পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী কারাবন্দী ইমরান খানের দল সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা গত সপ্তাহের নির্বাচনে সর্বাধিক আসন জিতেছে। এই ফলকে দেশটির শক্তিশালী জেনারেলদের জন্য তীব্র ধাক্কা মনে করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, পাকিস্তানের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে আরও অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতার দিকেও ঠেলে দিয়েছে এই পরিস্থিতি।
কোন পার্টি বা জোট ক্ষমতায় যাবে- তা এখনও নিশ্চিত নয়। স্বতন্ত্রদের নিয়ে চলছে টানাটানি। ইতোমধ্যে তিন স্বতন্ত্র প্রার্থী নওয়াজ শরীফের দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজে (পিএমএল-এন) যুক্ত হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
ফলের দিক দিয়ে তৃতীয় স্থানে থাকা পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ব্যস্ত দর কষাকষিতে। তারা পিএমএল-এনের সঙ্গে জোট বাঁধবে কিনা- তা এখনও নিশ্চিত নয়। শীর্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছেন করণীয় ঠিক করতে।
এসবের মধ্যেই রবিবার দুপুরে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন পূর্ণাঙ্গ ফল প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, স্বতন্ত্ররা ১০১, পিএলএল-এন ৭৫, পিপিপি ৫৪, মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট পাকিস্তান পেয়েছে ১৭ আসন। এর বাইরে জামায়াতে উলামায়ে ইসলাম পাকিস্তান (জেইউআই-পি) ৪, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (পিএমএল) ৩, ইস্তেহকাম-ই-পাকিস্তান পার্টি (আইপি) ও বেলুচিস্তান ন্যাশনাল পার্টি (বিএনপি) ২টি করে আসন পেয়েছে।
এছাড়া মজলিস ওয়াহদাত-ই-মুসলিমিন পাকিস্তান (এমডব্লিউএম-পি), পাকিস্তান মুসলিম লীগ (জিয়া-উল-হক শহীদ) (পিএমএল-জেড), পাখতুনখাওয়া ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি পাকিস্তান (পিএনএপি-পি), বেলুচিস্তান আওয়ামী পার্টি (বিএপি), পাখতুনখোয়া মিলি আওয়ামী পার্টি (পিএমএপি) ও ন্যাশনাল পার্টি (এনপি) ১টি করে আসন পেয়েছে।
২০২২ সালে ইমরান খান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই পাকিস্তান নতুন করে রাজনৈতিকভাবে টালমাটাল। বিশ্লেষকরা বলছেন, সেনাবাহিনী আশা করেছিল, এই নির্বাচন দেশটির রাজনৈতিক অস্থিরতার অবসান ঘটাবে। কিন্তু এর পরিবর্তে এটি পাকিস্তানকে আরও গভীর সংকটের মুখে ফেলেছে।
দেশটির ইতিহাসে এর আগে কখনও একজন রাজনীতিবিদ জেনারেলদের সমর্থন ছাড়াই নির্বাচনে এত বড় সাফল্য অর্জন করেনি। বিশেষ করে তাদের কঠোর নিয়ন্ত্রণের মুখোমুখি হওয়ার পরও এমন সাফল্য আরও অভাবনীয়।
সংসদের বৃহত্তম দল হিসেবে পিটিআই সমর্থিতরা আত্মপ্রকাশ করলেও তারা এখনও সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। ফলে অন্য আইনপ্রণেতাদের সমর্থন আদায় করে জোট সরকার গঠন করতে ইমরান খান ও নওয়াজ শরিফের দলের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।
কয়েক ডজন আসনে সামরিক বাহিনীর কারসাজির মাধ্যমে ভোট কারচুপি হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন পিটিআই নেতারা। এনিয়ে তারা আদালতে মামলা করার কথাও বলছেন। এছাড়া রবিবারের মধ্যে বাকি ফল প্রকাশ না হলে সমর্থকদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করার আহ্বান জানাবেন বলেও জানিয়েছিলেন তারা।
নির্বাচনে সেনাবাহিনী নওয়াজ শরীফের দলের সহজ জয়ের আশা করেছিল। কিন্তু পিটিআইয়ের সফলতা সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। নির্বাচনের আগে পাকিস্তানের ক্ষমতাবান জেনারেলরা ইমরানকে জেলে পাঠায়। তার সমর্থক-প্রার্থীদের গ্রেপ্তার ও ভয় দেখিয়ে ভোটে নিরুৎসাহিত করে। এভাবে পিটিআইকে নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখার চেষ্টা হয়। কিন্তু নির্বাচনের ফল বলছে, রাজনীতির ময়দান থেকে সরিয়ে রাখা বা কারাগারে ঢুকিয়ে রাখা ইমরান খান পাকিস্তানের রাজনীতিতে একজন শক্তিশালী প্রতিপক্ষ।
পিটিআই গত শুক্রবার সন্ধ্যায় কারাবন্দী ইমরান খানের একটি বিশেষ ভাষণ প্রকাশ করে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে তৈরি ওই ভাষণে ইমরানের কণ্ঠস্বরের অনুকরণ করা হয়েছে।
ভাষণে বলা হয়, “২০২৪ সালের নির্বাচনে জয়ের জন্য আমি আপনাদের সবাইকে অভিনন্দন জানাই। আমি পূর্ণ আস্থা রেখেছিলাম যে, আপনারা সবাই ভোট দিতে আসবেন। আপনাদের বিপুল উপস্থিতি সবাইকে চমকে দিয়েছে।”
ইমরানের দলের সাফল্য পাকিস্তানের রাজনৈতিক দৃশ্যপটকে নাটকীয়ভাবে বদলে দিয়েছে। ২০ কোটি মানুষের পরাশক্তিধর দেশটি দশকের পর দশক ‘পুরনো রাজনৈতিক খেলায়’ অভ্যস্ত ছিল। সেই খেলায় সামরিক বাহিনী ছিল সবচেয়ে থেকে শক্তিশালী, যারা গোপনে রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করত। সাধারণত কোনো নেতা সামরিক বাহিনীর সমর্থন ছাড়া ক্ষমতায় বসতে পারতেন না। অথবা সেনাবাহিনীর বিরোধিতায় তাদের ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হতো।
নির্বাচনের ফল বলছে, ইমরানের সংস্কারের প্রতিশ্রুতি ও সেনাবাহিনীর বিরোধিতা নিয়ে কৌশলী অবস্থান পাকিস্তানিদের, বিশেষ করে তরুণদের মনে গভীর সাড়া ফেলেছে। চলমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় হতাশ এই তরুণদের কাছে তার এমন ভূমিকা আশার আলো হিসেবে কাজ করেছে।
পাশাপাশি নির্বাচনের কয়েকদিন আগে ইমরানের সমর্থকদের গ্রেপ্তার এবং তার দলের নেতাদের দীর্ঘ কারাদণ্ডের মাধ্যমে ভোটারদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার সেনাবাহিনীর পুরনো কৌশলও কাজ করেনি। ভোট এটা প্রমাণ করেছে যে, ইমরান খানের সমর্থকরা এখনও তার প্রতি বিশ্বস্ত রয়েছেন।
ইমরান খানকে রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা ফাঁস, বেআইনি বিয়ে এবং অন্য অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে চারটি পৃথক মামলায় মোট ৩৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তিনি অবশ্য এই অভিযোগগুলোকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেছেন।
নির্বাচনের কয়েকদিন আগে ইমরানের বিরুদ্ধে তিনটি মামলার রায় দেওয়া হয়, যা বিশ্লেষকদের মতে সেনাবাহিনীর পুরনো কৌশলের অংশ। কিন্তু নাগরিক সমাজের একটি সংগঠন ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন নেটওয়ার্ক বলছে, প্রায় ৪৮ শতাংশ ভোটার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন। গত দুই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল প্রায় ৫০ শতাংশ।
ইসলামাবাদের রাজনীতি বিষয়ক বিশ্লেষক জাহিদ হোসেন বলেন, “এই ফল একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এবং দেশ শাসনকারী দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল ও তাদের পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতির বিরুদ্ধে ভোট।” এখানে প্রতিষ্ঠান বলতে তিনি সেনাবাহিনীকে বুঝিয়েছেন।
বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় পিটিআই সরকার গঠনে সমস্যার মুখোমুখি হবে। এমনকি দলটির নেতাদের কেউ কেউ ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, ইমরান কারাগারে থাকাকালীন দুর্বল জোট সরকার গঠনের চেয়ে তারা বিরোধী দলে থাকতেই পছন্দ করবেন।
পিটিআই গতকাল শনিবার বলেছে, তারা কেন্দ্র, পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে সরকার গঠন করবে। রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা কারাগারের বাইরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ কথা বলেন পিটিআইয়ের আইনজীবী উমায়ের খান নিয়াজি।
তিনি বলেন, “পিটিআইয়ের প্রতিষ্ঠাতা ইমরান কেন্দ্র, পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।”
পিটিআইয়ের মিডিয়া উপদেষ্টা জুলফি বুখারি বলেন, “সোমবারের মধ্যে দল ঘোষণা করা হবে। স্বতন্ত্রপ্রার্থীদের দলীয় ব্যানারে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হবে।” পাকিস্তানের আইন অনুযায়ী, বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সরকার গঠন করতে পারে না। তাদের অবশ্যই কোনো দলে যোগ দিতে হয়।
তিনি আরো বলেন, “বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীরা অন্য কোনো দলে ভিড়ে যাবে তেমন ভয় আমাদের নেই। কারণ তারা সেই ব্যক্তি যারা গত ১৮ মাস সংগ্রাম করেছে। সব ধরনের দমন-নিপীড়ন সহ্য করছে।”
জোট গঠনে পিএলএম-এন ও পিপিপির তোড়জোড়
পিছিয়ে থাকালেও শুক্রবার নওয়াজ শরীফ তার দলের সমর্থকদের সামনে বিজয় ভাষণ দেন। সেখানে তিনি অন্য দলগুলোকে জোট সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানান। একইসঙ্গে এই জোটে পিটিআই থাকবে না বলেও জানান।
লাহোরের ভাষণে নওয়াজ বলেন, “আমরা আজ সবাইকে এই আহত পাকিস্তানকে পুনর্গঠন করতে এবং আমাদের সঙ্গে বসতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।”
নওয়াজের আমন্ত্রণে নির্বাচনপরবর্তী কৌশল নিয়ে আলোচনার জন্য মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট-পাকিস্তানের (এমকিউএম-পি) একটি প্রতিনিধিদল রবিবার লাহোরে পৌঁছেছেন।
পিএলএম-এন যখন জোট গঠনের তোড়জোড়ে ব্যস্ত, পিপিপি তখন সিদ্ধান্ত নিতে কালক্ষেপণ করছে।
শনিবার জিও টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পিপিপিপ্রধান বিলাওয়াল ভুট্টো বলেন, “আমাদের ছাড়া কেউ সরকার গঠন করতে পারবে না।”
পিপিপি নেতারা পিএলএম-এনের সঙ্গে জোটে যোগদান প্রসঙ্গে বলেছেন, এবিষয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
পিএমএল-এন জোট সরকার গঠনে সফল হলেও তাদের বেশ কিছু রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। ইমরান খানের পদচ্যুতির পর পিএমএল-এন নেতৃত্বাধীন জোট সরকার জনপ্রিয়তা হারায়। দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলায় ব্যর্থতা, মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি ইত্যাদির জন্য তীব্র সমালোচনার মুখোমুখি হয় দলটি।
দেশটির পরবর্তী নির্বাচিত সরকারকে বৈধতা প্রশ্নে গুরুতর সংকটের মুখোমুখি হতে হবে। কিছু বিশ্লেষক বৃহস্পতিবারের নির্বাচনকে দেশটির ইতিহাসের অন্যতম কম বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হিসেবে অভিহিত করেছেন। নির্বাচনী ফল দেরিতে প্রকাশ করা আরও সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। অনেকের মতে, ফল নিয়ে কারসাজি করে পিএমএল-এনকে সুবিধা দিয়েছে সেনাবাহিনী। কিন্তু পিটিআই সমর্থিতদের এই বিপুল বিজয় নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছে।
তথ্যসূত্র : নিউ ইয়র্ক টাইমস, ডন, এক্সপ্রেস ট্রিবিউন