এক সপ্তাহ আগেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন শেহবাজ শরিফ; এবার প্রেসিডেন্টও হলেন আসিফ আলী জারদারি। তারা দুজনই মুসলমান। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট কিংবা প্রধানমন্ত্রী পদে কোনও অমুসলিমের আসার সুযোগই নেই।
দেশটির সংবিধানেই এবিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। তবে সমালোচক ও পর্যবেক্ষকরা পাকিস্তানের সংবিধানের এমন বিধানকে বৈষম্যমূলক হিসাবে দেখেন।
পাকিস্তানের সংবিধানের ৪১ অনুচ্ছেদের ২ ধারায় বলা হয়েছে, “রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হতে একজন ব্যক্তিকে অবশ্যই মুসলমান এবং তার বয়স ৪৫ বা এর বেশি হতে হবে। একই সঙ্গে জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতাও অর্জন করতে হবে।”
একইভাবে ৯১ অনুচ্ছেদের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, “স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচনের পর জাতীয় পরিষদ অন্য কোনও কাজ বাদ দিয়ে তার একজন মুসলিম সদস্যকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য বিতর্ক ছাড়াই নির্বাচন করবে।”
কেন অমুসলিমরা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না, এনিয়ে একটি বিতর্ক হয়েছিল ২০১৯ সালে। তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইমরান খান।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) একজন খ্রিস্টান আইনপ্রণেতা ডা. নাভিদ আমির জিভা তৎকালীন পার্লামেন্টে একটি বিল উত্থাপন করেছিলেন। তিনি সংবিধানের যেসব অনুচ্ছেদে অমুসলিমদের প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট হতে বাধা দেয়, সেখানে সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
তিনি চেয়েছিলেন সংবিধানের বিতর্কিত ৪১ ও ৯১ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হোক। এনিয়ে পার্লামেন্টে তর্ক-বিতর্কও হয়েছিল সেসময়। কিন্তু পার্লামেন্ট ওই সংশোধনী প্রস্তাবটি বাতিল করে দিয়েছিল।
তখন তৎকালীন পার্লামেন্ট বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী আলী মোহাম্মদ প্রস্তাবটির বিরোধিতা করে বলেছিলেন, “পাকিস্তান একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র যেখানে শুধু একজন মুসলিম প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন।”
শুধু ৪১ ও ৯১ অনুচ্ছেদ দিয়েই অমুসলিমদের দেশ শাসনের এখতিয়ার থেকে দূরে রাখা হয়নি। ১৯৭৪ সালে দ্বিতীয় সংশোধনী এনে দেশটির আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মানুষদের অমুসলিম হিসাবে ঘোষণা করা হয়।
দণ্ডবিধির ২৯৮ (খ) ও ২৯৮ (গ) ধারাগুলোকে সাধারণত ‘আহমদিয়াবিরোধী আইন’ নামে অভিহিত করা হয়। এই আইনে আহমদিয়াদের নিজেদের মুসলিম বলা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি তারা যেন তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে ইসলাম হিসাবে উল্লেখ না করে ও নিজেদের ধর্ম প্রচার না করে, এসব বিষয়ও নিশ্চিত করা হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট হলেন আসিফ আলী জারদারি
পাকিস্তানের পঞ্চদশ প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হলেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) কো-চেয়ারম্যান আসিফ আলী জারদারি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর স্বামী জারদারি এনিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট হলেন।
শনিবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত গোপন ব্যালটে ভোট দেয় দেশটির পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সেনেট, নিম্নকক্ষ জাতীয় পরিষদ এবং পাঞ্জাব, সিন্ধু, খাইবার পাখতুনখাওয়া ও বেলুচিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা।
ডন বলছে, জারদারি জাতীয় পরিষদ ও সেনেটের ২৫৫ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। আর তার প্রতিদ্বন্দ্বী পিটিআই (পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ) সমর্থিত মেহমুদ খান আচকজাই পেয়েছেন ১১৯ ভোট।
রবিবার নতুন প্রেসিডেন্টের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান হবে।
ভোটের ফল মেনে নিয়ে আচকজাই বলেন, “এই নির্বাচনের সবচেয়ে অস্বাভাবিক বিষয় ছিল যে প্রথমবারের মতো ভোট কেনা বা বিক্রি হয়নি। পাকিস্তানে এমন কিছু লোক আছে, যারা মনে করে সব কিছু কেনা-বেচা করা যায়।”
ছয়টি আইনসভার ১ হাজারের বেশি আইনপ্রণেতা নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য ভোট দিয়েছেন। শুরু থেকেই জারদারি এগিয়ে ছিলেন আচকজাইয়ের চেয়ে। শুধু খাইবার পাখতুনখাওয়ায় এগিয়ে ছিলেন আচকজাই।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পিপিপি নেতা জারদারিকে সমর্থন দিয়েছে পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন), মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট-পাকিস্তান (এমকিউএম-পি), বেলুচিস্তান আওয়ামী পার্টি (বিএপি), ইস্তেহকাম-ই-পাকিস্তান পার্টি (আইপিপি), আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টি (এএনপি), পাকিস্তান মুসলিম লীগ-কায়েদ (পিএমএল-কিউ), ন্যাশনাল পার্টি (এনপি) ও পাকিস্তান মুসলিম লীগ-জিয়া (পিএমএল-জেড)।
আর পশতুনখোয়া মিল্লি আওয়ামী পার্টির সভাপতি মেহমুদ খান আচকজাইকে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন দেয় পিটিআই। তাকে সমর্থন দেয় মজলিস ওয়াহদাত-ই-মুসলিমিন (এমডব্লিউএম) ও গ্র্যান্ড ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (জিডিএ)।
জমিয়ত উলামায়ে ইসলাম-ফজল (জেইআই-এফ) ও জামায়াতে ইসলামী (জেআই) ভোটদান প্রক্রিয়া থেকে বিরত থাকার ঘোষণা দেয়। কয়েকটি ছোট দল স্পষ্ট কোনও ঘোষণা দেয়নি।
মার্চের শুরুতেই আগেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন হলো। এতে পার্লামেন্টের ২০১ জন আইনপ্রণেতার ভোটে দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) প্রধান শেহবাজ শরিফ।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রক্রিয়া
১৯৮৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী নিয়ম অনুসারে, পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন (ইসিপি) প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পরিচালনার ভূমিকা পালন করে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) রিটার্নিং অফিসার (আরও) হিসেবে কাজ করেন।
পার্লামেন্ট ভবন আইনপ্রণেতাদের জন্য ভোটকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়। অন্যদিকে প্রাদেশিক পরিষদগুলো পরিষদ সদস্যদের জন্য ভোটকেন্দ্র হিসেবে কাজ করে।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সব ভোট সমান গুরুত্বপূর্ণ না। সেনেটর, জাতীয় পরিষদ সদস্য (এমএনএ) ও বেলুচিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের ভোটের মূল্য এক। সিন্ধু, পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনখাওয়ার (কেপিকে) প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের (এমপিএ) ভোটের গণনা একটু আলাদা পদ্ধতিতে হয়।
এক্ষেত্রে, সবচেয়ে কম আসন সংখ্যার প্রদেশের (বেলুচিস্তান) সামগ্রিক আসন সংখ্যা দিয়ে অন্য প্রদেশের ভোটের সংখ্যা গুণ করা হয়। এরপরে গুণফলটিকে ঐ প্রদেশের প্রাদেশিক পরিষদের সামগ্রিক আসন সংখ্যা দ্বারা ভাগ করা হয়।
যেহেতু বেলুচিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সর্বনিম্ন আসন সংখ্যা ৬৫, তাই তিনটি প্রাদেশিক পরিষদের মোট ভোটও ৬৫ ধরা হবে।
ধরা যাক পাঞ্জাব প্রাদেশিক পরিষদে ৩৭১ জন সদস্য রয়েছেন। এই সংখ্যাকে ৬৫ দিয়ে ভাগ করলে পাওয়া যায় ৫ দশমিক ৭০। এর মানে হলো – ৬ জন পাঞ্জাব এমপিএ’র ভোট ১ ভোট হিসেবে ধরা হবে।
এই পদ্ধতিতে সব প্রাদেশিক পরিষদের মোট ভোটের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৯৬টি। তবে বিভিন্ন কারণে কিছু আসন খালি থাকায় এবং কিছু সদস্য এখনও শপথ না নেওয়ায়, ভোটদানের মোট সংখ্যা ৬৪০ থেকে ৬৫০ এর মধ্যে হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তথ্যসূত্র : ডন, এক্সপ্রেস ট্রিবিউন