সতের কোটি মানুষের দেশে সরকারি চাকরির বাইরে দেশের সবাইকে পেনশনের আওতায় আনতে সরকাের যে বিশাল উদ্যোগ নিয়েছিল, তাতে এখনও সাড়া মেলেনি।
গত বছর চালু হওয়ার পর সাত মাসে ২৭ হাজার ২৬০ জন চারটি স্কিমে যুক্ত হয়েছেন, যা লক্ষ্যমাত্রার ১ শতাংশের চেয়ে কম।
লক্ষ্য থেকে বহু দূরে থাকার মধ্যে এখন আগের চারটির সঙ্গে নতুন একটি স্কিম চালু করা হয়েছে। এতে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সংস্থাগুলোর নবীন কর্মচারীরা।
দেশে সরকারি কর্মচারীরা অবসরের পর পেনশন সুবিধা পেলেও বেসরকারি চাকরিজীবীসহ আর কারও সেই সুযোগ ছিল না।
সেই অবস্থা পরিবর্তনে ‘সুখে ভরবে আগামী দিন, পেনশন এখন সর্বজনীন’ এ স্লোগান নিয়ে দেশের ১০ কোটি মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু হয়েছিল ২০২৩ সালের অগাস্টে।
প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা নামে চার স্কিমে প্রথম মাসে প্রায় ১৩ হাজার জন অন্তর্ভুক্ত হলেও তারপর থেকে মানুষের উৎসাহে ভাটা পড়তে থাকে। দ্বিতীয় মাসে যোগ দেন মাত্র ১ হাজার ৬৬৯ জন। তৃতীয় মাসে সংখ্যাটি আরও কমে হয় ১ হাজার ১৩৪ জন।
এরপর থেকে প্রতি মাসেই কমছে। সব মিলিয়ে সাত মাসে এই চারটি স্কিমে ২৭ হাজার ২৬০ জন অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন বলে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ থেকে তথ্য পাওয়া যায়।
মোট জমা পড়েছে ৩৫ কোটি টাকা। এই অর্থের মধ্যে ৩১ কোটি টাকা সরকারি ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করেছে পেনশন কর্তৃপক্ষ৷
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের ১৭ আগস্ট উদ্বোধনের দিন থেকেই অনলাইনে যে কেউ সর্বজনীন পেনশন স্কিমে যুক্ত হতে পারছেন। প্রথম দিন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত ৮ হাজার মানুষ অনলাইনে নিবন্ধন করলেও পুরো প্রক্রিয়া শেষ করে চাঁদা দিয়েছিলেন ১ হাজার ৭০০ জন।
উদ্বোধনের পর ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রথম এক মাসে চাঁদা পরিশোধ করেছিলেন ১২ হাজার ৮৮৯ জন। পরের এক মাসে নতুন করে ১ হাজার ৮৩১ জন যুক্ত হওয়ায় মোট চাঁদাদাতার সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১৪ হাজার ৭২০।
তার পরের মাস, অর্থাৎ ১৮ অক্টোবর থেকে ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত পেনশন স্কিমে নতুন করে যুক্ত হয়েছিলেন আরও ১ হাজার ১৩৪ জন। ওই তিন মাসে মোট চাঁদাদাতা হন ১৫ হাজার ৮৫৪ জন।
হিসাবে করে দেখা যাচ্ছে, পরের চার মাসে অর্থাৎ ১৯ নভেম্বর থেকে ২১ মার্চ সময়ে এই চার স্কিমে যুক্ত হয়েছেন ১১ হাজার ৪০৬ জন।
এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি নিবন্ধন হয়েছে বেসরকারি কর্মচারীদের ‘প্রগতি’ স্কিমে। এতে ৯ হাজার জন টাকা জমা দিয়েছেন। স্বকর্ম ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিযুক্তদের ‘সুরক্ষা’ স্কিমে প্রায় সাড়ে আট হাজার জন টাকা জমা দিয়েছেন।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের ‘প্রবাস’এবং দেশের নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর ‘সমতা’ স্কিমে যুক্ত হয়েছেন ১০ হাজারেরও কম।
কেন সাড়া নেই
সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থাহীনতা এবং দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পেনশন স্কিমের লক্ষ্য বাস্তবায়নে বড় বাধা হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
পেনশন স্কিমের ব্যবস্থাপনা এবং বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়েও সংশয় আছে সাধারণ মানুষের৷
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “পেনশন স্কিমের মতো এত বড় কর্মযজ্ঞ চালু করার আগে অন্তত পাঁচ থেকে সাত বছর প্রস্তুতি নেওয়ার প্রয়োজন ছিল।
“কারা এ স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন, তার ওপর কোনো জরিপও হয়নি। এমনকি উদ্বোধনের পরও খুব একটা প্রচার নেই।”
এনিয়ে বিরূপ প্রচারের বিষয়টি তুলে তিনি বলেন, “এ কর্মসূচি নিয়ে মানুষের মনে নানা প্রশ্ন রয়েছে। এসব প্রশ্নের উত্তর সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথভাবে দেওয়া হয় না। সার্বিকভাবে পরিষ্কার ধারণা জনগণকে দেওয়া না হলে এ উদ্যোগ সফলতা পাবে না।”
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল সবার জন্য পেনশন। তবে গত জাতীয় নির্বাচনের আগে এই পেনশন স্কিম অন্যতম আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
পেনশন কর্মসূচি উদ্বোধনের পরদিন ১৮ আগস্ট বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, “আওয়ামী লীগ লুট করে শেষ করে দিয়েছে বাংলাদেশকে, ফোকলা বানিয়ে দিয়েছে,… আবার নতুন আরেকখান কায়দা বাইর করছে.. পেনশন দেবে, পেনশন স্কিম।
“মানুষের টাকা চুরি করার আরেকটা ফন্দি বাইর করছে। ওই টাকা চুরি করে ওরা নির্বাচন করতে চায়। মানুষ এবার তাদেরকে দেবে না।”
জনগণের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার উপর জোর দিয়ে আহসান মনসুর বলেন, “তারা জানতে চায় এই ফান্ডটি কারা ম্যানেজে করবে? এখন পর্যন্ত আমরা যতদূর জানি একটি পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়েছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ে যার অবস্থান এবং বুরোক্রেসি দিয়েই একে চালানো হবে৷ তখন পরের প্রশ্নটি আসে যদি আমার টাকা না দিতে পারে, এই টাকাটা যে আমি দিচ্ছি, এটা কোথায় থাকবে? সেটার জবাব দেওয়া তো কঠিন৷
“প্রশ্ন আসে এই প্রতিষ্ঠান যদি মিসম্যানেজড হয় এবং আমার টাকাটা সরকারি বাজেটে চলে যায় এবং সেখানে সরকার খরচ করে ফেলে এবং আমি যখন টাকাটা পাওয়ার বয়সে যাব, তখন যদি সরকারের টাকা না থাকে, তাহলে কী হবে? আমি তখন কোথায় যাব? ওই প্রশ্নের জবাব তো কঠিন?”
আরেকটি বিষয় তুলে ধরে তিনি বলেন, “সমতা স্কিমটিতে (নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য) সাড়া পাওয়ার সম্ভাবনা শুরু থেকেই ছিল না৷ যদিও সেখানে চাঁদাদাতার ৫০০ টাকার সাথে সমপরিমাণ টাকা সরকার দেবে বলে জানিয়েছে৷ কিন্তু বর্তমান বাস্তবাতায় প্রতি মাসে সেই অর্থটুকু দেওয়াও দরিদ্রদের পক্ষে সম্ভব নয়।”
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলছে, নতুন এই ধারণা যাতে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়, সেজন্য তারা কাজ করছে৷ তহবিল ব্যবস্থাপনা এবং নিরাপদ বিনিয়োগের জন্য একটি বিধিমালার খসড়া তারা তৈরি করেছেন, যা দ্রুত পাস ও কার্যকর হবে৷ বিনিয়োগ কমিটির মাধ্যমে এই তহবিলের বিনিয়োগ হবে, তাই সরকার সরাসরি এই অর্থ ব্যবহার করতে পারবে না৷
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কবিরুল ইজদানী খান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমাদের প্রাথমিক পরিকল্পনা, দেশের প্রায় ১০ কোটি মানুষকে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের আওতায় আনা৷ তবে এ লক্ষ্য অর্জন সময় সাপেক্ষ৷ একটি নতুন ধারণা যাতে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়, সে বিষয়ে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ কাজ করে যাচ্ছে।”
তিনি আশ্বস্ত করছেন, এই কর্মসূচির গ্যারান্টার যেহেতু রাষ্ট্র, তাই জনগণের অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে সংশয় বা ঝুঁকির কোনও কারণ নেই৷ জনগণকে তারা সেটাই বোঝানোর চেষ্টা করছেন৷
সরকার পেনশন স্কিমের অর্থ ব্যবহার করতে পারবে কি না- এ বিষয়ে জানতে চাইলে কবিরুল বলেন, “সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইনের ১৬ ধারায় সর্বজনীন পেনশন তহবিলের উল্লেখ রয়েছে৷ আইনের ১৮ ধারায় বলা হয়েছে যে, এই তহবিল ব্যবস্থাপনা এবং এর সুষ্ঠু ও নিরাপদ বিনিয়োগ এর জন্য একটি বিধিমালা থাকবে৷
“আমরা এরই মধ্যে এ বিধিমালার খসড়া প্রস্তুত করেছি৷ আশা করছি, শিগগিরই এই বিধিমালা পাস ও কার্যকর হবে৷ বিনিয়োগ কমিটির মাধ্যমে এই তহবিলের বিনিয়োগ হবে, বিধায় এই অর্থ সরকার সরাসরি ব্যবহার করতে পারবে না।”
তিনি জানান, এখন পর্যন্ত জমাকৃত টাকা তারা ‘সবচেয়ে নিরাপদ ও লাভজনক দীর্ঘমেয়াদী সরকারি ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করেছেন৷ মোট ৩১ কোটি টাকা ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করা হয়েছে৷