Beta
মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

পাকিস্তানের রাজনীতিতে ইসলামী ধারা কি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে

pakistan-islami-party-210324
Picture of সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগের পর জন্মলগ্ন থেকেই পাকিস্তানের রাজনীতিতে বড় প্রভাব ইসলামী দলগুলোর। ক্ষমতায় থাক বা না থাক, সরকার গঠনে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছে বরাবরই।

তবে এবারের পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে ভিন্ন চিত্র দেখা গেল। দেশটির পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইসলামী দলগুলো হালে পানি পায়নি। ভোটের রাজনীতিতে তাদের অবস্থান এখন প্রায় তলানিতে।

এনিয়ে পাকিস্তানের সর্বত্র চলছে আলোচনা। পাড়া-মহল্লার চায়ের দোকানগুলোতে চলছে তর্ক-বিতর্ক। কেন ইসলামী দলগুলো নির্বাচনে ভালো ফল করেনি? ভোটাররা কেন তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে? এসবই আলোচনায় আসছে ঘুরেফিরে।

এমনই একটি চায়ের আড্ডা পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের উপকণ্ঠে। সেখানে যারা আড্ডা দিচ্ছেন, তাদের মধ্যে যুবক থেকে বয়োবৃদ্ধ অনেকেই আছেন। এরা সবাই মাদ্রাসা শিক্ষা ও ইসলামী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তারা নিজেদের মধ্যে নির্বাচনে পরাজয়ের তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করছেন।

তাদের মুখের অভিব্যক্তিতে বিস্ময় ও রাগ স্পষ্ট।

চায়ের টেবিলে উপস্থিত ছিলেন বেলুচিস্তানের পিশিন এলাকার এক মাদ্রাসা স্নাতক। তিনি বলেন, “আমাদের আত্মসমালোচনা করতে হবে। আমরা পরিবর্তনশীল সময়ের সঙ্গে খাপ খেতে ব্যর্থ হলে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ব।”

ওই স্নাতকের কথার প্রতিক্রিয়ায় আরেক তরুণ বলেন, “একটা বিচ্ছিন্নতা তো আছেই। নেতৃত্ব সবসময় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পেছনে ছোটে।

“জনগণ যেখানে শরিয়া আইনের বাস্তবায়নের জন্য আকুল, সেখানে আমরা আফগানিস্তানে তালেবানদের বিজয় উদযাপন করি, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আঁকড়ে ধরি – এটা কি স্পষ্ট বিরোধ নয়?”

ফেব্রুয়ারির ৮ তারিখের নির্বাচনে দেশটির প্রায় সব প্রধান ইসলামপন্থী দলের পরাজয়ের পর পাকিস্তানজুড়ে এসব আলোচনা হচ্ছে।

এই হারের আসল কারণগুলো কী এবং কেন পাকিস্তানের নির্বাচনী রাজনীতিতে ইসলামপন্থী দলগুলো কম প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে, এমন আলোচনা সবখানে। এসব দলগুলোর কি প্রচারে মনোনিবেশ করা উচিৎ, নাকি নির্বাচনী রাজনীতি ও কর্মী গড়ার কাজে মনোযোগ দেওয়া উচিৎ, এমন আলোচনাও চলছে।

এই বিতর্কগুলো দেশটির রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ইসলামী দলগুলোর দীর্ঘমেয়াদী টিকে থাকার প্রশ্ন উত্থাপন করে। নেতৃত্ব ও কর্মীদের মধ্যে এই বিতর্ক দীর্ঘায়িত হলে পাকিস্তানের রাজনীতিতে তাদের ভূমিকা আরও দুর্বল হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

ইসলামী দলগুলোর রাজনীতি

পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ১৬৭টি দলের মধ্যে প্রায় ২৫টির নাম ইসলাম বা সম্প্রদায়ভিত্তিক, যা তাদের ধর্মের সঙ্গে সম্পর্ককে প্রকাশ করে।

এই দলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম-ফজল (জেআইইউ-এফ), জামায়াতে ইসলামী (জেআই), তেহরিক-ই-লাব্বাইক পাকিস্তান (টিএলপি), মজলিস-ই-ওয়াহদাত-ই-মুসলিমিন (এমডব্লিউএম), পাকিস্তান রাহ-ই-হক পার্টি, পাকিস্তান মারকাজি মুসলিম লীগ ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম-নজরিয়াতি। এই দলগুলো ৮ই ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল।

নির্বাচনে সুন্নি ইত্তেহাদ কাউন্সিল (এসআইসি) কোনও বড় প্রার্থী ছিল না। তবুও দলটির গুরুত্ব বেড়েছে। কারণ নির্বাচনের পর ইমরান খানের দল পিটিআই তাদের স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিত সদস্যদের জন্য এসআইসিকে ব্যবহার করে।

সাম্প্রতিক নির্বাচনে তাদের অবস্থা দুর্বল হলেও পাকিস্তানে ধর্মীয়-রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব কেবল নির্বাচনে জয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।

ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের (সোয়াস) পিএইচডি গবেষক জোহান চ্যাকো।

তার ‘পাকিস্তানস পলিটিক্যাল পার্টিস : সারভাইভিং বিটউইন ডিক্টেটরশিপ অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’ বইয়ের পাকিস্তানের ধর্মীয় দলগুলো নিয়ে অধ্যায়ে তিনি বলেছেন, নির্বাচনে খারাপ ফলের পরেও ইসলামপন্থী দলগুলো যৌথভাবে জাতীয় রাজনৈতিক জীবনে ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষ করে আলোচনার মানদণ্ড গড়ার ক্ষেত্রে।

চ্যাকো লেখেন, “পাকিস্তানের ধর্মীয় দলগুলোর এই বিশেষ গতিপথ নির্ধারিত হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যকার সম্প্রদায়গত ধর্মীয় বৈচিত্র্যের মাধ্যমে। এই বৈচিত্র্য একটি জনপ্রিয় ইসলামী প্রজাতন্ত্রের কাঠামোয় ঔপনিবেশিক দুর্বল রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে কাজ করে।”

এসব দল যদিও সাধারণত ইসলামী বক্তৃতা দেয়, তবুও প্রত্যেক দল পাকিস্তানের বহুবিধ মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে নির্দিষ্ট একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে গুরুত্ব দেয়। রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠীর স্বার্থ প্রতিনিধিত্ব ও রক্ষা করার চেষ্টা করে।

অন্য দলগুলোর তুলনায় জামায়াতে ইসলামী অপেক্ষাকৃত অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গির। অন্যদিকে জেইউআই-এফ ও টিপিএল এর মতো দলগুলো দেওবন্দিও ও বেরলভি সুন্নি ঘরানার। আবার এমডব্লিউএম শিয়া মতাদর্শিক দল।

করাচিভিত্তিক ইসলামপন্থী আন্দোলন বিষয়ক গবেষক শামসুদ্দিন শিগ্রি বলেন, “নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের উপর মনোযোগ দিলে সব ভোটারদের কাছে তাদের আবেদন সীমিত হয়ে পড়ে।”

জোহান চ্যাকো আরও উল্লেখ করেন, এই সম্প্রদায়ভিত্তিক দলগুলো ঐতিহাসিকভাবে খাইবার পাখতুনখাওয়া ও বেলুচিস্তানে প্রতিযোগিতামূলক ছিল। ছয়বার প্রাদেশিক পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছিল তারা।

পাকিস্তানের জনসংখ্যার ৭৪ শতাংশ এবং সংসদীয় আসনের বেশিরভাগ অংশ নিয়ে গঠিত পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশে এই দলগুলোর ভূমিকা খুব কম। পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে সাম্প্রতিককালে উঠে আসা প্রধান ইসলামপন্থী দল হলো টিএলপি।

হতাশাজনক পরিস্থিতি

গ্যালাপ পাকিস্তানের প্রতিবেদন বলছে, নির্বাচনে ইসলামপন্থী দলগুলো মোট ভোটের মাত্র ১২ শতাংশ পেয়েছে। পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা, পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) পর দেশের চতুর্থ বৃহত্তম দল হিসেবে টিএলপি ২৮ লাখ ভোট পেয়েছে।

জাতীয় পর্যায়ে জেইউআই-এফ ও জেআই যথাক্রমে ২১ ও ১৩ লাখ ভোট পেয়েছে। দল দুইটির সম্মিলিত ভোট টিএলপির চেয়ে বেশি।

গ্যালাপ পাকিস্তানের পরিচালক বিলাল গিলানি বলেন, “ইসলামী দলগুলোর গড় ভোট প্রায় ৫ শতাংশ। সুতরাং, ভোটের হিসাবে তারা ভালো করেছে বলে মনে হচ্ছে। ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে ইসলামী দলগুলো যে ভোট পেয়েছে, সেই অনুসারে আসন পায়নি।”

গিলানির মতে, করাচিতে শোরগোল করেও লাভ হয়নি জেআইয়ের। তাদের আসন কেড়ে নিয়েছে কওমি মুভমেন্ট-পাকিস্তান (এমকিউএম-পি)। খাইবার পাখতুনখাওয়ায় জেইউআই-এফ প্রায় বিলুপ্ত। সেখানে জিতেছে পিটিআই। পাঞ্জাবে টিপিএল অন্য দলের জয়ের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালেও তারা নিজেরা তেমন সফলতা পায়নি।

তিনি বলেন, “টিএলপি ছাড়া ইসলামপন্থী দলগুলো পিএমএল-এন ও পিপিপির মতো একই দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মুখোমুখি। নতুন ভোটারদের কাছে নিজেদের আকর্ষণীয় করে তুলতে পারেনি তারা।”

‘আন্ডার দ্য গুন : পলিটিক্যাল পার্টিস অ্যান্ড ভায়োলেন্স ইন পকিস্তান’ বইয়ের লেখক নিলুফার সিদ্দিকী মনে করেন, ফেব্রুয়ারি ৮ তারিখের নির্বাচনের ফল আবারও দেখিয়েছে যে, রাস্তার ক্ষমতা নির্বাচনী সাফল্যের প্রতিনিধি হিসেবে ব্যবহার করা যায় না।

জেইউআই-এফের নির্বাচনী দুর্দশা

পার্লামেন্টে জেইউআই-এফ চারটি আসন পেয়ে সর্ববৃহৎ ইসলামী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কিন্তু ২০১৮ সালের তুলনায় দলটির ফল বেশ খারাপ। দলটি তাদের নিজেদের দুর্গ খাইবার পাখতুনখাওয়ায় শোচনীয়ভাবে হেরেছে।

জেইউআই-এফ প্রধান মাওলানা ফজলুর রেহমান ও তার ছেলেরা এবং দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা পিটিআই-সমর্থিতদের কাছে হেরেছেন। শুধু ফজলুর রেহমানের ভাই মাওলানা ওবায়দুর রেহমান তার প্রাদেশিক পরিষদ আসন ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন।

জেইউআই-এফ বেলুচিস্তান পরিষদে তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। তাদের এই সাফল্যের মূল কারণ হলো – নির্বাচনের পূর্বে সরদার আসলাম রায়সানির মতো গোত্রপতিদের দলভুক্ত করা।

ফজলুর রেহমান পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে পিশিন জেলা থেকে একটি আসন জিতেছেন। তিনি পাখতুনখাওয়া মিল্লি আওয়ামী পার্টির (পিকেএমএপি) সঙ্গে জোট গড়ে ওই আসনে জেতেন। দলের প্রাদেশিক নেতা মাওলানা আবদুল ওয়াসি একজন বিদ্রোহী সদস্য মাওলানা নুরুল্লাহর কাছে তার আসন হারিয়েছেন।

বেলুচিস্তানের একজন জেইউআই-এফ কর্মী জানান, দলের ১০ জন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যের কেউই ধর্মীয় পণ্ডিত নন।

দলটির নেতারা স্বীকার করেছেন যে, এর আগেরবার শেহবাজ শরিফ নেতৃত্বাধীন সরকারের শরিক হওয়ায় তারা এবারের নির্বাচনে হেরেছেন। পিটিআইয়ের উত্থানের মূল কারণ জনগণের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ।

ইসলামাবাদের গবেষক তাহমিদ জান আজহারি জেইউআই-এফের নির্বাচনী ফলাফলের খারাপ অবস্থার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি পিটিআইয়ের জনপ্রিয়তার ঢেউ ছাড়াও আরও কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে – আসন বণ্টনে অভ্যন্তরীণ ঝগড়া, অন্য দলের সঙ্গে আসন সমন্বয়ে অনীহা, নির্বাচন স্থগিত হওয়ার আশা ও অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস।

তিনি আরও বলেন, “ধর্মীয় পণ্ডিতদের পরিবর্তে নির্বাচনে ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতাও পরাজয়ের একটি কারণ।”

জেইউআই-এফ মারদানে প্রভাবশালী পণ্ডিত ও সাবেক সংসদ সদস্য মাওলানা কাসেমকে টিকিট না দিয়ে একজন ধনীকে টিকিট দেয়। এই সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল। কারণ এটি দলের ধর্মভিত্তিক ভোটারদের হতাশ করেছে। ফলে দলটি মারদানে নির্বাচনে হেরে যায়।

এমন সিদ্ধান্তের কারণে দলের সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় ধর্মীয় ব্যক্তিরাও নির্বাচনে প্রভাবশালীদের সহযোগিতা করেনি।

নির্বাচনে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের টিকেট দেওয়ার জেইউআই-এফের কৌশল বেলুচিস্তানে তুলনামূলকভাবে সফল হয়েছে। তবে কোয়েটায় দলটির এক নেতার মতে, জেইউআই-এফের টিকেটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা দলের প্রতি আনুগত্য দেখান না। তারা প্রতিটি নির্বাচনে দল বদলানোর জন্য পরিচিত।

বিশ্লেষকদের মতে, দলটির নির্বাচনী প্রচার বাধাগ্রস্ত হওয়ার পেছনে ইসলামিক স্টেট খোরাসান প্রদেশ (আইএসকেপি) একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। আইএসকেপির হুমকি দলটিকে নির্বাচনী সমাবেশ করতে দেয়নি।

গত জুলাইয়ের শেষের দিকে বাজওরে দলটির এক নির্বাচনী সমাবেশে আত্মঘাতী বোমা হামলা করেছিল আইএসকেপি। এতে ৫৫ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়। এছাড়া বেলচিস্তানের মাস্তুংয়ে দলটির নেতা হাফিজ হামদুল্লাহও ওপরও আত্মঘাতী বোমা হামলা চেষ্টা হয়েছিল।

টিএলপির ভবিষ্যৎ

নির্বাচনের আগে পাঞ্জাবে সবার নজর ছিল পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী ও পিএমএল-এনের ওপর। একই সময়ে তখন অন্য জায়গায় নীরবে এগোচ্ছিল টিএলপি। দলটি জাতীয় পরিষদে কোনও আসনই পায়নি। কিন্তু দলটি যে ভোট পেয়েছে ও তাদের উপস্থিতি ভবিষ্যতে অন্য দলের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে।

টিএলপির কট্টর সমর্থক সোহেল আট্টারি তার দলের ব্যর্থতার কিছু দিক তুলে ধরেছেন। তার মতে, ‘পশ্চিমা চাপ’ বিশেষ করে ইউরোপের কারণে পার্লামেন্টে প্রবেশ করতে পারেনি টিএলপি। কারণ হিসেবে তিনি তার দলের ব্লাসফেমি ইস্যুতে কট্টর অবস্থানের কথা জানান।

অনেক বিশেষজ্ঞ টিএলপির ভূমিকা সম্পর্কে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। তারা মনে করেন, দলটি ২০২৩ সালের নির্বাচনেও ২০১৮ সালের নির্বাচনের মতো ‘ভোট কাটুয়া’ বা ‘ভোট নষ্ট’ করার কাজ করেছে।

নিউ ইয়র্কের স্টেট ইউনিভার্সিটর রাষ্ট্র বিজ্ঞানের শিক্ষক নিলুফার এ সিদ্দিকীর মতে, কোনও আসন না জিতেও পাঞ্জাবে টিএলপির ভোট প্রায় ২ শতাংশ বেড়েছে। সেখানে তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে দলটি। তবে করাচিতে দলটির ভোট অনেক কমেছে।

গবেষকদের মতে, টিএলপি নিম্ন-আয়ের মানুষ, শিক্ষিত ও তরুণদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে। বিশেষ করে লাহোর ও রাওয়ালপিন্ডিতে দলটির সমর্থক অনেক।

টিকে থাকার লড়াইয়ে জামায়াত

অন্য ইসলামী দলের মতো জামায়াতে ইসলামীর সদস্যরাও দলের ভবিষ্যৎ প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন ক্রমাগত দুর্বল নির্বাচনী ফলের কারণে।

দেশটির জন্মলগ্ন থেকেই দলটি রাজনীতিতে থাকলেও জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচনী সক্রিয়তা সবসময়ই হতাশাজনক ছিল। তবে উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ছিল, ২০০২ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত মুত্তাহিদা মজলিস-ই-আমল (এমএমএ) জোটে তাদের অংশগ্রহণ।

দলটির শক্তিশালী ঘাঁটি হিসেবে বিবেচিত হয় আপার দিয়ের এলাকা। সেখানে দলটির এক সদস্য বলেন, “আমরা অনেকদিন ধরেই রাজনীতিতে আছি, কিন্তু ফল আসছে না। গত নির্বাচনে দেখুন, দুইশর বেশি প্রার্থী দেওয়া হলো, কিন্তু একটা আসনও আমরা পাইনি।”

জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনে বেশ সংগঠিত নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও, হতাশাজনক কর্মকাণ্ডের কারণে দলটির নেতা সিরাজুল হক পদত্যাগ করেছেন; যদিও দলটির কেন্দ্রীয় কাউন্সিল শেষ পর্যন্ত তার পদক্ষেপ প্রত্যাখ্যান করেছে।

করাচির আরেক জামায়াত কর্মী স্বীকার করেন, “আমাদের কৌশল ত্রুটিপূর্ণ। তাত্ত্বিক আলোচনা অকার্যকর এবং সম্ভবত নেতৃত্ব বিভ্রান্ত অথবা কর্মীরা দিশাহীন। আমাদের কাছে জনগণকে আকর্ষণ করার মতো নেতা নেই। এমন একজন আগ্রাসী নেতা যিনি জনগণের সঙ্গে সংযোগ ঘটাতে পারবেন।”

পিটিআইয়ের উত্থানকে জামায়াতের অনেকে নিজেদের পতনের কারণ হিসেবে মনে করেন। করাচির এক জামায়াতে ইসলামী সমর্থকের মতে, “আমাদের ঘাঁটি দখল করেছে পিটিআই, বিশেষ করে ঐতিহ্যবাহী আসনগুলোতে।” অনেকের বিশ্বাস, ৯ মে দাঙ্গার পর পিটিআই সমর্থকদের আকৃষ্ট করার জামায়াতের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।

জামায়াতের আরেক কর্মী বলেন, “পিটিআই কর্মীদের প্রভাবিত করতে জামায়াত একটি সহানুভূতিশীল নীতি গ্রহণ করেছিল। কিন্তু এতে জামায়াতের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি হয়। অনেকে মনে করেছিলেন এই নীতি তাদের পরিচয়কে বিপন্ন করে। শেষ পর্যন্ত তা প্রমাণ হয়েছিল।”

কারাচিভিত্তিক সাংবাদিক ফায়জুল্লাহ খান জামায়াতের সংগ্রামের কারণগুলো অতীত ও বর্তমান উভয় ক্ষেত্রেই খুঁজে পেয়েছেন। নব্বইয়ের দশকে জামায়াতে ইসলামী নিজেকে প্রতিষ্ঠিত দলগুলো, পিএমএল-এন ও পিপিপির বিরুদ্ধে তৃতীয় শক্তি হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছিল।

ফায়জুল্লাহ বলেন, “জামায়াত তখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করে। একই সঙ্গে ‘পাসবান’ নামে একটি যুব সংগঠন গঠন করে। প্রাথমিকভাবে এই সংগঠন তরুণদের আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল। তবে পরবর্তীতে পাসবান বিভক্ত হয়ে যায়।”

জামায়াতের দুর্নীতিবিরোধী এই অবস্থান পরে ইমরান খান ও তার দল পিটিআই নেয়।

ফায়জুল্লাহ খান মনে করেন, জামায়াতে ইসলামী ও ইমরান খানের পার্থক্য মূলত নেতৃত্বে নিহিত। ইমরানের ক্রিকেটের সেলিব্রিটি স্ট্যাটাস তাকে ভোটারদের সঙ্গে সংযোগ ঘটাতে সাহায্য করেছে, যা জামায়াতে ইসলামী করতে পারেনি।

দলটি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য ‘পাকিস্তান ইসলামিক ফ্রন্ট’ নামে একটি জোট গঠনের চেষ্টা করেছিল। এটি ১৯৯৩ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার পরিকল্পনা করলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।

জামায়াতে ইসলামী নেতৃত্বের ব্যাপারেও অভ্যন্তরীণভাবে বিভক্ত। কিছু নেতা আরও আক্রমণাত্মক ব্যক্তিত্বের পক্ষে সমর্থন করছেন, যেমন করাচির নেতা হাফিজ নায়েমুর রহমান। অন্যদিকে কিছু নেতা ব্যক্তিত্ব-চালিত রাজনীতির পরিবর্তে আদর্শগত নীতি মেনে চলার উপর জোর দিচ্ছেন।

পেছনের সারিতে যারা

শিয়া সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল এমডব্লিউএম ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। পিটিআইয়ের সঙ্গে জোট গড়ে তারা জাতীয় পরিষদে একটি আসন পেয়েছে।

নিষিদ্ধ সিপাহ-ই-সাহাবা পাকিস্তান বা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের নির্বাচনী ফ্রন্ট পাকিস্তান রাহ-ই-হক পার্টি বিভিন্ন শহরে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। এর মধ্যে রয়েছে করাচি, পেশোয়ার, ঝং ও বাত্তাগ্রাম। তবে দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ – মাওলানা আহমেদ লুধিয়ানভি, মাওলানা আওরঙ্গজেব ফারুকী ও হাকিম ইব্রাহিম কাসমীরা কোনও আসনে জয় পাননি।

হাফিজ সাঈদের নেতৃত্বে নিষিদ্ধ জামায়াত-উদ-দাওয়ার নির্বাচনী ফ্রন্ট পাকিস্তান মারকাজী মুসলিম লীগও (পিএমএমএল)  নির্বাচনে কোনো সফলতা পায়নি। পিএমএমএল মূলত আহলে হাদিস/সালাফি ধারার প্রতিনিধিত্ব করে।

কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, দলটির নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছিল সরকারের একটি কৌশল। এর মাধ্যমে এই ধরনের গোষ্ঠীগুলোকে মূলধারার রাজনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হতে পারে।

নির্বাচনে হতাশাজনক কর্মকাণ্ডের কারণ

লেখক ও গবেষক জোহান চ্যাকো ইসলামী দলগুলোর সীমিত নির্বাচনী সম্ভাবনার তিনটি মূল কারণ চিহ্নিত করেছেন।

প্রথমত, তিনি ধর্মপ্রাণ কিন্তু বৈচিত্র্যময় ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক বিভাজনের উপর জোর দিয়েছেন। এই বিভাজন বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্যমান।

দ্বিতীয়ত, তিনি সামাজিক আন্দোলনের বৃহত্তর উদ্দেশ্যগুলোকে নির্বাচনী কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্য করার ক্ষেত্রে যেসব অন্তর্নিহিত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয় সেগুলো তুলে ধরেছেন।

তৃতীয়ত, তিনি ভোটারদের মধ্যে পৃষ্ঠপোষকতার প্রতি প্রবণতা ও ধর্মীয় দলের সীমাবদ্ধতার উপর আলোকপাত করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন, ধর্মীয় দলগুলো সম্পদের অভাবে ধনী ব্যবসায়ী ও সামন্তপ্রধানদের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে না।

পিটিআইয়ের উত্থান

ইমরান খানের নেতৃত্বে পিটিআইয়ের উত্থান ইসলামী দলগুলোর নির্বাচনী ভাগ্যের জন্য একটি বড় ধাক্কা।

প্রথমত, পিটিআই নিজেকে বাইরের শক্তি হিসেবে স্থাপন করে পিএমএল-এন, পিপিপি, জেআইইউ-এফ ও জেআইসহ কিছু ইসলামপন্থী দলের সঙ্গে যুক্ত প্রচলিত রীতিনীতির চ্যালেঞ্জ জানায়। ইমরানের বক্তৃতা ভোটারদের অতীতের দুর্নীতি ও অদক্ষতা থেকে বের হওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে জাগিয়ে দিয়েছিল।

দ্বিতীয়ত, পিটিআই বৃহত্তর জাতীয় এজেন্ডার উপর নজর দেয় যা সম্পূর্ণরূপে ধর্মীয় বিষয়বস্তুকে অতিক্রম করে।

গবেষক তাহমিদ জান আযহারি বলেন, “ইমরান খান প্রকাশ্যে উদারনীতির পক্ষে কথা বলেন। একই সঙ্গে ইসলামী মূল্যবোধের প্রতিও আবেদন করেন। যেমন মদিনার রাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিরোধী মনোভাবের কথা উল্লেখ করেন।” এই কৌশলটি সফল হয়েছে।

ইমরান ‘মদিনার রাষ্ট্র’ ধারণার কথা উল্লেখ করেছেন, যা সামাজিক ন্যায়বিচারের একটি আদর্শ ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে ইতিহাসে পরিচিত। এই ধারণাটি এমন ভোটারদের সাড়া জাগিয়েছে যারা ইসলামী নীতির উপর ভিত্তি করে একটি সমাজ গঠন করতে চান। কিন্তু ইসলামপন্থী দলের কট্টরপন্থা ও গোষ্ঠীত্বের প্রতি তাদের আস্থা নেই।

প্রজন্মগত ও ডিজিটাল বিচ্ছিন্নতা

পিটিআইয়ের উত্থান কেবল রাজনৈতিক পরিবর্তনই ছিল না, এটি ছিল প্রজন্মগত পরিবর্তনেরও নিদর্শন। সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্বের সঙ্গে ক্রমশ যুক্ত হচ্ছে পাকিস্তানের তরুণ প্রজন্ম। ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় অনুসঙ্গ তাদের কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

তরুণ প্রজন্ম বেকারত্ব, অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান খরচের মতো বাস্তব সমস্যার সমাধানকে অগ্রাধিকার দেয়। এসব ক্ষেত্রে ইসলামপন্থী দলগুলো পিছিয়ে। সোশাল মিডিয়ার ব্যাপক প্রসার ও বিভিন্ন তথ্যের প্রবেশাধিকার পাকিস্তানের ভোটারদেরকে আরও জ্ঞানী ও বিচক্ষণ করে তুলেছে।

অনেক ইসলামী দল পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ হচ্ছে। তারা পুরনো নীতি ও বার্তা ধারণ করে রেখেছে। ফলে তারা বৃহত্তর ও সমালোচনামূলক ভোটারদের কাছে আবেদন রাখতে পারছে না।

গ্যালাপের গিলানির মতে, “টিএলপি নতুন ভোটারদের টানতে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যবহার করেছে। অন্যদিকে জেইউআই-এফের মতো দলগুলো তাদের পুরনো পন্থাতেই আস্থা রেখেছে। পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে গেলে তাদেরও আধুনিক হতে হবে।”

জেইউআই-এফের এক তরুণ কর্মী একবার টিকটকে অ্যাকাউন্ট করে দলের কর্মকান্ড প্রচার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দলের নেতাদের আচরণের কারণে তাকে অ্যাকাউন্টটি ডিলিট করতে হয়। নতুন যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ওই নেতারা গ্রহণ করতে চায় না।

নির্বাচনে ভরাডুবির পর দলটি অবশ্য একটি সোশাল মিডিয়া টিম গঠন করেছে। কিন্তু কেউ কেউ বলছেন, এমন পদক্ষেপ নিতে দলটি অনেক দেরি করেছে।

জামায়াতে ইসলামীও ডিজিটাল মার্কেটিং শুরু করেছিল নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দলটির এই উদ্যোগ তরুণ ভোটারদের কাছে টানতে পারেনি। ফলে এটা বোঝা যায় যে, অনলাইনে শুধু উপস্থিতিই যথেষ্ট নয়। সেখানে প্রচারিত বিষয়বস্তু ও বক্তব্য অবশ্যই প্রাসঙ্গিক ও আকর্ষণীয় হতে হবে।

প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা

লাহোরে গত ৭ মার্চ প্রাদেশিক কমিটির এক বৈঠক হয়। সেখানে মাওলানা ফজল বলেন, “একটি প্রতিষ্ঠানের আধিপত্য আমরা মেনে নেব না।” স্পষ্ট না বলেও তিনি ক্ষমতাসীনদের ‘সীমার মধ্যে থাকার’ সতর্কতা দেন।

বিশ্লেষকরা ফজলের অবস্থানকে একটি বড় ধরনের প্রবণতার লক্ষণ হিসাবে দেখছেন। পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী মনোভাব ক্রমশ জোরদার হচ্ছে। ভোটাররা, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা করেন। এই প্রবণতা সাম্প্রতিক নির্বাচনে পিটিআইকে শক্তিশালী অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে।

জেইউআই-এফের মতো ধর্মীয় দলগুলোর অবস্থা এখন অনেকটাই অনিশ্চিত। ঐতিহ্যগতভাবে সামরিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার কারণে তারা ভোট হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে।

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও ইসলামী দলের মধ্যে সম্পর্ক সবসময়ই জটিল। শুরুর দিকে সামরিক বাহিনী এই দলগুলোকে ধর্মনিরপেক্ষ ও বামপন্থী আন্দোলন প্রতিরোধ করতে কাজে লাগাত। এ কারণে তাদের রাজনীতিতে কিছুটা স্বাধীনতা দেওয়া হতো। যাহোক, জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামী দলগুলো সাধারণ ভোটারদের কাছে আকর্ষণ হারিয়ে রাজনীতির প্রান্তিকে অবস্থান করছে এখন।

আফগানিস্তানে সোভিয়েত হামলা পাকিস্তানের রাজনীতিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মুজাহিদিন যোদ্ধাদের সংগ্রহের জন্য সামরিক বাহিনী ইসলামী দলগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে দেখতে শুরু করে। জেইউআই-এফ ও জেআইসহ দলগুলো সক্রিয়ভাবে আফগান প্রতিরোধকে সমর্থন করে। ফলে দেশের অভ্যন্তরে তাদের প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ে।

এরপর জেনারেল জিয়া-উল হকের ‘ইসলামীকরণ’ নীতির কারণে রাষ্ট্র ও এই ধর্মীয় দলগুলোর মধ্যে সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়। এই সম্পর্কই বদলে যাওয়া রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাদের গলার ফাঁস হয়ে উঠেছে বলেও অনেকে মনে করেন।

ধর্মীয় মূল্যবোধ বনাম রাজনীতি

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাকিস্তানের অনেকেই ধর্মীয় মূল্যবোধ ও রাজনীতির মধ্যে একটি বিচ্ছিন্নতা অনুভব করেন।

করাচির গবেষক শিগ্রির মতে, “রাজনৈতিক দলগুলো কার্যকারিতা ও আপসকে গুরুত্ব দেয়। ফলে নৈতিকতার সঙ্গে তারা সমঝোতা করে। সাধারণ মানুষের কাছে রাজনীতিকরা প্রতারণামূলক কৌশল অবলম্বনকারী ও ধর্মীয় আদর্শ থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষে পরিণত হয়। এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই মনে করেন, ধর্মীয় পণ্ডিতদের রাজনীতি এড়িয়ে শুধু আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনা দেওয়ার দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিৎ।”

তিনি আরও বলেন, “ইসলামী দলগুলো সাধারণ মানুষের জীবনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা উপেক্ষা করে শুধু ধর্মীয় বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেয়। সাধারণের জন্য একটি সার্বিক ও আকর্ষণীয় নির্বাচনী ইশতেহার না থাকায়, দলগুলো সমস্যার সমাধান খুঁজতে থাকা ভোটারদের কাছে সাড়া জাগাতে ব্যর্থ হয়।”

পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষ ধর্মপ্রাণ হলেও, কোনও নির্দিষ্ট একটি দলের বিশেষ ধর্মীয় আদর্শের প্রতি তাদের সমর্থন সবসময় নাও থাকতে পারে।

এবিষয়ে শিগ্রি বলেন, “মানুষ হয়তো ধর্মীয় অনুষঙ্গ থাকা দলগুলোর দিকে ঝুঁকতে পারে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ওই দলগুলোকে তারা সমর্থন করে। দেশের বিচিত্র ধর্মীয় পরিস্থিতি এই অবস্থাকে আরও জটিল করে তোলে। যে কোনও একক দলের পক্ষে সব ধর্মীয় বিশ্বাসের মানুষের কাছে সাড়া ফেলা কঠিন।”

একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়

নির্বাচনে ইসলামী দলগুলোর পরাজয়ের ফলে কঠোর ইসলামী আইন জারি করার তাদের চেষ্টা দুর্বল হয়ে পড়েছে। তবে এতে সমর্থকদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এই হতাশার সমাধান করা না গেলে এবং মূলধারার রাজনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে জনগণের মন জয় করার মতো কোনো বিকল্প দিতে না পারলে তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিপিপি) ও আইএসকেপিসহ কট্টর গোষ্ঠীগুলো এ পরিস্থিতিকে কাজে লাগাতে পারে।

এসব চিন্তার সঙ্গে চ্যাকো ‘সামাজিক আন্দোলন ও নির্বাচনী রাজনীতির মধ্যে থাকা জড়তার’ দিকে দৃষ্টি দিতে বলেন। সাধারণত সামাজিক আন্দোলনগুলো নির্বাচনে জেতার জন্য প্রয়োজনীয় মধ্যমপন্থী দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে ‘সীমিত – কখনো কখনো উগ্র’ দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করে।

এই টানাপোড়েন আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে টিটিপির সাম্প্রতিক বিবৃতিতে। সংগঠনটি পরাজিত ইসলামী দলগুলোকে আফগান তালেবানের অনুপ্রেরণায় একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। এই বিবৃতি রাজনৈতিক শূন্যস্থানের সম্ভাব্য বিপদগুলো তুলে ধরে।

এছাড়াও নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর সঙ্গে কিছু ধর্মীয় দলের সম্পর্ক জনগণের কাছে ইসলামী দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের চলমান লড়াই উগ্রপন্থীদের প্রতি সহানুভূতিশীল বা তাদের নিয়ন্ত্রণে অক্ষম এমন ধর্মীয় দলের প্রতি বিতৃষ্ণা তৈরি করেছে।

এই জটিলতা মোকাবেলায় পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে এসে পৌঁছেছে। টেকসই গণতান্ত্রিক অগ্রগতির জন্য জনগণের ক্ষোভ দূর করা, অন্তর্ভুক্তিমূলকতা প্রচার করা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা খুবই দরকার।

তথ্যসূত্র : ডন

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত