সবাইকে অবাক করে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচনী ফলাফলে এগিয়ে রয়েছেন।
গত বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টায় জাতীয় নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শেষ হয়। এরপর ২৪ ঘণ্টা পার হলেও ফলাফল এখনও আসছে এবং সেখানে পিটিআই সমর্থিতদেরই এগিয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে।
এটা পাকিস্তানের অভিজ্ঞ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সব ধরনের পূর্বাভাসকে উল্টে দিয়েছে।
ভোটের ফলে দ্বিতীয় স্থানে থাকা পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) প্রধান নওয়াজ শরীফ ইতোমধ্যেই তার ‘বিজয়’ ভাষণে জোট সরকার গঠনের কথা বলেছেন। তৃতীয় স্থানে থাকা পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) সঙ্গে তাদের আলোচনাও হয়েছে।
তবে কারাবন্দি ইমরান খানের দল পিটিআইয়ের স্বতন্ত্র বিজয়ীরা কোন কৌশলে এগোবেন, তা এখনও অস্পষ্ট।
নির্বাচনে সাফল্যের পরও পিটিআইয়ের সামনে এখন অনেক চ্যালেঞ্জ। নির্বাচন কমিশন তাদের প্রতীক ‘ব্যাট’ বরাদ্দ না করায় এবং শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা চলায় পিটিআই সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। দলটির অনেক নেতাই কারাগারে।
এর মানে হলো, পিটিআই সমর্থিত প্রার্থীরা সবচেয়ে বেশি আসন পেলেও সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষিত আসন তাদের বরাদ্দ করা হবে না। ফলে দলটি হয়তো সরকার গঠন করতে পারবে না।
তাহলে পিটিআইয়ের জন্য এখন কী কী বিকল্প আছে? পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম ডন এই প্রশ্নগুলো একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সামনে উত্থাপন করেছে। আসুন দেখি তারা কী বলেন:
বাম দিক থেকে সাংবাদিক ওসাতুল্লাহ খান, সাংবাদিক শাহজেব জিলানি, আইনজীবী আবদুল মঈজ জাফরি ও সাংবাদিক জারার খুহরো।
পার্লামেন্টে এত স্বতন্ত্র প্রার্থী কখনও নির্বাচিত হয়েছে?
সাংবাদিক ওসাতুল্লাহ খান বললেন, “এর চেয়েও অনেক বেশি হয়েছে। জেনারেল জিয়াউল হকের সময় পুরো পার্লামেন্টই গঠন করেছিল স্বতন্ত্ররা।”
তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ১৯৮৫ সালে পাকিস্তানের নির্বাচনে কোনও দল অংশ নেয়নি। তখন সবাই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। অবশ্য প্রত্যেকের প্রতিই কারও না কারও সমর্থন ছিল। তবে কাগজকলমে তারা সবাই স্বতন্ত্র ছিলেন।
সংসদে নির্বাচিত হওয়ার পর সেই প্রার্থীরা মিলিতভাবে একটি দল গঠন করেন। নাম দেন পাকিস্তান মুসলিম লীগ। সেই দলটিই এখন পিএমএল-এন বা পিএমএল-কিউ নামে পরিচিত বলে জানান ওসাতুল্লাহ।
“১৯৮৫ সালের নির্দলীয় পার্লামেন্টেই তাদের জন্ম হয়েছিল।”
লন্ডন ষড়যন্ত্র ভেস্তে দিয়েছে জনগণ : ইমরান
পিটিআই-সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসন পেয়েও যদি জাতীয় পরিষদে যোগ না দেয়, তাহলে কী হবে?
এবিষয়ে ওসাতুল্লাহ বলেন, “এই পদক্ষেপ দলটির জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না। আগেও তারা এমনটা করেছে। আর সেটা তাদের জন্য কী পরিণতি বয়ে এনেছিল, তা আপনি দেখেছেন। আমি মনে করি, গতবারের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা আবার এমন ঝুঁকি নেবে না।
“তবে এটা সম্ভব যে, তারা একটি দল তৈরি করার চেষ্টা করবে। এটিকে ইনসাফ পার্টি বা অন্য কোন নাম দেবে।”
পিটিআই সমর্থিত প্রার্থীরা বৃহত্তম ব্লক গঠন করলে কি তাদের পিটিআই সদস্য হিসেবে দাবি করা যাবে?
সাংবাদিক জারার খুহরো বলেন, “এই প্রশ্নের পেছনে মূল ধারণাটি হলো, সবকিছুই আইনের নিয়ম-কানুন অনুসারে পরিচালিত হয়। কিন্তু পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এটি যে সত্যি নয়, তা স্পষ্ট।”
তিনি এ কথা বলতে গিয়ে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে পিটিআই ও এর নেতৃত্বের বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, “ইমরান খানের বিরুদ্ধে একের পর এক, বিশেষত হাস্যকর ইদ্দত মামলায় সাজা পাওয়ার প্রেক্ষাপটে আমাদের এ বিষয়ে চিন্তা করতে হবে। পিটিআইয়ের নেতা ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে দেওয়া অবিশ্বাস্যরকম বিতর্কিত ও অত্যধিক শাস্তি, যেমন দলের নির্বাচনী প্রতীক কেড়ে নেওয়ার ঘটনা, সেগুলোও আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। এই প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে, পিটিআই নিয়ম মানুক বা না মানুক, তাতে কোনও ‘জাদুকরী’ সুরাহা পাওয়া যাবে বলে আমার মনে হয় না।”
তবে আইনজীবী আবদুল মঈজ জাফরি এই বিষয়ে কিছুটা আশাবাদী।
তিনি যুক্তি দেখান যে, নির্বাচন কমিশন পিটিআইকে নির্বাচনী প্রতীক দেয়নি ঠিকই, কিন্তু দলটির নিবন্ধন বাতিল করেনি।
তিনি পিটিআই সমর্থিত প্রার্থী সালমান আকরাম রাজার আদালতে করা আবেদনের উপর ভিত্তি করে তার মতামত দেন।
রাজা সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছিলেন যে, তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নয়, পিটিআই প্রতীকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
জাফরির মতে, আইনগতভাবে পিটিআই এখনও একটি রাজনৈতিক দল।
সুপ্রিম কোর্টে আবেদনে সালমান আকরাম রাজা যুক্তি দিয়েছিলেন যে, নির্বাচন কমিশন পিটিআইকে একটি নির্বাচনী প্রতীক দিতে অস্বীকৃতি জানালেও, রাজনৈতিক দল হিসেবে এর অস্তিত্ব ও কার্যক্রম রয়েছে। তিনি বলেছিলেন, দলটি এখনও আছে, বিলুপ্ত হয়নি।
পাকিস্তানে ভোটের ফলে আরও এগিয়ে স্বতন্ত্ররা
স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সমর্থনে পিএমএল-এন কি সরকার গঠন করতে পারবে?
জারার খুহরো বলেন, “অনেকেই তাদের সঙ্গে জোট বাঁধতে চাইবেন। তবে সব স্বতন্ত্র প্রার্থী – আমি ধরে নিচ্ছি আপনি পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্রদের কথা বলছেন- তারা কী করবেন, সে বিষয়ে এক কথায় বলা মুশকিল।
“অঞ্চলভেদে পরিস্থিতি ভিন্ন হবে। খাইবার পাখতুনখাওয়াতে পিটিআই থেকে পালিয়ে আসা নেতাদের জনগণ নির্মমভাবে প্রত্যাখ্যান করবে। সেখানে পিটিআই সমর্থিত প্রার্থীরা আধিপত্য বিস্তার করে আছেন।”
দক্ষিণ পাঞ্জাবে অবস্থা ভিন্ন হতে পারে বলে মনে করেন জারার খুহরো। সেখানে পিএমএল-এন কিছু স্বতন্ত্র প্রার্থীকে নিজেদের দলে টানতে পারে।
তিনি বলেন, “কিছু স্বতন্ত্র হয়তো বিজেতাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারে। কারণ তারা মনে করতে পারে, শুরুতে যদি জনগণ তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলেও, তা সাময়িক এবং সহ্য করা যাবে।”
পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা কি তাদের মধ্য থেকে একজনকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করতে পারবেন?
সাংবাদিক শাহজেব জিলানির মতে, নির্বাচিত প্রার্থীদের ফলাফল জানানোর পর তাদের সামনে তিন দিন সময় থাকবে। তারা হয় স্বতন্ত্রভাবে কোনও রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করতে পারবেন, নয়তো একত্রে কোনও দলে যোগ দিতে পারবেন।
জিলানি মনে করেন, পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পার্লামেন্টের বৃহত্তম গোষ্ঠী হতে চাইলে তাদেরকে অবশ্যই অন্য কোনও রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে হবে।
তিনি এক্ষেত্রে মজলিস ওয়াহদত-ই-মুসলিমিন (এমডব্লিউএম) দলটির নাম উল্লেখ করেন।
এমডব্লিউএম একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পিটিআই ও এমডব্লিউএম জোট বেঁধেছিল। এখন পিটিআই সমর্থিতরা এমডব্লিউএমে যোগ দিলে তারা সংরক্ষিত আসন পাবেন এবং তাদের সংখ্যা আরও বাড়বে। ফলে তারা সংসদ নেতা হওয়ার দাবিদার হতে পারবেন।
জিলানির মতে, বড় দলগুলো পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্রদের নিজেদের দলে টানতে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার প্রলোভন দেখাতে পারে। কিন্তু তারা এক গ্রুপ, এক দলে থাকলে পার্লামেন্টে একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী হয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে।
পিটিআই সমর্থিত প্রার্থীরা কি তাদের মধ্য থেকে বিরোধী দলের নেতা নির্বাচিত করতে পারবেন?
এজন্যও পিটিআইকে কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে বলে মনে করেন জিলানি।
তিনি বলেন, “তারা বিদ্যমান কোনও দলে ব্লক হিসেবে যোগ দিলে পার্লামেন্টের সংসদ নেতা পদে নিজেদের প্রার্থীকে নির্বাচিত করতে পারবেন। এক্ষেত্রে তাদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হতে হবে। কিন্তু কোনও কারণে তা সম্ভব না হলে দ্বিতীয় সেরা বিকল্প হবে বিরোধী দলের নেতা পদে তাদের কোনও প্রার্থীকে বেছে নেওয়া।”