দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলে সংসদে সরকারি দলের তোপের মুখে পড়লেন বিরোধীদলীয় নেতা, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের।
মঙ্গলবার রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনায় এক মাস আগের নির্বাচনের নানা দিক তুলে ধরেন তিনি।
তার দাবি, এই নির্বাচন কিছু আসনে ঠিকভাবে হলেও অনেক স্থানে ফল তৈরি করাই ছিল। ভোটের হারও যা দেখানো হয়েছে, তা ঠিক নয় বলে অঙ্ক করে দেখান তিনি।
জি এম কাদেরের বক্তব্যের সময় সরকারি দলের সদস্যরা বারবারই হৈ চৈ করে প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন।
সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরে তার বক্তব্যে বিরোধীদলীয় নেতার বিভিন্ন অভিযোগের জবাবও দেন।
গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। ১১টি আসন পেয়ে সংসদে প্রধান বিরোধী দলের আসন নিয়েছে জাতীয় পার্টি।
জি এম কাদের বলেন, “আমার কাছে মনে হয়েছে, তিন ধরনের ইলেকশন হয়েছে। কোনও কোনও এলাকায় সবগুলো সুষ্ঠু ইলেকশন হয়েছে। আরেকটা হয়েছে ফ্রি স্টাইল। সেখানে মাসল পাওয়ার এবং মানি অবাধে ব্যবহার করা হয়েছে। সেটার মাধ্যমে ভোটকেন্দ্র দখল করা হয়েছে।
“আরেকটা ছিল যেটা নিয়ে ব্যাপকভাবে অভিযোগ আমাদের অনেক নেতা, কর্মী, প্রার্থীদের, ইলেকশন যেভাবেই হোক ফলাফল একটা পূর্বর্নির্ধারিত ছিল এবং শিট বানিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
সরকারি দলের সদস্যরা সমস্বরে এই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাতে থাকলে জিএম কাদের হেসে বলেন, “এটা নাও হতে পারে।”
নির্বাচন অংশগ্রহণ মূলক না হওয়ার বিষয়টি তুলে তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ সব বড় দল নির্বাচনে অংশ নিলে এই মুহূর্তে ৯০-৯৫ শতাংশ ভোট পড়বে। আওয়ামী লীগ বিএনপির একটি দল না এলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করা কঠিন। এতে মানুষ ভোটি দিতে আসে না।”
নির্বাচনে ৪২ শতাংশ ভোট পড়া সম্ভব কি না, তা অঙ্কের হিসাবে দেখিয়ে জি এম কাদের বলেন, “যে প্রেক্ষাপটে ছিল, তাতে ৪২ শতাংশ ভোট দিতে গেলে সব ভোটকেন্দ্রের সামনে ৮ ঘণ্টা লাইন থাকার কথা। কিন্তু তা ছিল না।”
এসময় সংসদ সদস্যরা হৈ চৈ শুরু করলে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, “অনেকে বলেছেন, ঘণ্টায় তিন চারটার বেশি ভোট হয়নি। আমি আমার কথা বলছি না। ধারণার কথা বলছি।”
তখনও হৈ চৈ চলতে থাকলে বিরোধীদলীয় প্রধান হুইপকে বলতে শোনা যায়, “শোনেন না। ধৈর্য ধরেন।”
এরপর জি এম কাদের বলেন, “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংবিধান মোতাবেক ও প্রচলিত আইন অনুযায়ী বৈধ হিসাবে গণ্য করা যায়। আইন অনুযায়ী তা বৈধ হয়েছে।
“কিন্তু সিংহভাগ মানুষ মনে করে, ভালো নির্বাচন হয়নি, সঠিকভাবে জনমতের প্রতিফলন হয়েছে বলে মনে করে না। আমি মনে করি, আইন-কানুন ব্যাপকভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। যাদের দেখার কথা, তারা এড়িয়ে গেছেন, অনেক সময় লঙ্ঘনে সহায়তা করেছেন।”
সরকারি দলের সদস্যরা তখনও চেঁচাতে থাকলে স্পিকার বলেন, “মাননীয় সদস্যবৃন্দ, উনাকে বলতে দিন।”
জি এম কাদের তারপর বলেন, “রাষ্ট্রপতি বলেছেন, ‘নির্বাচনে জয় হয়েছে জনগণের, গণতন্ত্রের’। আমার জানামতে, দেশের বেশিরভাগ মানুষ একথার সাথে একমত নয়। এই নির্বাচনে শুধু জয়ী হয়েছে সরকার ও সরকারি দল আওয়ামী লীগ।
“এই নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ছাড়া জনগণের সাথে সম্পৃক্ততা আছে, এমন অন্য সব দল নিজস্ব নীতি আদর্শ নিয়ে টিকে থাকতে পারবে কি না, সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। এখন স্বাভাবিক রাজনীতি একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছে।”
“রাষ্ট্রপতি বলেছেন, ‘নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলো স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে পেরেছে’। এই বক্তব্যের সঙ্গে তারা একমত নয়। মামলা দিয়ে জেলে বন্দি করা হয়েছে, হুলিয়া দিয়ে ঘরছাড়া করা হয়েছে, রাস্তায় দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি। ধানক্ষেতে, বনে-জঙ্গলে তাদের পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে,” বলেন তিনি।
জি এম কাদের আরও বলেন, “সংবিধান ও আইন যে কোনও ধরনের নির্বাচনকে বৈধতা দিতে পারে। কিন্তু সবক্ষেত্রে তা সঠিক বা ভালো নির্বাচন বলে গ্রহণযোগ্য হবে, সেটার নিশ্চয়তা সবসময় দিতে পারে না।”
রাষ্ট্রপতির বক্তব্যে দুর্নীতির প্রসঙ্গ না আসার বিষয়টি তুলে বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, “দুর্নীতিতে দেশ সয়লাব হয়ে গেছে। দুর্নীতি ছাড়া কোনও কাজ হয় না।”
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতি সূচকের কথাও বলেন তিনি।
খেলাপি ঋণ নিয়ে সরকার ও আইএমএফের হিসাবের গরমিলের কথাও তিনি বলেন।
এক সময়ের মন্ত্রী জি এম কাদের দ্রব্যমূল্য নিয়ে বলেন, “নির্দিষ্ট কিছুসংখ্যক ব্যক্তি আমদানি করছে। এতে সিন্ডিকেট হওয়াটা স্বাভাবিক।
“এসব ব্যবসায়ীরা সরকারের নীতিনির্ধারণে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবো জড়িত। সরকারের কাছে বিকল্প না থাকার কারণে সরকার তাদের হাতে জিম্মি।”