণ করেন। তাপসী পান্নু দাবি করেন, তিনি যখন অর্থের বিনিময়ে ভালো রিভিউ এর কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করছিলেন, শাহরুখ খান তাকে অন্যভাবে রাজি করিয়েছিলেন।
“তিনি আমাকে বলেছিলেন যারা ইতিবাচক নিবন্ধ লেখার জন্য চার্জ নেয় তাদের ‘বিলবোর্ড’ হিসেবে বিবেচনা করতে। ‘যেমন আপনি বিলবোর্ডের জন্য অর্থ প্রদান করেন, আপনি তাদেরও অর্থ প্রদান করেন,’ তিনি আমাকে বলেছিলেন।”
শাহরুখ খান আল জাজিরার প্রশ্নের উত্তর দেননি।
‘বিকল্প বাস্তবতা’
ভুয়া প্রশংসা চাওয়ার ক্ষেত্রে বলিউড একা নয়। এটি বিশ্বজুড়ে শোবিজের একটি সাধারণ রোগ।
২০০৫ সালের ঘটনা। প্রযোজনা সংস্থা সনি পিকচার্স তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান কলম্বিয়া পিকচার্সের মাধ্যমে দর্শকদের ধোঁকা দিয়েছিল। তারা ডেভিড ম্যানিং নামের একজন ভুয়া চলচ্চিত্র সমালোচক তৈরি করে, যে তাদের সিনেমাগুলোর সবসময় ভালো ভালো রিভিউ দিত। পরে ধরা পড়লে দর্শকদের ১.৫ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়।
২০২২ সালে গোল্ডেন গ্লোবস পুরস্কার বাতিল করা হয়। কারণ এর বিচারকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তারা ২০১৯ সালে নেটফ্লিক্সের ‘এমিলি ইন প্যারিস’ সিনেমার নির্মাতাদের কাছ থেকে প্যারিসে বিলাসবহুল ছুটি উপভোগ করেছিলেন।
বলিউডেও এমন ঘটনা ঘটেছে। ২০২৩ সালে টি-সিরিজ ‘আদিপুরুষ’ নামে একটি সিনেমা বানায়, যা রামায়ণের একটি জঘন্য রূপান্তর ছিল। সিনেমাটি বেশিরভাগ সমালোচক ও দর্শকদের কাছে খারাপ রিভিউ পায়। কিন্তু কিছু কিছু মিডিয়া ও সমালোচক এর প্রশংসা করে, যা দেখে বোঝা যাচ্ছিল না কোনটি আসল আর কোনটি অর্থের বিনিময়ে করা। গুঞ্জন ছড়ায়, টি-সিরিজ কিছু সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টকে অর্থ দিয়ে তাদের সিনেমার খারাপ রিভিউ সরিয়ে ভালো রিভিউ দিতে বলেছিল।
সমালোচকদের দ্বারা প্রশংসিত বলিউড পরিচালক হানসাল মেহতা আল জাজিরাকে বলেছেন, “আমরা দ্য ট্রুম্যান শো-তে বাস করছি। এটি সবই বিকল্প বাস্তবতা, সবই খুব ডিস্টোপিয়ান। পিআর এখন পেইড রিলেশন হয়ে গেছে, পাবলিক রিলেশন নয়। আপনি জানেন না কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ, কোনটা সঠিক, কোনটা ভুল। এবং সিনেমাগুলো কোনো ধরনের ব্যবসা ধরে রাখতে পারছে না, কারণ আর কিছুই প্রাকৃতিক নয়।”
‘আদিপুরুষ’ বড়সড় ফ্লপ সিনেমা ছিল।
টি-সিরিজের একজন মুখপাত্র আল জাজিরাকে বলেছেন, ” দর্শকের ধারণা পরিবর্তন করার জন্য অর্থ দেওয়ার অভ্যাস আমরা অনুসরণ করি না।”
চলচ্চিত্র পরিবেশক বনসাল বলেন, তারা (বলিউডের প্রযোজক এবং অভিনেতারা) বক্স অফিস পরিসংখ্যান কারসাজি করে, রিভিউ জাল করে। বলিউড (শুধু) নিজের কবর খুঁড়ছে না। এটি তার কবরেই দাঁড়িয়ে আছে এবং খনন করা বন্ধ করবে না।”
কিছু চলচ্চিত্র প্রযোজক অবশ্য এখন বিরুদ্ধ অবস্থান নিতে শুরু করেছেন। গত বছর, দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্য তামিলনাড়ুতে চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি আদালতে একটি মামলা দায়ের করেছে। তারা থিয়েটারে চলচ্চিত্র মুক্তির পর সোশ্যাল মিডিয়ায় চলচ্চিত্র পর্যালোচনার উপর তিন দিনের নিষেধাজ্ঞা চেয়েছেন।
তারা দাবি করেছেন, তিনজন সুপারস্টার – কমল হাসানের ইন্ডিয়ান ২, সুরিয়ার কাঙ্গুভা এবং রজনীকান্তের ভেত্তাইয়ান, যাদের সম্মিলিত বাজেট ছিল ১১০ মিলিয়ন ডলার – অভিনীত অন্তত তিনটি বড় বাজেটের চলচ্চিত্রের ব্যবসা ইউটিউব, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম এবং এক্স-এ ‘অরুচিকর’ এবং ‘নেতিবাচক’ পর্যালোচনার কারণে প্রভাবিত হয়েছে।
আদালত আবেদনটি প্রত্যাখ্যান করলেও সরকার এবং ইউটিউবকে চলচ্চিত্র সমালোচনা নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে বলে।
বলিউডে, অনেকেই একমত যে জোহর হয়তো অন্তত ইতিবাচক রিভিউ কেনার ব্যবসায়ে অবসান ঘটানোর প্রথম পদক্ষেপটি নিয়েছেন। তবে ধর্মা প্রোডাকশন এতে অটল থাকতে পারবে কিনা- তা নিয়ে তারা সন্দিহানও।
“এই যোগসূত্র শেষ করা সহজ হবে না যদি না প্রযোজক এবং অভিনেতারা ধর্মার পথ অনুসরণ করে এবং ধারাবাহিক থাকে,” একজন সিনিয়র চলচ্চিত্র সমালোচক বলেছেন। “এবং অবশ্যই সংশোধন মানে এমন ভালো চলচ্চিত্র তৈরি করা যেটির ব্যাপারে প্রযোজকরা আত্মবিশ্বাসী।”
(উপরের আল জাজিরায় প্রকাশিত সুপর্না শর্মার প্রতিবেদন- এর ভাবানুবাদ।)