Beta
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪
Beta
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪

কলাম

দিন দিন কাছে আসছে স্বাধীন ফিলিস্তিন

যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মতোই মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদকারীরাও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কিত কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ বন্ধ করার দাবি জানায়।

গত ২২ এপ্রিল মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ক্যাম্পাসে তাঁবু পেতে ক্যাম্প করে। সেখান থেকে তারা গণহত্যাকারী ইসরায়েল রাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পুঁজির অর্থ বিনিয়োগের সম্পর্ক সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করার দাবি জানায়। এর মধ্য দিয়ে তারা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর হাতে গণহত্যার শিকার ফিলিস্তিনিদের সাথে সংহতি প্রকাশের জন্য আরও বেশ কয়েকটি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনে যোগ দেয়। ইসরায়েলি বাহিনী চলমান হামলায় গাজায় অন্তত ১৪ হাজার ৫শ শিশুসহ ৩৪ হাজার ৫শর বেশি ফিলিস্তিনি এবং অধিকৃত পশ্চিম তীরে ১২৪ শিশুসহ প্রায় ৫শ জনকে হত্যা করেছে।

মিশিগানে শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পের সদস্য হিসেবে আমি যা দেখেছি তা বেশ উৎসাহিত করার মতো। এ বিক্ষোভে ফিলিস্তিনি ও ইহুদি, আরব ও দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত মানুষসহ বিভিন্ন জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচিতির শিক্ষার্থীরা যোগ দিয়েছে। ক্যাম্পাস কমিউনিটির অনেক সদস্য ক্যাম্পের মধ্যে এবং আশেপাশে সময় কাটাচ্ছে: তারা ব্যস্ত ক্যাম্প রক্ষা করা, খাবার বিতরণ করা আর সচক্ষে দেখে সবকিছু শিখতে।

মিশিগানের ক্যাম্পটি পারস্পরিক সাহায্য এবং সমর্থন, আলোচনা আর রাজনৈতিক শিক্ষার দারুণ জায়গা হয়ে উঠেছে। পালা করে টহল দেওয়া, খাবারদাবার বিতরণ আর চিকিৎসার ব্যবস্থার মতো কাজ করছে তারা। এর মাধ্যমে ছাত্ররা শিখছে সাংগঠনিক দক্ষতা।

বর্তমান রাজনৈতিক নীলনকশা এবং নিপীড়নের বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে ‘ইসরায়েলিজম’ এবং ‘দ্য প্রেজেন্ট’ এর মতো চলচ্চিত্রও প্রদর্শিত হয়েছে শিক্ষার্থীদের জন্য। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো আমরাও একটি প্যালেস্টাইন বিষয়ক লাইব্রেরি চালু করেছি। সেখান থেকে যে কেউ ফিলিস্তিনের ইতিহাস বা রাজনৈতিক চিন্তা বিষয়ক বই ধার নিতে পারে। জানতে পারে ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলন সম্পর্কে।

গত এক সপ্তাহে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পে বিভিন্ন শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এর বিষয়বস্তুর মধ্যে ছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিতর্কিত বিনিয়োগ থেকে শুরু করে পরিবেশগত উপনিবেশবাদ এবং আর্মেনিয়ানদের মতো অন্যান্য জাতিগত গোষ্ঠীর প্রতি সংহতি। এছাড়া ছিল ফিলিস্তিনিদের কবিতা পাঠের আয়োজন। বর্তমান রাজনৈতিক নীলনকশা এবং নিপীড়নের বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে ‘ইসরায়েলিজম’ এবং ‘দ্য প্রেজেন্ট’ এর মতো চলচ্চিত্রও প্রদর্শিত হয়েছে শিক্ষার্থীদের জন্য। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো আমরাও একটি প্যালেস্টাইন বিষয়ক লাইব্রেরি চালু করেছি। সেখান থেকে যে কেউ ফিলিস্তিনের ইতিহাস বা রাজনৈতিক চিন্তা বিষয়ক বই ধার নিতে পারে। জানতে পারে ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলন সম্পর্কে।

ক্যাম্পে এ পর্যন্ত ইসরায়েলপন্থী ছাত্রদের করা গোলযোগ খুবই সীমিত রয়েছে। তাদের পাল্টা প্রতিবাদগুলোতে তিন থেকে দশ জন অংশগ্রহণকারীকে দেখা গেছে মাত্র।

‘আমরা একে অপরকে রক্ষা করব’— এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে তাদের নিজস্ব পুলিশ যোগাযোগ এবং আইনি পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা চালু করেছে ক্যাম্পের সংগঠকরা। এটি পুলিশের হস্তক্ষেপের দিকে যেতে পারে এমন কোনও বিরোধের পথ বন্ধ করেছে। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পরের সপ্তাহের গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠানে ঝামেলা না পাকানোর শর্তে ক্যাম্পকে থাকতে দিচ্ছে।

স্পষ্টতই, ফিলিস্তিনিদের ওপর চালানো হত্যাকাণ্ডকে ‘ঝামেলা পাকানো’ মনে করা হয় না।

আমাদের ক্যাম্প ও সারা দেশে অনুরূপ অন্য বিক্ষোভগুলো অহিংস ধরনের হওয়া সত্ত্বেও ইহুদি-বিদ্বেষের অভিযোগ তোলা হয়েছে। গণহত্যাবিরোধী প্রতিবাদকে ইহুদি-বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করা কিন্তু শুধু অবাস্তব নয়, বিপজ্জনকও। এই ধরনের ছাপ্পা মারা উনিশ শতকে সৃষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ জায়নবাদকে একটি শান্তিপূর্ণ ধর্মবিশ্বাস ইহুদি ধর্মের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলে। সংমিশ্রণটি বিপজ্জনক, কারণ এটি এ মিথ্যাকে বহাল রাখে যে ইসরায়েলি সরকার এবং বসতি স্থাপনকারীদের কার্যকলাপকে সব ইহুদিই সমর্থন করে। এ মিথ্যা ধারণা ইসরায়েলি সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করে। আমাদের ক্যাম্পগুলোই তুলে ধরছে, এর সঙ্গে সত্যের কোনও সম্পর্ক নেই। অনেক ক্যাম্পাসেই ইহুদি গোষ্ঠীগুলোই ছিল ফিলিস্তিনপন্থী সংহতির কেন্দ্রে।

গণহত্যাবিরোধী প্রতিবাদকে ইহুদি-বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করা কিন্তু শুধু অবাস্তব নয়, বিপজ্জনকও। এই ধরনের ছাপ্পা মারা উনিশ শতকে সৃষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ জায়নবাদকে একটি শান্তিপূর্ণ ধর্মবিশ্বাস ইহুদি ধর্মের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলে। সংমিশ্রণটি বিপজ্জনক, কারণ এটি এ মিথ্যাকে বহাল রাখে যে ইসরায়েলি সরকার এবং বসতি স্থাপনকারীদের কার্যকলাপকে সব ইহুদিই সমর্থন করে। এ মিথ্যা ধারণা ইসরায়েলি সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করে।

আমরা ফিলিস্তিনিরা তো আমাদের নিপীড়কদের পরিচিতির জন্য দায়ী নই। তবুও আমাদের অনবরত ইহুদি-বিদ্বেষ ছড়ানোর ভয়ের জবাব দিতে বলা হয়। ইসরায়েলি যেসব যুদ্ধ বিমান বোমা ফেলে মা-বাবাকে হত্যা করে গাজার শিশুরা কি তার পাইলটদের ধর্ম নিয়ে চিন্তা করে?

আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়, শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদই যুক্তরাষ্ট্র ও এর বাইরে ইহুদি সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল এবং এখনও রয়েছে। এটি একটি সহজ সত্য যা মার্কিন সরকার এবং প্রতিষ্ঠানগুলো উপেক্ষা করে চলেছে। ট্রি অব লাইফ সিনাগগে (ইহুদি উপাসনালয়) সন্ত্রাসবাদীদের নিরীহ মানুষদের হত্যা করার ঘটনার চেয়ে গাজার গণহত্যার প্রতিবাদ করা ছাত্রদের আন্দোলন নিয়ে তারা বেশি প্রতিক্রিয়া দেখান। শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা যখন শার্লটসভিলের রাস্তায় রাস্তায় ইহুদিবিদ্বেষী স্লোগান দেয় তখন তারা চুপ থাকেন।

কেন? কারণ হচ্ছে, সাম্রাজ্যবাদীদের পরবর্তী প্রজন্ম গড়ে তোলার শিক্ষায়তনগুলোর সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণির শিক্ষার্থীরাও যদি ফিলিস্তিনিদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য নিজেদেরকে বিপদের মুখে ফেলে তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায়, ফিলিস্তিন, মার্কিন তরুণসমাজ ও সামগ্রিকভাবে পশ্চিমা সমাজের ওপর ঔপনিবেশিক লৌহনিগড় ভেঙে পড়তে যাচ্ছে। ফিলিস্তিন অঞ্চল তথা গ্লোবাল সাউথ জুড়ে উপনিবেশবাদ থেকে যারা লাভবান তারা এতে ভীত। ছাত্ররা যদি এত প্রবলভাবে ফিলিস্তিনের জন্য লড়াই করতে প্রস্তুত থাকে, তাহলে তারা তাতেই থেমে থাকবে না— এটাই তাদের ভয়।

এ কারণেই ক্যাম্পাসের বিক্ষোভ দমন করতে যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে নৃশংস শক্তি ব্যবহার করা হয়েছে: কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়, অস্টিনের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় এবং দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত অনেক প্রতিষ্ঠানে। তবে বিক্ষোভ দমন করার পরিবর্তে এ হস্তক্ষেপ শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, অন্যান্য দেশের তরুণদেরও প্রতিবাদী চেতনাকে সংহত করেছে। প্রতিটি গ্রেপ্তার, প্রতিটি স্থগিতাদেশ এবং আমাদের কন্ঠরোধ করার প্রতিটি প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলো কেবল ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন বাড়িয়েই দিয়েছে।

ফিলিস্তিনে যা ঘটছে তা সত্যিই আমাদের সময়ের প্রধান মানবাধিকার ইস্যু। আর ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভের প্রতি মার্কিন প্রতিক্রিয়া এটিকে পরিণত করেছে আমাদের সময়ে বাক স্বাধীনতার প্রধান সমস্যায়। প্রতিটি ছাত্র, প্রতিটি প্রতিবাদকারী ফিলিস্তিনের মুক্তির পক্ষে সোচ্চার হওয়া, ইসরায়েলি নৃশংসতার সঙ্গে মার্কিন সংশ্লিষ্টতা রুখে দাঁড়ানো এবং ঔপনিবেশিকতা প্রতিরোধ করাকে উচিত কাজ মনে করছে।

সাম্রাজ্যবাদীদের পরবর্তী প্রজন্ম গড়ে তোলার শিক্ষায়তনগুলোর সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণির শিক্ষার্থীরাও যদি ফিলিস্তিনিদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য নিজেদেরকে বিপদের মুখে ফেলে তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায়, ফিলিস্তিন, মার্কিন তরুণসমাজ ও সামগ্রিকভাবে পশ্চিমা সমাজের ওপর ঔপনিবেশিক লৌহনিগড় ভেঙে পড়তে যাচ্ছে। ফিলিস্তিন অঞ্চল তথা গ্লোবাল সাউথ জুড়ে উপনিবেশবাদ থেকে যারা লাভবান তারা এতে ভীত। ছাত্ররা যদি এত প্রবলভাবে ফিলিস্তিনের জন্য লড়াই করতে প্রস্তুত থাকে, তাহলে তারা তাতেই থেমে থাকবে না— এটাই তাদের ভয়।

আমরা কিন্তু এমন কোনও বিভ্রমের মধ্যে নেই যে, ক্যাম্পাসের লড়াইতে আমরা যা সহ্য করছি তা কোনওভাবেই ইসরায়েলি দখলদারত্বের সাথে তুলনার যোগ্য। গাজায় আমাদের মতো তরুণরা কেবল পরিবার, বন্ধুবান্ধব, শিক্ষক এবং সহপাঠীদেরই হারায়নি, ইসরায়েলি বোমায় তারা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়টিকেই হারিয়েছে। যতক্ষণ না তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আবার চালু হয়, যতক্ষণ না তারা আবার শেখার স্বাধীনতা পায় ততক্ষণ আমরা তাদের দুর্ভোগের বিষয়ে বিশ্বকে সচেতন করার জন্য আমাদের ক্যাম্পাসগুলোকে তাদের কণ্ঠস্বরের প্ল্যাটফর্ম করে রাখব। আমাদের তাঁবুগুলো অদম্য ফিলিস্তিনের মতোই। আমরা এগুলো তুলে নিচ্ছি না। বিজয় না হওয়া পর্যন্ত সব প্রতিকূলতার মুখে অবিচল থাকব। ইসরায়েল থেকে বিনিয়োগ সম্পূর্ণ প্রত্যাহার না হওয়া এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে ফিলিস্তিনের মুক্তির আগ পর্যন্ত মাঠ ছাড়বো না আমরা।

এই অন্ধকার সময়ে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস জুড়ে যা ঘটছে তা আমার মনে অনুপ্রেরণা আর আশার সঞ্চার করে। আমি স্বপ্ন দেখি এরকম এক ফিলিস্তিনের যেখানে মাগরিবের নামাজ আদায়রত মুসলমানদের পাশাপাশি পাসওভারের আচার পালন করছে ইহুদিরা। সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষ একটেবিলে চায়ের আড্ডায় মেতেছে। সব জাতি ধর্মের মানুষ অংশ নিচ্ছে সম্মিলিত এক মুক্তি আন্দোলনে যার লক্ষ্য ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের আগের সেই প্যালেস্টাইনকে ফিরে পাওয়া।

আমি আমার জন্মভূমিকে নিয়ে এমন স্বপ্ন দেখি যাতে আমি আমার দাদা-দাদির লাগানো গাছের ছায়ায় বসে স্বাধীনতা দেখতে পারি, তা অনুভব করতে পারি। দিন দিন এই স্বপ্নটি পূরণের সময় কাছে আসছে বলেই মনে হচ্ছে আমার।

লেখক: প্রথম প্রজন্মের ফিলিস্তিনি আমেরিকান এবং যুক্তরাষ্ট্রের একজন আইনের শিক্ষার্থী। আল জাজিরা অনলাইন থেকে সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর আবু ইউসুফ

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত