পাকিস্তানের বিতর্কিত নির্বাচন নিয়ে নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে। রাওয়ালপিন্ডির কমিশনার লিয়াকত আলী ছাট্টা শনিবার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ৮ ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে ভোট কারচুপির কথা স্বীকার করে এই বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন।
তিনি বলছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) সিকান্দার সুলতান রাজা ও প্রধান বিচারপতি (সিজেপি) কাজী ফয়েজ ইসা ভোট ‘কারচুপির’ সঙ্গে জড়িত। তারা এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী কারাবন্দি ইমরান খানের দল পিটিআইসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল দেশব্যাপী ভোট কারচুপিবিরোধী প্রচার শুরুর সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রায় এক সপ্তাহ পর রাওয়ালপিন্ডির কমিশনার ছাট্টা এই স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। দলগুলো বলছে, ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে ‘ব্যাপক কারচুপির’ মাধ্যমে তাদেরকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
পাকিস্তান সুপার লিগ আয়োজন নিয়ে শনিবার রাওয়ালপিন্ডি ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সংবাদ সম্মেলন ছিল কমিশনার ছাট্টার। এসময় সাংবাদিকদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় তোলপাড় করা এ অভিযোগ করেন তিনি।
লিয়াকত আলী ছাট্টা ‘বিবেকের তাড়নায়’ নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগের তথ্য প্রকাশ করার কথা জানান সাংবাদিকদের। সিইসি সিকান্দার সুলতান রাজা ও প্রধান বিচারপতি কাজী ফয়েজ ইসার বিরুদ্ধে ভোট ‘কারচুপি চক্রান্তে’ যুক্ত থাকার অভিযোগও করেন তিনি।
রাওয়ালপিন্ডির কমিশনার ছাট্টা এসময় তার তত্ত্বাবধানে বিভাগের ছয় জেলার ১৩ আসনের ফল পরিবর্তন করে জনগণের ম্যান্ডেট চুরির দায়-দায়িত্ব স্বীকার করেন। এজন্য পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলেও জানান।
ছাট্টার দাবি, নির্বাচনে যেসব প্রার্থী ‘হেরে যাচ্ছিলেন’ তাদের ‘বিজয়ী করা হয়েছে’। ‘কিছু দপ্তরে সংগঠিতভাবে’ কারচুপি করা ফলের ন্যায্যতা দেওয়ার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
ছাট্টা বলেন, “আমি এই সব অন্যায়ের দায় নিচ্ছি এবং আপনাদের বলছি যে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও প্রধান বিচারপতি এর সঙ্গে পুরোপুরিভাবে জড়িত ছিলেন।”
তার দাবি, কারচুপির মাধ্যমে ৭০ হাজার ভোটে এগিয়ে থাকা প্রার্থীদেরও রানার আপ ঘোষণা করা হয়েছে। লিয়াকত আলী ছাট্টা বলেন, “আমরা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জাল ভোট দিয়ে হারিয়েছি।”
তিনি বলেন, “এই অন্যায়ের জন্য আমার শাস্তি হওয়া উচিৎ, কুচারী চকে নিয়ে আমাকে ফাঁসিতে ঝোলানো উচিৎ। এই অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত অন্যদেরও শাস্তি হওয়া উচিৎ।”
ছাট্টা বলেন, “দেশের পিঠে এভাবে ছুরি মারার পর আমি রাতে ঘুমাতে পারিনি।”
তিনি জানান, ভোট কারচুপির অপরাধবোধ থেকে তিনি আত্মহত্যার চিন্তাও করেছিলেন। তবে তা করেননি। কারণ, এই খবর জনগণকে জানানো দরকার ছিল।
সংবাদ সম্মেলনের পর ছাট্টা পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তাকে রাওয়ালপিন্ডির বিভাগীয় কমিশনারের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বদলি করা হয়েছে লাহোরের এক দপ্তরে।
পুলিশের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, ছাট্টার বিরুদ্ধে কোনও মামলা না হওয়ায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। তাকে ‘হেফাজতে’ নেওয়া হয়েছে। তবে তাকে কোথায় রাখা হয়েছে তা জানা যায়নি।
পুলিশ তাকে হেফাজতে নেওয়ার পর তার অফিসও সিলগালা করে দিয়েছে, যাতে কারচুপির কোনও প্রমাণ লোপাট না হয়। রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ নির্বাচনী সরঞ্জামের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে বলেও জানিয়েছে পুলিশ।
পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন (ইসিপি) ও প্রধান বিচারপতি (সিজেপি) উভয়ই এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন।
প্রধান বিচারপতি কাজী ফয়েজ ইসা বলেছেন, সুপ্রিম কোর্ট শুধু নির্বাচন-সম্পর্কিত পিটিশনগুলো নিয়ে কাজ করেছে। ছাট্টার কারচুপির অভিযোগের পক্ষে প্রমাণ উপস্থাপন করা উচিৎ।
তিনি বলেন, ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে তার ভূমিকা কেবল প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি ও প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে একটি তারিখ নির্ধারণের নির্দেশ দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
ইসলামাবাদে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে প্রধান বিচারপতি বলেন, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা নির্বাচনের কোনও আদেশ দেননি।
প্রধান বিচারপতি বলেন, “আমি পরিষ্কার করে বলছি, প্রেসিডেন্ট ও সিইসির মধ্যে টানাপোড়েন চলছিল। তাই আমরা কেবল তাদের আলোচনায় বসতে ও সিদ্ধান্ত নিতে বলেছিলাম।”
পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন (ইসিপি) এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করার পাশাপাশি অভিযোগটি খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
ইসিপি এক বিবৃতিতে বলেছে, “কোনও বিভাগের কমিশনারকে কখনও নির্বাচনে ডিস্ট্রিক্ট রিটার্নিং অফিসার (ডিআরও) বা রিটার্নিং অফিসার (আরও) বা প্রিজাইডিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় না। বা তারা কখনও নির্বাচন পরিচালনায় সরাসরি ভূমিকা পালন করেন না।”
পাঞ্জাবের তত্ত্বাবধায়ক তথ্যমন্ত্রী আমির মীর বলেছেন, “সাবেক কমিশনার তার দাবির ন্যায্যতা প্রমাণ করতে তার অভিযোগের পক্ষে কোনও প্রমাণ উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
“নির্বাচন পরিচালনায় কমিশনারের কোনও ভূমিকা নেই। কারণ এগুলো নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী দলের তত্ত্বাবধানে হয়।”
আমির মীর বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীও এই অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।”
আমির মীরের অভিযোগ, পদোন্নতি আটকে যাওয়ার কারণে ছাট্টা এই অভিযোগ করছেন। গত ১২ ফেব্রুয়ারি তার ২১তম গ্রেডে পদোন্নতি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অবসরের মাত্র এক মাস বাকি থাকায় তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। ছাট্টা তার পদোন্নতির জন্য জোরাল আবেদন জানিয়েছিলেন বলেও দাবি করেন আমির মীর।
তথ্যসূত্র: দ্য ডন