পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ খাইবার পাখতুনখোয়ার কুররম জেলা আবারও রক্তাক্ত। সেখানে গত ৯ দিনে শিয়া-সুন্নি সংঘর্ষে এরই মধ্যে ১১০ জন নিহত হয়েছে।
আফগান সীমান্তের এই জেলায় শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বের জেরে সহিংসতা নতুন কিছু নয়। ২০০৭ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে কুররমে এই গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে দুই হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়। বাস্তুচ্যুত হয় হাজার হাজার মানুষ।
সেখানে নতুন করে সহিংসতার শুরু গত ২১ নভেম্বর, কুররমের বাগান শহরে শিয়া মুসলমানদের একটি গাড়িবহরে বন্দুকধারীদের হামলার পর। তাতে অন্তত ৪৫ জন নিহত হয়।
হামলাটি চালিয়েছিল ১০ জনের একটি দল। গাড়িবহরটি বাগানের পার্বত্য এলাকার ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় তারা রাস্তার উভয় দিক থেকে নির্বিচারে গুলি করে। এসময় গাড়িবহরে দুশোর মতো যাত্রী ছিল।
হামলার পরদিন থেকেই সুন্নিদের ওপর শিয়াদের প্রতিশোধমূলক পাল্টা হামলা শুরু হয়। যদিও এখনও কেউ এই হামলার দায় স্বীকার করেনি।
২৪ নভেম্বর প্রাদেশিক সরকারের মধ্যস্থতায় দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সাত দিনের একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। কিন্তু তাতেও সংঘর্ষ থামছে না।
শেষে সরকার সেখানে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বুধবার খাইবার পাখতুনখোয়ার প্রাদেশিক সরকার এক বিবৃতিতে বলেছে, কুররমের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে সেনা মোতায়েন থাকবে। পাশাপাশি শান্তি আলোচনাও চলবে।
পাকিস্তানে ধর্মীয় সংঘর্ষ একটি সাধারণ ঘটনা। কুররম জেলারও সহিংসতার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এর মূল কারণ হলো শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতা, গোষ্ঠী প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ভূরাজনৈতিক প্রভাব।
পাকিস্তানের ২৪ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে শিয়া মুসলমান প্রায় ১৫ শতাংশ। সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের এই দুই সম্প্রদায় সাধারণত শান্তিপূর্ণভাবেই সহাবস্থান করে। তবে ব্যতিক্রম কুররম জেলা।
এ অঞ্চলটি বহুদিন ধরেই ধর্মীয় সংঘর্ষে জর্জরিত। সুন্নি উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলো প্রায়ই শিয়া সম্প্রদায়কে লক্ষ্যবস্তু করে হামলা চালায়। তবে বর্তমান সহিংসতার মূল কারণ জমি নিয়ে বিরোধ।
সেখানকার শিয়া ও সুন্নি মুসলিমদের মধ্যে কয়েক দশক ধরে ভূমি নিয়ে বিরোধের জেরে এ ধরনের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা চলে আসছে। গত জুলাই থেকে সেখানে দাঙ্গায় অন্তত ২০০ মানুষ নিহত হয়েছে।
কুররমের শিয়া ও সুন্নি সম্প্রদায়
কুররম আফগানিস্তানের লোগার, পাকতিয়া, খোস্ত ও নানগারহার প্রদেশ সংলগ্ন এবং পশ্চিমে ১৯২ কিলোমিটার দীর্ঘ ডুরান্ড লাইনের সঙ্গে যুক্ত। এখানকার ঐতিহাসিক পাইওয়ার কোটাল পাসের মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে আফগান রাজধানী কাবুলে পৌঁছানোর সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত পথ রয়েছে।
২০২৩ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, কুররমের জনসংখ্যা ৭ লাখ ৮৫ হাজার। এর মধ্যে ৯৯ শতাংশের বেশি আফগান পশতুন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। পশতুনরা আবার তুরি, বাংলাশ, জায়মুস্ত, মঙ্গল, মুক্বল, মাসুজাই ও পারাচামকানি গোষ্ঠীতে বিভক্ত। তুরি ও বাংলাশ গোষ্ঠীর কিছু মানুষ শিয়া, বাকি সবাই সুন্নি।
২০১৮ সালে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন জানায়, কুররম জেলার জনসংখ্যার প্রায় ৪৫ শতাংশ শিয়া মুসলিম। এই অনুপাত দেশটির মোট জনসংখ্যায় তাদের অংশের (১৫ শতাংশের) তুলনায় তিন গুণ বেশি।
শিয়াদের বেশিরভাগই উচ্চ কুররম তহসিলে বাস করে। আর নিম্ন ও মধ্য কুররমে সুন্নিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ।
উচ্চ কুররম তহসিলের শিক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচকগুলো সুন্নি-প্রধান তহসিলগুলোর তুলনায় অনেক ভালো। বাগান শহরটি নিম্ন কুররমে অবস্থিত, যা পারাচিনার জেলা সদর থেকে পেশোয়ারের প্রাদেশিক সদর দপ্তরে যাওয়ার পথে অবস্থিত।
সংঘর্ষের ঐতিহাসিক পটভূমি
উচ্চ ও নিম্ন কুররমের অধিকাংশ ভূমির নিয়ন্ত্রণ একসময় শিয়া তুরি সম্প্রদায়ের হাতে ছিল। তবে বর্তমানে তারা মূলত উচ্চ কুররমে সীমাবদ্ধ। উচ্চ কুররম তহসিলের জনসংখ্যার প্রায় ৮৩ শতাংশ শিয়া। এরা তুরি ও বাংলাশ গোষ্ঠীর সদস্য।
তাদের মধ্যে প্রায়ই প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সম্পদের জন্য প্রতিযোগিতার ফলস্বরূপ ধর্মীয় উত্তেজনাও দেখা দেয়। সম্পদে অভাবগ্রস্ত এই অঞ্চলে এমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা দীর্ঘদিন ধরেই বিদ্যমান। বলা যায় প্রায় সেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকেই।
ব্রিটিশরা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করতে বিভিন্ন গোষ্ঠীকে পৃষ্ঠপোষকতা ও ঘুষ দেওয়ার কৌশল নিয়েছিল। এতে কিছু নির্দিষ্ট গোষ্ঠী উপকৃত হয়। অন্যরা হয় বঞ্চিত। ফলে তাদের মাঝে গভীর অসন্তোষ সৃষ্টি হয়, যা প্রায়ই জমি নিয়ে বিরোধের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়।
ব্রিটিশদের বিদায়ের পরও অঞ্চলটির শাসন পদ্ধতিতে তেমন কোনও পরিবর্তন হয়নি। কুররম ফেডারেলি অ্যাডমিনিস্টারড ট্রাইবাল এরিয়া (ফাটা)-র অংশ ছিল। এখানে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ আইন কার্যকর ছিল। এরপর ফাটা খাইবার পাখতুনখোয়ার সঙ্গে একীভূত হয়।
৮০-র দশকের বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহ ও কুররমে উত্তেজনার ভিত্তি
স্নায়ু যুদ্ধের সময় প্রায় একসঙ্গে ঘটে যাওয়া তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক ঘটনা কুররমের বর্তমান উত্তেজনার ভিত্তি তৈরি করে।
ইরানের ইসলামী বিপ্লব (১৯৭৯)
ইরানে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে একটি শিয়া ধর্মতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্ম হয়। কুররম এই প্রতিযোগিতার ছায়া যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। ইরান শিয়া গোষ্ঠীগুলোর এবং সৌদি আরব সুন্নি গোষ্ঠীগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা করে। ফলে পুরনো গোষ্ঠীকেন্দ্রিক বিরোধগুলো স্পষ্ট ধর্মীয় রূপ নিতে শুরু করে।
সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ (১৯৭৯-৮৯)
দশ বছরব্যাপী এই যুদ্ধ কুররমে আরও বড় প্রভাব ফেলে। সেসময় অঞ্চলটি ছিল যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত মুজাহিদিনদের গোপন আস্তানা এবং সংঘর্ষ থেকে পালিয়ে আসা (মূলত সুন্নি) আফগান শরণার্থীদের আশ্রয়স্থল।
বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থান
ওই যুদ্ধের সময় কুররমে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী ও মিলিশিয়াদের উত্থান ঘটে। ফলে কুররমের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা আরও জটিল হয়ে ওঠে।
গত তিন দশকেও কুররম বিভিন্ন উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে শিয়া-বিরোধী পাকিস্তানি তালেবান (টিটিপি) এবং ইসলামিক স্টেট (আইএস)। তারা আফগানিস্তানের সঙ্গে সংযোগস্থল পোরাস সীমান্ত দিয়ে সহজেই চলাফেরা করে এবং দুর্গম পাহাড়ি এলাকা তাদের কর্মকাণ্ডে সহায়তা করে।
এছাড়া পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া-উল-হকের (১৯৭৭-১৯৮৮) নীতি কুররমের বর্তমান পরিস্থিতি তৈরিতে তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জিয়ার রাজনৈতিক প্রকল্পের কেন্দ্রবিন্দু ছিল সুন্নি ইসলামিকরণ। তাই এই নীতি পাকিস্তানজুড়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা আরও বাড়ায়।
জিয়া কুররমে সুন্নি আফগান শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে শিয়া তুরি সম্প্রদায়কে দুর্বল করার চেষ্টা করেন। এ নীতি কুররমের সামাজিক ভারসাম্যকে আরও জটিল করে তোলে এবং বর্তমান সংঘাতের বীজ বপন করে।
ধর্মীয় সংঘাত ও চলমান সহিংসতা
উপরের এসব কারণ মিলে কুররমে বিরতিহীন সাম্প্রদায়িক সহিংসতার জন্ম দেয়। বিশেষ করে, গত তিন দশকে আফগান তালেবানের উত্থানের পর সংঘর্ষ বেশি বাড়ে। পাকিস্তানি তালেবানরা শাসন ও উন্নয়নের অভাব নিয়ে স্থানীয় অসন্তোষকে কাজে লাগায় এবং বিদ্যমান ধর্মীয় বিভাজনকে আরও উসকে দেয়।
পাকিস্তানের সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৭ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে কুররমে শিয়া ও সুন্নি সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষে ২ হাজার এর বেশি মানুষ নিহত এবং ৫,০০০ জনের বেশি আহত হয়। আর হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়।
এ বছর, বিশেষ করে জুলাইয়ের শেষ থেকে, জমি নিয়ে বিরোধ থেকে ব্যাপক রক্তপাত শুরু হয়। পারাচিনারের দক্ষিণে বসবাসকারী শিয়া তুরি গোত্রের মালি খেল উপগোত্র এবং সুন্নি মাদগি কালাই গোষ্ঠীর মধ্যে এই সংঘর্ষ হয়। এতে প্রায় ২ শতাধিক মানুষ নিহত হয়।
তথ্যসূত্র : দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, আল জাজিরা, দ্য ডন