জনপ্রতিনিধি হতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের ভোটের প্রতি যতক্ষণ পর্যন্ত মুখাপেক্ষী করা না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত জনগণ গণতন্ত্রের সুফল পাবে না বলে সতর্ক করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
তিনি বলেছেন, সতর্ক হলে অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের প্রত্যাশা পূরণে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এটিই আজ জনগণের চাওয়া।
বৃহস্পতিবার ছিল ৭ নভেম্বর। দিনটি বিএনপি ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসেবে পালন করে। দিবসটি উপলক্ষে আলোচনা সভা, শোভাযাত্রাসহ ১০ দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি।
দিবসটি উপলক্ষে আয়োজিত বিএনপির শোভাযাত্রা শুক্রবার বিকাল ৩টা ৩৫ মিনিটে নয়াপল্টনে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে শুরু হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে মানিক মিয়া এভিনিউতে শেষ হয়।
নেতা-কর্মীর অংশগ্রহণে ফকিরেরপুল থেকে কাকরাইল পর্যন্ত জনসমুদ্রে রূপ নেয় সমাবেশ। লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি অংশ নিয়ে কর্মসূচির উদ্বোধনী বক্তব্য দেন তারেক রহমান।
সংক্ষপ্ত বক্তব্যে তারেক রহমান বলেন, “স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদমুক্ত পরিবেশেও স্বল্প আয়ের মানুষদের বাজার সিন্ডিকেটের অভিশাপ থেকে মুক্ত করা অসম্ভব হয়ে পড়বে, যদি না মানুষের সরাসরি ভোটের অধিকার আমরা নিশ্চিত করতে পারি।
“রাজপথে লাখো জনতার এই মিছিল দেশের স্বার্থরক্ষার মিছিল। নিজের অধিকার রক্ষার মিছিল। নিজের ভোট প্রয়োগের অধিকার রক্ষার মিছিল আজ।”
তিনি বলেন, “আগেও বলেছি বাংলাদেশের পক্ষের শক্তি ঐক্যবদ্ধ থাকলে আর কেউ দেশের স্বাধীনতাকে বিপন্ন করতে পারবে না। রাজধানী ঢাকার এই রাজপথে লাখো জনতার এই মিছিল, বাংলাদেশের পক্ষের শক্তিকে ৭ই নভেম্বরের অন্তর্নিহিত শিক্ষায় দীক্ষিত করার মিছিল।
“লাখো জনতার আজকের এই মিছিল ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে আহত অসংখ্য ছাত্র-জনতা এবং হাজারো শহীদের স্বপ্নের একটি বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক মানবিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ের মিছিল।”
‘আমি নিজেও সতর্ক’
তারেক রহমান বলেন, “কখনও যেন বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ ফিরে আসতে না পারে, সেজন্য প্রতিটি নাগরিকের ভোটের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন অত্যন্ত জরুরি। জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার জন্য স্থানীয় সরকার থেকে কেন্দ্রীয় সরকার পর্যন্ত জনপ্রতিনিধি হতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের জনগণের ভোটের প্রতি যতক্ষণ পর্যন্ত মুখাপেক্ষী করা না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত জনগণ গণতন্ত্রের সুফল পাবে না।
“এমনকি স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদমুক্ত পরিবেশেও স্বল্প আয়ের মানুষকে বাজার সিন্ডিকেটের অভিশাপ থেকে মুক্ত করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। যদি না মানুষের সরাসরি ভোটের অধিকার আমরা নিশ্চিত করতে পারি।”
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, “আমি একটি বিষয় স্মরণ করিয়ে সতর্ক থাকতে অনুরোধ জানাতে চাই, আমি নিজেও সতর্ক থাকতে চাই—সেটি হলো গণতন্ত্রবিরোধী অপশক্তির ষড়যন্ত্র এখনেও কিন্তু থেমে নেই। অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করে দিতে পলাতক স্বৈরাচারের দোসররা দেশে-বিদেশে, প্রশাসনে এখনও সক্রিয়।”
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না বলে উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, “তবে নিজেদেরকে সতর্ক করতে চাইলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনগণের প্রত্যাশা পূরণে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এটিই আজ জনগণের চাওয়া।”
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পান জিয়াউর রহমান। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান হয়। গৃহবন্দি করা হয় জিয়াউর রহমানকে।
এরপর ৭ নভেম্বর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সঙ্গে যুক্ত মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে পাল্টা অভ্যুত্থানে মুক্ত হন জিয়া। ক্ষমতার ময়দানে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন তিনি। পরে তিনি দেশের প্রথম সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নেন।
বিএনপি এই দিনকে ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’হিসেবে পালন করে থাকে। আর জাসদ ‘সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান দিবস’হিসেবে পালন করে।
গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ এই দিনকে ‘মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যা দিবস’হিসেবে পালন করত।
শুক্রবার বিএনপির শোভাযাত্রায় রাজধানীর পাশাপাশি আশপাশের মানিকগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ জেলার নেতাকর্মীরা অংশ নিয়েছেন। অংশ নিতে আসা বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের হাতে শোভা পায় দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ছবি, দলীয় ও জাতীয় পতাকা।
শোভাযাত্রার সৌন্দর্য বাড়ায় ঘোড়ার গাড়ি ও পিকআপ ভ্যান। পিক আপ ভ্যানে করে বড় বড় সাউন্ডবক্সে দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে নিয়ে বাধা গান বাজতে শোনা যায়। লাল-নীলসহ নানা রকমের ক্যাপ শোভা পায় নেতাকর্মীদের মাথায়।
এছাড়া জরুরি চিকিৎসার জন্য অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত রাখতে দেখা যায়।
শোভাযাত্রার কারণে নয়াপল্টন, কাকরাইল, ফকিরাপুল ও পল্টন থেকে ধরে শাহবাগ হয়ে ফার্মগেট ও সংসদ ভবন এলাকায় যানজট দেখা যায়।
শোভাযাত্রায় উপস্থিত ছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য এ জেড এম জাহিদ হোসেন, ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী, আহমেদ আজম খান, ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, আব্দুস সালাম আজাদ, স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক মীর সরফত আলী সপু, প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল ইসলাম, স্বেচ্ছাসেবক দল সভাপতি এস এম জিলানী ও কৃষকদল সভাপতি হাসান জাফির তুহিন।
বেলা ৩টায় কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত শোভাযাত্রার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করে বিএনপি।
ভার্চুয়ালি অংশ নিয়ে শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। শোভাযাত্রার আগে বিএনপির আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। ভার্চুয়ালি সেটি উদ্বোধন করেন তারেক রহমান।
এ সময় বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি কামনা করে দোয়া করা হয়। এছাড়া বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান, তার ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর নাজাত কামনা করে দোয়া করা হয়।
এখানে গণতন্ত্র ছাড়া ফ্যাসিবাদ সুযোগ পাবে না : ফখরুল
কর্মসূচিতে সভাপতির বক্তব্যে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিগত ১৫ বছরে পরিকল্পিতভাবে আওয়ামী লীগ দেশের সব রাজনৈতিক কাঠামো ধ্বংস করেছে বলে মন্তব্য করেন।
এসময় তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ দেশকে করেছিল একটি মাফিয়া রাষ্ট্র। তারা তাদের সহযোগীদের সহযোগিতায় দেশের অর্থনীতি ব্যবস্থা ফোকলা করে দিয়েছে। ওরা আমাদের অনেক নেতাকর্মীকে হত্যা, গুম করেছে। ৬০ লাখ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছিল পতিত আওয়ামী লীগ।
“আজকের র্যালি প্রমাণ করবে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর দেশপ্রেমিক সৈনিক ও জনতার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সেদিন পরাজিত করেছিল ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদকে। সেদিন নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। ৭ নভেম্বর ছিল গণতন্ত্র মুক্তির দিন, ৭ নভেম্বর ছিল স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার দিন, আধিপত্যবাদকে পরাজিত করার দিন। এদিন নতুন বাংলাদেশের ইতিহাস, স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠাতার দিন।”
তিনি বলেন, “২০২৪ সালে জনগণ আরেকটা অভ্যুত্থান দেখেছে। এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা পালিয়েছেন। কিন্ত তার দোসররা এখনও রয়েছে।
“যারা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ধ্বংস করতে আসবে, অত্যন্ত সজাগ ও সচেতন থেকে তাদের যেকোনো ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে। এখানে গণতন্ত্র ছাড়া ফ্যাসিবাদ সুযোগ পাবে না। আমরা সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করব।”