Beta
শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৫

ফাতাহ-হামাস এবারের ঐক্য চুক্তি কি টিকবে

ফাতাহর কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান মাহমুদ আল-আলউল (বামে), চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই (মাঝে) এবং হামাসের সিনিয়র সদস্য মুসা আবু মারজুক গত ২৩ জুলাই বেইজিংয়ের দিয়াওইউতাই স্টেট গেস্টহাউসে এক অনুষ্ঠানে। ছবি: রয়টার্স।
ফাতাহর কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান মাহমুদ আল-আলউল (বামে), চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই (মাঝে) এবং হামাসের সিনিয়র সদস্য মুসা আবু মারজুক গত ২৩ জুলাই বেইজিংয়ের দিয়াওইউতাই স্টেট গেস্টহাউসে এক অনুষ্ঠানে। ছবি: রয়টার্স।
[publishpress_authors_box]

ইসরায়েলি হামলার প্রেক্ষাপটে নিজেদের বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হতে একটি চুক্তিতে সই করেছে ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক দলগুলো।

গত মঙ্গলবার ‘জাতীয় ঐক্য’ চুক্তিতে তাদের সই করা পর ফিলিস্তিনিদের মধ্যে আশা জেগেছে, ইসরায়েলি দখলদারত্বের অবসান ঘটানোর জন্য এখন থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে তাদের দলগুলো।

তবে হামাস ও ফাতাহ তাদের আদর্শগত পার্থক্য এবং বিরোধের তিক্ত ইতিহাস ভুলে কতদিন এক থাকতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েই গেছে।

চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে তিন দিনের নিবিড় আলোচনার পর চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির মধ্য দিয়ে যুদ্ধোত্তর গাজার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ এবং আত্ম-নিয়ন্ত্রণের জন্য ঐক্যবদ্ধ লড়াইকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন ‘জাতীয় পুনর্মিলন’ সরকারের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে।

কাতারের রাজধানী দোহাভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক মিডল ইস্ট কাউন্সিল অন গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ওমর রহমান বলেন, “সংশয় থাকা সত্ত্বেও আমি আশাবাদী এই চুক্তিটি টিকে যাবে।”

তিনি বলেন, “গাজা ও পশ্চিম তীরের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এটি সফল হওয়ার জন্য চাপ রয়েছে। আমি মনে করি, সব পক্ষই জানে যে এটি ঘটতে হবে।”

গাজায় যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা ও ভূমি দখলের চলমান প্রবণতার উল্লেখ করে একথা বলেন রহমান।

গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর থেকেই ইসরায়েলি সেনারা গাজায় নজিরবিহীন এক হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের মতে, ইসরায়েল আদতে গাজায় জেনোসাইড চালাচ্ছে।

ইসরায়েলি হামলায় গাজা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

হামাসের হামলায় ১১৩৯ জন ইসরায়েলি নিহত হয়েছিল এবং হামাস যোদ্ধারা ইসরায়েল থেকে ২৫১ জনকে জিম্মি করে নিয়ে যায়।

অন্যদিকে, ইসরায়েল গত সাড়ে নয় মাসে প্রায় ৪০ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে এবং গাজার ২৩ লাখ বাসিন্দার প্রায় সকলকে বাস্তুচ্যুত করেছে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম গাজা যুদ্ধের খবর নিয়ে ব্যস্ত থাকার সুযোগে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে ইসরায়েলিরা আরও ভুমি দখল করে নিয়েছে। গত তিন দশকের যে কোনও বছরের তুলনায় অধিকৃত পশ্চিম তীরে ২০২৪ সালে বেশি ভূমি দখল করেছে ইসরায়েল।

ইসরায়েলের এই দখলদারত্বের মধ্যেও ফিলিস্তিনের দুটি প্রধান দল ফাতাহ ও হামাস বিভক্ত ছিল। ফাতাহ ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) মাধ্যমে পশ্চিম তীরের বেশিরভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। এই ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ১৯৯৩ সালে ফাতাহ ও ইসরায়েলের মধ্যে সই হওয়া অসলো চুক্তির মাধ্যমে জন্ম নেওয়া একটি সত্তা। ওই চুক্তিতে ফাতাহকে সশস্ত্র লড়াই ত্যাগ এবং ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিনিময়ে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল।

স্বাধীনতার জন্য ফাতাহ সশস্ত্র লড়াই ত্যাগ করলেও হামাস অস্ত্র ছাড়েনি। পাশাপাশি হামাস নির্বাচনী রাজনীতিতেও অংশগ্রহণ করে। ২০০৬ সালে হামাস ফিলিস্তিনের জাতীয় নির্বাচনেও বিজয়ী হয়। কিন্তু ২০০৭ সালে দল দুটির মধ্যে গৃহযুদ্ধ বেধে যায়। এরপর থেকে হামাস গাজার আর ফাতাহ পশ্চিম তীরের নিয়ন্ত্রণ করছে।

বিরোধের রক্তাক্ত ইতিহাসের পরও উভয় পক্ষই বেইজিং চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। হামাস ও ফাতাহসহ চুক্তিটিতে ছোটবড় মোট ১২টি দল যোগ দিয়েছে। আল জাজিরার হাতে আসা চুক্তিটির একটি অনুলিপি অনুযায়ী, এই চুক্তির লক্ষ্য ইসরায়েল-অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেম, পুরো পশ্চিম তীর ও গাজা নিয়ে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করা।

ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মাহমুদ আব্বাস।

চুক্তিটি কি টিকবে

আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজি) ফিলিস্তিনি বিশেষজ্ঞ তাহানি মুস্তাফা বলেন, ফাতাহ এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষর (পিএ) নেতা মাহমুদ আব্বাসই প্রথমে হামাসের সঙ্গে পূর্বের সমঝোতা চুক্তিগুলো ভেঙেছেন।

তিনি আল জাজিরাকে বলেন, আব্বাস এবং তার দলের লোকরাই ইসরায়েলের দখলদারত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাতে ফিলিস্তিনি নেতৃত্বকে একত্রিত করার জন্য প্রকৃত রাজনৈতিক ইচ্ছা দেখায়নি।

“প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) ওপর ফাতাহর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এটি এমন একটি সংস্থা যা আন্তর্জাতিকভাবে ফিলিস্তিনিদের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু ফাতাহর ভয় হামাস এবং অন্যান্য দলগুলোকে এই সংস্থায় প্রতিনিধিত্ব করতে দিলে তারা এতে নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাবে। হামাস এবং প্যালেস্টাইন ইসলামিক জিহাদকে (পিআইজে) পিএলওতে যুক্ত করা হলে ফাতাহ সংস্থাটির ওপর তার একচেটিয়া আধিপত্য হারাবে।”

ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রও এই পুনর্মিলন চুক্তিকে দুর্বল করার চেষ্টা করতে পারে, এমন আশঙ্কাও রয়েছে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পিএ বা হামাসকে গাজার নিয়ন্ত্রণ নিতে দেবে না ইসরায়েল। আর যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘকাল ধরেই হামাসকে ফিলিস্তিন সরকারের অংশ হওয়ার শর্ত হিসেবে আগে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেওয়ার এবং অস্ত্র ত্যাগ করার আহ্বান জানাচ্ছে।

২০১৭ সালে একটি নতুন সনদে হামাস ১৯৬৭ সালের সীমানা বরাবর একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের বিষয়টি মেনেও নেয়। এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে হামাস কার্যত ইসরায়েলকেই স্বীকৃতি দেয়; যদিও তারা ইসরায়েলকে সরাসরি স্বীকৃতি দেবে না।

মুস্তফা আল জাজিরাকে বলেন, “হামাস কখনোই [স্পষ্টভাবে] ইসরায়েলের অস্তিত্বের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়নি, কারণ ইসরায়েলের ওপরও কখনও ফিলিস্তিনিদের জন্য একই স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য কোনও চাপ ছিল না।”

ইউরোপীয় কাউন্সিল ফর ফরেন অ্যাফেয়ার্সের ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিশেষজ্ঞ হিউ লোভাট বলেন, ইসরায়েল তার পশ্চিমা মিত্রদেরকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের তহবিল আটকানোর জন্য চাপ দিয়ে এই চুক্তিটিকে লাইনচ্যুত করার চেষ্টা করবে, এমন একটি স্পষ্ট সম্ভাবনাও রয়েছে।

তিনি আল জাজিরাকে বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের কাছ থেকে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা এবং অর্থ সহায়তা ছাড়া ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের টিকে থাকা সম্ভব নয়।

“কিন্তু এটি কেবল ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের টিকে থাকার প্রশ্ন নয়, বরং সংস্থাটির ব্যক্তিদের ব্যক্তিগতভাবে টিকে থাকারও প্রশ্ন। এই ব্যক্তিরা তাদের নিজস্ব ব্যক্তিগত অবস্থানকে ক্ষুণ্ন করতে পারে, এমন কোনও চুক্তিতে খুব কমই আগ্রহী হবে।”

আল জাজিরা মন্তব্যের জন্য ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র নাবিল আবু রুদেইনেহ এবং যুক্তরাজ্যে পিএ-এর মিশন প্রধান হুসাম জোমলটের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। কিন্তু দুজনের কেউই তাতে সাড়া দেননি।

লোভাট বলেন, পিএ পূর্ববর্তী ঐক্য চুক্তিগুলো ভেঙে পড়ার জন্য হামাসকেই দায়ী করে। কারণ হামাস অসলো চুক্তির শর্তাবলী, যেমন, আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং সশস্ত্র লড়াই ত্যাগ করার শর্ত প্রত্যাখ্যান করে।

তিনি বলেন, “মাহমুদ আব্বাস যা বলেন তা হল— আমরা একটি চুক্তি চাই, তবে তা আন্তর্জাতিক বৈধতার উপর ভিত্তি করে হতে হবে।”

গাজার নিয়ন্ত্রণকারী হামাস লড়াই করছে ইসরায়েলের সঙ্গে।

এবারের চুক্তিটি কেন গুরুত্বপূর্ণ

পূর্ববর্তী সমঝোতা চুক্তিগুলো ভেঙে পড়লেও রহমান বলেছেন, এই চুক্তিটির সফল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

তার বিশ্বাস, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিষয়ে আন্তর্জাতিক মতামতের হাওয়া বদল হচ্ছে। এর ফলে গাজায় জেনোসাইড এবং পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের ভুমি দখল বন্ধ করার জন্য একটি ঐক্যবদ্ধ ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব গড়ে তোলার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসের (আইসিজে) একটি ‘পরামর্শমূলক মতামত’ পূর্ব জেরুজালেম, পশ্চিম তীর এবং গাজায় ইসরায়েলের ৫৭ বছরের দখলদারিত্বকে ‘অবৈধ’ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করেছে। আদালত বলেছে, দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলের অব্যাহত উপস্থিতিসহ বসতি স্থাপন এবং সম্প্রসারণ ‘আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন’।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই রায়কে ‘অযৌক্তিক’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন, ইসরায়েলিদের ‘নিজেদের পৈতৃক বাড়িতে নিজস্ব সম্প্রদায়ে’ বসবাস করা বেআইনি হতে পারে না।

রহমান বলেন, “পরিস্থিতি স্পষ্টতই ভয়াবহ এবং ফিলিস্তিনিদের রক্ষায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একত্রিত করার জন্য ফিলিস্তিনিদের নিজেদের মধ্যেও ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্বের প্রয়োজন।”

তবুও সেই ঐক্যের প্রতি যুদ্ধের গতিপথ নির্ধারণে সবচেয়ে প্রভাবশালী বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কোনো অনুমোদন নেই, অন্তত এখনও নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার মঙ্গলবার এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে চুক্তিটির বিষয়ে বলেছেন, “একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের কোনও ভূমিকা থাকতে পারে না।”

যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন হামাসকে একটি ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠন হিসেবে দেখে; যদিও অর্ধেকের বেশি ফিলিস্তিনির চোখে এই দলটি একটি বৈধ প্রতিরোধ গোষ্ঠী।

লোভাট বলেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণে হামাস এবং অন্যান্য দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শ করে পিএ চুক্তিটি বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেও যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ফিলিস্তিনি ঐক্যকে ধ্বংস করতে পারে।

“এটি সত্যিই নির্ধারক উপাদান হতে পারে। তবে প্রশ্ন হল: আব্বাস কি চুক্তিটি রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবেন, নাকি আন্তর্জাতিক চাপের মুখে আবার পিছিয়ে যাবেন?”

তথ্যসূত্র : আল জাজিরা

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত