এক সময় বাংলাদেশের সংসদীয় কমিটিগুলোতে মন্ত্রীরাই হতেন সভাপতি। যা মন্ত্রণালয়গুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় হিসাবে চিহ্নিত হয়। পরে আসে পরিবর্তন, মন্ত্রীদের বাদ দেওয়া হয় কমিটির নেতৃত্ব থেকে।
তাতে কমিটিগুলো কতটা কার্যকর হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে গেলেও এখন দেখা যাচ্ছে সাবেক মন্ত্রীদের বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে কমিটিগুলোর নেতৃত্বে। এতেও স্বার্থের দ্বন্দ্ব দেখা দিচ্ছে বলে মত আসছে।
সংসদ চলে যুক্তরাজ্যের সংসদীয় রীতি (ওয়েস্টমিনস্টার পদ্ধতি) অনুসরণ করে। সেখানে স্বার্থের দ্বন্দ্ব রয়েছে, এমন কারও দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা রয়েছে।
বাংলাদেশে সংসদ পরিচালিত হয় সংবিধান ও কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী। সেই কার্যপ্রণালী বিধিতে বলা আছে, এমন কেউ সংসদীয় কমিটির সদস্য হতে পারবেন না, যার ব্যক্তিগত, আর্থিক ও প্রত্যক্ষ স্বার্থ কমিটিতে বিবেচিত হতে পারে, এমন বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশে সরকারি দায়িত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বার্থের দ্বন্দ্বের বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত হতে দেখা যায়, সংসদীয় কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম ঘটে না।
একই সাবেক মন্ত্রীদের যার যার মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি পদে বসানোয় স্বার্থের দ্বন্দ্ব ঘটানোর ঝুঁকি তৈরি করে বলে মনে করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।
দ্বাদশ সংসদে গঠিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, অনেকগুলোতেই কমিটির প্রধান রয়েছেন তিনি, যিনি কয়েক মাস আগেই ওই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সামলে এসেছেন।
যেমন অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি করা হয়েছে সদ্য সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি হয়েছেন সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।
তেমনি গত সরকারের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদকে একই মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির, সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমকে এই মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির, সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাককে একই মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির প্রধান করা হয়েছে।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি সদ্য এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করে আসা গোলাম দস্তগীর গাজী।
গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হয়েছেন শরীফ আহমেদ। তিনিও কয়েক মাস আগেই এই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন।
এভাবে দেখা যায়, গঠিত ৩৯টি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির ১২টিতেই সাবেক মন্ত্রীরা সভাপতি।
মন্ত্রণালয়ের আগের যে কোনও ঘটনার মূল্যায়ন করতে যদি বর্তমান সংসদীয় কমিটি চায়, তাতে তখনকার মন্ত্রীরা কমিটির সভাপতির পদে থাকলে তা প্রভাবিত হওয়ার শঙ্কা থাকে।
নাগরিক সংগঠন সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সাধারণত স্ট্যান্ডিং কমিটিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পূর্ববর্তী ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে নানা ধরনের অভিযোগ আসে। এখন যদি আগের মেয়াদের মন্ত্রীরাই কমিটির সভাপতি হন, তাহলে তারা কীভাবে সেসব অভিযোগের ব্যবস্থাপনা করবে?”
ইফতেখারুজ্জামান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা দীর্ঘদিন যাবতই চেয়ে আসছি, যাতে প্রাক্তন মন্ত্রীদের সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটিতে সভাপতি বা সদস্য হিসেবেও না রাখা হয়। এটি আসলে স্বার্থের দ্বন্দ্বের অন্যতম প্রধান হিসেবে দাঁড়ায়।”
গত কয়েকটি সংসদের অভিজ্ঞতায় তিনি বলেন, সংসদীয় কমিটির গতিশীল কার্যক্রম তার চোখে ধরা পড়ছে না।
“দশম ও একাদশ সংসদের কমিটির কার্যক্রম পর্যালোচনায় দেখা গেছে, কোনও কমিটিই প্রতি মাসে একটি বৈঠক করার যে বাধ্যবাধকতা, সেটা পূরণ করতে পারেনি। বর্তমান দ্বাদশ সংসদ সরকারি দলের একচ্ছত্র ভুবন। কাজেই এই প্রেক্ষিতে আমরা সংসদীয় কমিটির কাছ থেকে ইতিবাচক কোনও ভূমিকার প্রত্যাশা করব, এই চিন্তাটা অমূলক বলে মনে করি।”
তারপরও কিছু সুযোগ ছিল মন্তব্য করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “কিছু রাজনৈতিক প্রজ্ঞা যদি দেখাতে পারত, বিশেষ করে কমিটিগুলো স্বার্থের দ্বন্দ্বমুক্ত করার জন্য, প্রাক্তন মন্ত্রীদের কমিটিতে কোনও পদেই না রাখা উচিৎ ছিল।”
আবার স্বার্থের দ্বন্দ্বের একটি নজির হিসেবে সাজ্জাদুল হাসানের নাম আসছে। তাকে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি করা হয়েছে।
জ্যেষ্ঠ সচিব হিসেবে তিন বছর আগেই ২০২০ সালের ১০ জানুয়ারি অবসরে যান তিনি। অবসর নেওয়ার ১৭ দিনের মাথায় তাকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেয় সরকার।
বিসিএস সপ্তম ব্যাচের কর্মকর্তা সাজ্জাদুল হাসান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব হিসেবে অবসর নেওয়ার তিন বছর গড়াতে না গড়াতেই উপনির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এবারও পুনরায় নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।
আবার নিজেদের যে ব্যবসা রয়েছে, এমন অনেকেও সংসদীয় কমিটিতে স্থান পেয়েছেন। তাও স্বার্থের দ্বন্দ্ব ঘটানোর মতো বলে মনে করা হয়।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “যাদের যেখাতে ব্যবসা আছে, তাদের সেই খাত সংশ্লিষ্ট কমিটিতে না রাখা যেত। এবারের কিছু সংসদীয় কমিটিতে স্বার্থের দ্বন্দ্বের মাপকাঠিতে দুই ক্ষেত্রে ব্যাপক মাত্রায় হয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, সংসদ সদস্যের আচরণবিধি একটি আইন দ্বারা নির্ধারিত হওয়া উচিৎ, যেখানে স্বার্থের দ্বন্দ্বের বিষয়গুলো থাকবে।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সংসদ সদস্যদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটিতে থাকা গুরুতর বিষয়। আমাদের যে দুর্নীতি-দূর্বত্তায়ন-লুটপাট এবং স্বার্থপ্রণোদিত সিদ্ধান্ত, সাধারণ মানুষের পরিবর্তে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখা হচ্ছে। আমরা আশা করব যে সরকার এটি পুনবিবের্চনা করবে।”
সংসদ সদস্যের আচরণবিধির জন্য একটি আইনের খসড়া দশম সংসদে সাবের হোসেন চৌধুরীর উত্থাপনও করেছিলেন।
সেই প্রসঙ্গ তুলে বদিউল আলম বলেন, বেসরকারি বিল হিসেবে সেটি সংসদীয় কমিটিতেও গিয়েছিল, পরে তার আর কোনও অগ্রগতি হয়নি।
“আচরণবিধি আইনের মাধ্যমে হলে স্বার্থের দ্বন্দ্ব এবং সম্পদের হিসাব দেওয়ার বিষয়গুলো যেমন থাকবে, এগুলো নিরসনের লক্ষ্যে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করারও সুযোগও থাকবে।”
কমিটি গঠনের বিষয়ে জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সদ্য সাবেক মন্ত্রীদের মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সংসদীয় কমিটিকে গতিশীল করতে পারবেন বলেই তাদের কমিটিতে রাখা হয়েছে।”
ব্যবসায়ীদের বিষয়ে তিনি বলেন, “যে কেউ ব্যবসা করতে পারেন। দেখতে হবে, তারা সরকারের সঙ্গে ব্যবসা করছেন কি না।”