Beta
সোমবার, ১৭ মার্চ, ২০২৫
Beta
সোমবার, ১৭ মার্চ, ২০২৫

সংঘাত-সহিংসতায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষ

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি
[publishpress_authors_box]

পেশায় তিনি চিকিৎসক। কাজ করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ)। পরিবার ও বন্ধু মহলে শক্ত মনের মানুষ হিসেবে পরিচিত এই চিকিৎসক জানালেন, গত ১৭ জুলাইয়ের পর থেকে তিনি এক রকমের ট্রমার মধ্যে রয়েছেন, ঘুমাতে পারছেন না ঠিকমতো।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “আমার কখনোই ঘুমের ঝামেলা ছিল না। কিন্তু গত ১৭ জুলাইয়ের পর থেকে ঘুমাতে পারছি না। মুভি দেখছি, সন্তানের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছি, রান্না করছি, বাইরে ঘুরতে যাচ্ছি, কিন্তু  কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।”

ঢাকা মেডিকেলের আইসিইউতে অন্য চিকিৎসকদের তুলনায় তার কাজ করার অভিজ্ঞতা কিছুটা কম জানিয়ে তিনি বলেন, “সাধারণত যারা মানসিকভাবে স্ট্রং হয়, তারাই আইসিইউতে কাজ করেন। অথবা এভাবেও বলা যায়, তারা কাজ করতে করতে স্ট্রং হয়ে যায়। কিন্তু গত ১৭ জুলাইয়ের পর থেকে আমরা সবাই ট্রমাটাইজড।

“আইসিইউতে কাজ করা চিকিৎসকদের লেখাপড়া করতে হয়, কিন্তু কেউ সেটা করতে পারছি না। এই ট্রমা থেকে আমরা কবে বের হতে পারব, বা আদৌ পারব কিনা সেটাও জানি না।”

ফাইল ছবি

তিনি বলেন, “চোখের সামনে এত রক্ত, এত বাঁচার আকুলতা, এত মৃত্যু, স্বজনদের আহাজারি, টেলিভিশনে, ফেইসবুকে এত গ্রেপ্তার, শিক্ষার্থীদের এভাবে পেটানোর দৃশ্য– কবে আমরা আবার স্বাভাবিক হব, জানি না। এত ট্রমাটাইজড মনে হয় না কোনও চিকিৎসক আর হয়েছে।”

গণমাধ্যমকর্মী খায়রুল বাসার সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিলেন ২০২০ সালে। এরপর সাড়ে ৪ মাস হাসপাতালের শয্যাতেই কেটেছে তার, চিকিৎসা নিতে হয়েছিল সব মিলিয়ে ছয় থেকে সাত মাস। এখন তিনি সুস্থ। কিন্তু সেই ট্রমা চার বছরেও কাটেনি। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে আহতদের নিয়ে প্রতিবেদন করার কাজে সম্প্রতি গিয়েছিলেন ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে গিয়ে ফের ট্রমায় আক্রান্ত হওয়ায় কাজ শেষ না করেই ফিরতে হয় তাকে।

এই সাংবাদিক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কারও পা নেই, কারও হাত নেই। দেখে নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না, তাই ফিরে আসি।”

কেবল চিকিৎসক বা সাংবাদিকই নন, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে সংঘাত-সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনাগুলো প্রায় সব বয়সী মানুষকেই মানসিকভাবে বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত করে তুলেছে।

ট্রমায় আক্রান্ত সন্তান নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা সকাল সন্ধ্যাকে জানিয়েছেন আরেক গণমাধ্যমকর্মী লাবণ্য লিপি। তিনি জানান, প্রথমে করোনায় এবং এখন এই আন্দোলনে ঘরে থাকার ধাক্কা কীভাবে কাটবে তা নিয়ে চিন্তিত।

লিপি জানান, তার ছেলে ১৬ বছরের আরিয়ান মুনতাসির ঢাকার বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। যে ছেলের কথার ‘অত্যাচারে’ তিনি প্রায়ই বিরক্ত হতেন, সেই ছেলেকে কথা বলাতে এখন পীড়াপীড়ি করতে হচ্ছে।

“ছেলেটা সারাদিন ঘরবন্দি। লেখাপড়া নেই, স্কুল নেই, বন্ধু নেই– কিছুই তো পাচ্ছে না এখন। কল্যাণপুর মাঠে খেলতে যেত, সেটাও বন্ধ করেছি। আমি তো কর্মজীবী মা, আমাকে প্রতিদিন বের হতে হচ্ছে। ছেলেটা বাসায় সারাদিন একা, কারও সঙ্গে কথা বলার সুযোগ নেই, ওর অবস্থাটা একটু চিন্তা করে দেখেন।”

তিনি বলেন, “একটা ছেলের ভিডিও যে ভাইরাল হলো– বাসায় ছোট বোন রয়েছে, সেটা ওর বন্ধু। বন্ধুর এ অবস্থা দেখে তার অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। সেইসঙ্গে তো ফেইসবুক-টেলিভিশনে দেখছে কীভাবে শিক্ষার্থীদের মারা হচ্ছে, রক্তমাখা ডেডবডি, শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে– এসব দেখে বিপর্যস্ত অবস্থা, এটা আসলে বলে বোঝানো যাবে না।”

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কয়েকজন।

লাবণ্য লিপি বলেন, “তার বন্ধুদের গ্রুপে আন্দোলন নিয়ে কথা হচ্ছে, কেউ কেউ আন্দোলনে যাচ্ছে, গিয়েছে। এসব দেখে সেও যেতে চাইছে। কিন্তু আমি মা হিসেবে অত সাহসের অধিকারী নই যে, তাকে যেতে দেব।

“বন্ধুরা আন্দোলনে যাচ্ছে, আমি যদি না যাই, না যেতে পারি… আমার বন্ধুরা মারা যাচ্ছে, মার খাচ্ছে, আমি কি যাব না– সে এসব প্রশ্ন করে আমাকে অপরাধী করে দিচ্ছে, কিন্তু আমি কী করতে পারি? বাচ্চাদের জীবনে এই ছন্দপতনের সমাধান কী হবে, কীভাবে হবে সেটা জানি না।”

তিনি বলেন, “করোনাকালে এক ধাক্কা, এখন আবার এক ধাক্কা– এত বড় ট্রমা কাটিয়ে জীবনে ওরা কবে ফিরতে পারবে, তা নিয়ে আমি খুব চিন্তিত।”

এই ট্রমা কীভাবে কাটিয়ে ওঠা যায় জানতে চাইলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ সকাল সন্ধ্যাকে জানান, ২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর এবারের মতো এত ট্রমাটাইজড মানুষ আর দেখেননি।

তিনি বলেন, “আর কখনও এমন ম্যাসিভ ট্রমাটাইজড মানুষ দেখিনি। দেশে এখন অনেক বড় সংখ্যক মানুষ ইফেক্টেড। আমরা হয়ত কারওটা বুঝতে পারছি, কারওটা পারছি না।”

অনেকেই বর্তমান সময়ের ঘটনায় নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরে যাচ্ছেন, যার কারণে সমস্যাটা অনেক বেশি হচ্ছে বলে মনে করেন এই চিকিৎসক।

তিনি জানালেন, ডিজাস্টার সারভাইবাল লেভেলের পাঁচটি ধাপ রয়েছে। এই তালিকার প্রথমে রয়েছেন নিহতদের স্বজন ও আহতরা। দ্বিতীয় ধাপে প্রত্যক্ষদর্শী, অর্থাৎ যারা চোখের সামনে মৃত্যু দেখে, ঘটনাটা ঘটতে দেখেন (আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গণমাধ্যমকর্মীরাই বেশি), তৃতীয় ধাপে সারভাইবার বা এ ঘটনাতে যারা টিকে থাকেন, চতুর্থ ধাপে এসব ঘটনায় যারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন অর্থাৎ প্রশাসনিক পর্যায়ের কর্মকর্তারা।

উদাহরণ দিয়ে অধ্যাপক হেলাল বলেন, চতুর্থ ধাপের এই সারভাইবালদের মধ্যে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, যারা শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ আক্রমণ করবে, কি করবে না- সেই সিদ্ধান্ত নেন। অথবা বলা যায় একজন চিকিৎসকের কথা, যার সিদ্ধান্তে হয়ত একজন জটিল রোগীর অস্ত্রোপচার হবে। অথবা একজন নিউজ এডিটর, যিনি মাঠে না গিয়েও নিউজ রুমে বসে প্রতিবেদন দেখতে গিয়ে দোদুল্যমানতা ভুগছেন, মৃত্যুর ঘটনা তাকে প্রভাবিত করছে।

ডিজাস্টার সারভাইবাল লেভেলের পঞ্চম ধাপে সাধারণ মানুষ রয়েছেন জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, যারা প্রত্যক্ষভাবে ঘটনার সঙ্গে জড়িত না হলেও টেলিভিশন, পত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এগুলো দেখছেন। তারাও এতে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন।

“এসব মানুষের জন্য ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ করার কাজ করতে হবে এবং তাদের জন্য ‘ভেন্টিলেশন’ এর ব্যবস্থা করা খুব জরুরি। প্রাত্যহিক কাজের বাইরে নতুন নতুন কাজ করতে হবে, কথা বলতে হবে এবং ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ঘুমের সময় নির্ধারণ করা।”

ট্রমা কাটানোর উপায় কী

সাংবাদিকদের ট্রমা কাটানোর জন্য কিছু কৌশল বাতলে দিয়েছে সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্ক (জিআইজেএন)।

‘রক্ত, মৃত্যু, আঘাত, মর্গ, গ্রেপ্তার, অভিযান… আপনি কি ট্রমায় আক্রান্ত’ শীর্ষক লেখায় সাংবাদিকদের জন্য বিশেষ নির্দেশিকা দিয়েছে সংগঠনটি। সেখানে শারীরিক ট্রমার ভেতরে লক্ষণ হিসেবে লেখা রয়েছে শ্রান্তি, ঘুমের সমস্যা, মনোযোগ দিতে না পারা, সারাক্ষণ দুশ্চিন্তায় থাকা, শ্বাসকষ্ট, মাথাব্যথা, গায়েব্যথা, পেট খারাপ, কোনও কিছুতেই আগ্রহ না পাওয়া।

ট্রমায় আক্রান্তদের মাঝে এসব লক্ষণ দেখা যাওয়ার কথা বলেছেন অধ্যাপক হেলাল উদ্দিনও।

জিআইজেএন এই শারীরিক সমস্যার সমাধান হিসেবে জোরে শ্বাস নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেছে, “যখন আমরা প্রচণ্ড চাপে থাকি, তখন জোরে শ্বাস নিতে ভুলে যাই। ধীরে ধীরে লম্বা শ্বাস নেওয়া মানসিক চাপ কমানোর একটি ভালো পদ্ধতি। সেইসঙ্গে মাটিতে পা রাখার পরামর্শ দিয়েছে সংগঠনটি।

প্রতি ঘণ্টায় কাজ থেকে অল্প বিরতির পাশাপাশি হাঁটা বা ব্যয়াম এবং প্রয়োজনে অল্প সময়ের জন্য ঘুমানোর পরামর্শও দিয়েছে জিআইজেএন। সেই সঙ্গে মানসিক চাপ বাড়িয়ে দেয়– এমন কিছু থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে সরানোর কথাও বলা হয়েছে সংগঠনটির নির্দেশিকায়।

জিআইজেন মানসিক পীড়নের লক্ষণ হিসেবে দুঃখ, হতাশা, উদ্বেগ, ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা, পৃথিবী সম্পর্কে ধারণা বদলে যাওয়ার পাশাপাশি অস্থিরতা বাড়ায় এমন বিষয় ও ছবি বারবার মনে করা ও ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে যাচ্ছে সারাক্ষণ– এসব লক্ষণের কথা বলেছে।

পাশাপাশি প্রতিকার হিসেবে সংগঠনটি নিজের ইতিবাচক ও নেতিবাচক ভাবনাকে আলাদা করার পরামর্শ দিয়ে ভালো লাগা বিষয়ের প্রতি মনোযোগী হওয়ার, পছন্দের ছবি দেখার, গান শোনার, ডায়েরি লেখার কথা বলেছে; ভাবতে বলেছে নিজের মানসিক শক্তির কথাও।

যদি নিজেকে একা লাগে, সবকিছুতে বিরক্তি কিংবা রাগ হয় অথবা সবসময় একাকীত্বে ভোগা অথবা অস্বস্তির অনুভূতি হয়, তাহলে বন্ধু অথবা স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ, আড্ডা, মজার পরিকল্পনার করার পরামর্শ দিয়েছে জিআইজেএন। পাশাপাশি নিজের বিপদে কারও থেকে সহযোগিতা পেয়েছেন– এমন অভিজ্ঞতার কথা মনে করারও পরামর্শ দিয়েছে সংগঠনটি।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত