পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ২৬৫ আসনে ভোট হয় ৮ ফেব্রুয়ারি। বিতর্কিত সেই নির্বাচনে দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সর্বোচ্চ ৯২ আসনে জয়ী হয়। আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) পায় ৭৯ আসন এবং বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) পায় ৫৪টি।
ধারণা করা হয়েছিল, নওয়াজ শরিফের দলই জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয় পাবে এবং সরকার গঠন করবে। আদতে তা হয়নি। জোট সরকার গঠন ছাড়া উপায় নেই পিএমএল-এনের নেতাদের।
পাকিস্তানের এই নির্বাচন ৮ ফেব্রুয়ারি হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করা হয় তিন দিন পর। এর আগেই নওয়াজের দল জয় দাবি করে। ১১ ফেব্রুয়ারি ফল ঘোষণার পরপরই কেন্দ্রে সরকার গঠনের লক্ষ্যে পিএমএল-এন নেতারা উঠেপড়ে লাগেন পিপিপিকে নিয়ে জোট সরকার করতে।
২০২২ সালে আস্থা ভোটে হেরে ইমরান খান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর যে জোট সরকার দেশ পরিচালনা করেছিল, তাতে পিএমএল-এন-পিপিপি উভয়ই ছিল। তাই পুরনো এই দুই শরীকের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে সমঝোতা সহজেই হবে, এমনটা মনে করা হচ্ছিল।
তবে এক সপ্তাহের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত সরকার গঠনে চূড়ান্ত ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারেননি পিএমএল-এন ও পিপিপির নেতারা।
এর মাঝে কয়েক দফা বৈঠকের পর ১৩ ফেব্রুয়ারি পিএমএল-এনের নেতৃত্বে গঠন করা হয় ছয় দলীয় জোট। সেদিন এও ঘোষণা আসে, নওয়াজের ছোট ভাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফকে প্রধানমন্ত্রী করার বিষয়ে সম্মত হয়েছেন পিএমএল-এন ও পিপিপির নেতারা।
নওয়াজ শরিফ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে তার ছোট ভাইকে মনোনীত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ওই ঘোষণার আগে অনেকের অনুমান ছিল, পিএমএল-এন নেতা নওয়াজ শরিফ বা পিপিপি চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি দেশটির প্রধানমন্ত্রী হবেন।
সেদিন নতুন গঠিত ছয় দলীয় জোটে ছিল পিএমএল-এন, পিপিপি, মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট-পাকিস্তান (এমকিউএম-পি), পাকিস্তান মুসলিম লিগ-কায়েদ ই আজম গ্রুপ (পিএমএল-কিউ), ইস্তেহকাম-ই-পাকিস্তান পার্টি (আইপিপি) ও বেলুচিস্তান আওয়ামী পার্টি (বিএপি)।
দেরিতে হলেও এই জোট গঠনের মাধ্যমে পাকিস্তানে সরকার গঠনের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা কিছুটা কাটে। কেন্দ্রে সরকার গঠনে সর্বনিম্ন যে ১৬৯ আসনের প্রয়োজন পড়ে, তা এই জোটের আছে।
কিন্তু শেহবাজ শরিফের নেতৃত্বে ছয় দল নিয়ে জোট গঠনের পরও সমস্যার সমাধান হয়নি। পিএমএল-এন ও পিপিপির মধ্যে দফায় দফায় বৈঠক চলছে। কিন্তু কোনও সুরাহা হচ্ছে না। তারা বারবার ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে ‘গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি’ হয়েছে বলে দাবি করলেও বাস্তবে এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, ছয় দলীয় জোট গঠনের ঘোষণার ঘণ্টাখানেক আগে পিপিপি চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো সংবাদ সম্মেলনে হাজির হয়ে বলেছিলেন, তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদে প্রার্থিতা থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন এবং পিপিপির নির্বাচিত নেতারা কোনও মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকবেন না।
পিপিপিকে কি সরকারের কোথাও দেখা যাবে না- এই প্রশ্নের জবাবে বিলাওয়াল সেদিন বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট, জাতীয় পরিষদের স্পিকার, পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সিনেটের চেয়ারম্যান, ৮ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন হওয়া চার প্রদেশের (পাঞ্জাব, খাইবার পাখতুনখাওয়া, বেলুচিস্তান ও সিন্ধ) গভর্নরসহ শীর্ষ সাংবিধানিক পদে তাদের দেখা যাবে।
পিপিপির ৩৫ বছর বয়সী এই রাজনীতিক তার এই অবস্থান এখনও ধরে রেখেছেন।
নির্বাচনে বিজয় উদযাপন ঘিরে সিন্ধ প্রদেশে রবিবার এক সমাবেশে তিনি বলেছেন, পিএমএল-এন নেতারা তাকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ভাগাভাগি করে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন, যা তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন।
বিলাওয়াল কোনোভাবেই নওয়াজ শরিফের দলের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে রাজি নন। সমাবেশে তার বাবা পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারিকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়ারও ঘোষণা দেন তিনি।
অর্থাৎ শেহবাজকে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়ার পরও পিপিপি নেতা বিলাওয়ালকে প্রধানমন্ত্রী পদে বসাতে চাইছে নওয়াজ শরিফের দল।
সিন্ধের সমাবেশে বিলাওয়াল স্পষ্ট করে বলেছেন, “আমাকে পিএমএল-এন বলেছে, পাঁচ বছরের মেয়াদকালে তারা প্রথম তিন বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকবে। এর পরের দুই বছর যেন আমি এই দায়িত্ব নেই। তাদের এই প্রস্তাবকে আমি ‘না’ বলেছি। তাদের বলেছি, এভাবে আমি দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে চাই না। পাকিস্তানের জনগণ যদি আমাকে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্বাচিত করে, কেবল তখনই আমি প্রধানমন্ত্রী হব।”
বিলাওয়ালকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ভাগ করে নেওয়ার প্রস্তাব পিএমএল-এন নেতারা নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর দিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের এই প্রস্তাবে বারবার অসম্মতি জানাচ্ছেন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত বেনজির ভুট্টোর ছেলে।
নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সর্বোচ্চ আসন পেয়েছেন জানার পর জোট গঠনে বিভিন্ন দলের সঙ্গে বৈঠক চালিয়ে যাচ্ছে ইমরানের দল পিটিআই। দলীয়ভাবে নির্বাচনে দাঁড়াতে না পেরে পিটিআই সমর্থিত প্রার্থীরা ৮ ফেব্রুয়ারি সর্বোচ্চ আসন পাওয়ার পরও সংরক্ষিত আসনের বাধ্যবাধকতার কারণে সরকার গঠনে পিছিয়ে পড়ে।
পাকিস্তানের সংবিধানে বলা আছে, নির্বাচনে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলই কেবল সংরক্ষিত আসনের বরাদ্দ পাবে।
পিটিআই শুরু থেকে বলে আসছে, কোনোভাবেই তাদের দল পিএমএল-এন বা পিপিপির সঙ্গে জোট করবে না।
যদিও ১৫ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার বিকালে খবর আসে, কেন্দ্রে সরকার গঠনের লক্ষ্যে পিপিপির সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি হয়েছেন ইমরান। এ লক্ষ্যে তারা একটি কমিটিও গঠন করতে যাচ্ছে। অবশ্য খবরটি প্রকাশের ঘণ্টাখানেক পর পিটিআইয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, পিপিপির সঙ্গে বৈঠকে বসার খবর সঠিক নয়।
অন্য দলের সঙ্গে জোট করে বা বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কোনও একটি দলে যুক্ত করে কেন্দ্রে সরকার গঠনের বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিল পিটিআই। প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী পদে দলের মহাসচিব ওমর আইয়ুব খানকে মনোনয়নও দেয় তারা।
তবে সম্প্রতি পিটিআইয়ের আত্মবিশ্বাসে ভাটা পড়তে দেখা যায়। শুক্রবার তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা জাতীয় পরিষদে বিরোধী দলে থাকবে এবং ভোটে কারচুপির অভিযোগে আন্দোলন চালিয়ে যাবে।
পিটিআইয়ের এই ঘোষণার দুদিন না যেতেই রবিবার জাতীয় পরিষদে বিরোধী দলের আসনে বসার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে ফের কেন্দ্র, পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনখাওয়ায় সরকার গঠনের ঘোষণা দিয়েছে তারা। এদিন তারা জানিয়েছে, সুন্নি ইত্তেহাদ কাউন্সিলকে (এসআইসি) সঙ্গে নিয়ে কেন্দ্রসহ দুই প্রদেশে সরকার গঠন করবে তারা।
এসআইসি-এর আগে কেন্দ্রে ও পাঞ্জাবে সরকার গঠনের লক্ষ্যে মজলিস ওয়াহদাত-ই-মুসলিমিনের সঙ্গে জোট করেছিল পিটিআই।
জামিয়াত উলেমা-ই-ইসলাম (ফজল) ও পিটিআইয়ের মধ্যে সরকার গঠন নিয়ে সমঝোতা হতে পারে এমন খবর শোনা যাচ্ছিল। অবশ্য এই সম্ভাবনাকে সোমবার উড়িয়ে দিয়েছেন জামিয়াত উলেমা-ই-ইসলামের (ফজল) প্রধান মাওলানা ফজলুর রহমান।
তিনি বলেছেন, “পিটিআই নেতারা এর আগেও আমাদের কাছে এসেছিলেন। আমরা তাদের সবসময় সম্মান করেছি। দুটি দলের মধ্যে বৈঠক হলেই তাদের মধ্যে ‘জোট’ হয়েছে, এমনটা ভাবার যে সংস্কৃতি দাঁড়িয়েছে, তা দুঃখজনক।”
সব মিলে সরকার গঠন নিয়ে এখন পর্যন্ত মীমাংসায় পৌঁছাতে পারেনি পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো। পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে দেশটিতে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
তথ্যসূত্র : ডন, টাইমস অব ইন্ডিয়া