Beta
সোমবার, ১৭ মার্চ, ২০২৫
Beta
সোমবার, ১৭ মার্চ, ২০২৫

ত্রাণ সংগ্রহ : ঢাবির রাতদিন একাকার

টিএসসিতে ত্রাণ নিয়ে ব্যস্ত স্বেচ্ছাসেবকরা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
টিএসসিতে ত্রাণ নিয়ে ব্যস্ত স্বেচ্ছাসেবকরা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
[publishpress_authors_box]

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্র মাঠে শখানেক ছাত্রের ভিড়। না, তারা কেউই আর দশটা দিনের মতো গল্পগুজবে অলস সময় পার করছে না। বরং তাদের দেখা যাচ্ছে দৌড়ে গিয়ে কাপড়ভর্তি বস্তা ঘাড়ে নিতে। চাল, মুড়ি, চিড়ার ব্যাগ এক হাত থেকে আরেক হাতে তুলে জায়গায় জায়গায় স্তূপ করতে। কেউ বা আবার ব্যস্ত মাঠের সামনের রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে।

এমন শৃঙ্খলার সঙ্গে তারা সবকিছু করছে যা দেখে যে কারও মনে হতে বাধ্য, তারা বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।

আসলে এই ছাত্ররা কখনও কোনও প্রশিক্ষণ নেয়নি। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিশৃঙ্খলা না করে কাজ করার তাগিদ, অনুপ্রেরণা তারা পাচ্ছে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে বন্যাকবলিত মানুষের কথা চিন্তা করে, যাদের মাথায় এ মুহূর্তে ছাদ নেই। মুখে খাবার নেই। পান করার মতো সুপেয় পানি নেই।

দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বন্যার হিংস্রতায় হতবিহ্বল হয়ে আছে শিশু-বৃদ্ধ সবাই। এমন বন্যা যেমন ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ আগে দেখেনি, তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জনগণের পাশে এভাবে দাঁড়াতে বহু বছর কেউ দেখেনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্র, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) দিনরাত ২৪ ঘণ্টা খেটে এই ছাত্ররা বন্যা দুর্গতদের কাছে ত্রাণ পাঠিয়ে দিচ্ছে। তাদের ক্লান্ত-শ্রান্ত মুখ থেকে হাসি কিন্তু মিলিয়ে যাচ্ছে না।

সব থেকে আশার দিক, দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে এই ছাত্রদের ওপর ভরসা রেখে এগিয়ে এসেছে আপামর জনসাধারণ।

যার যতটুকু সাধ্য আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বা দূরে থেকে তাদের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছে নগদ অর্থ, খাবার, কাপড়। বৃহস্পতিবার থেকে ছাত্রদের কাছে তারা এত এত ত্রাণ পাঠাতে শুরু করে যে, দুদিন পর ত্রাণ রাখার মতো আর জায়গা ছিল না টিএসসিতে। ব্যবহার করতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল ফিল্ড, ডাকসু ক্যাফেটেরিয়া।    

কেবল শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্র, টিএসসি, সেন্ট্রাল ফিল্ড বা ডাকসু ক্যাফেটেরিয়া নয়, শাহবাগ মোড়েও চলছে ত্রাণ তৎপরতা। সেখানে ত্রাণ সংগ্রহ করছে টিএসসিকেন্দ্রিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ছাড়াও শাহবাগে গণচাঁদা তুলছে রাজধানীর বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রে ত্রাণ কার্যক্রম। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

ভারি বৃষ্টি আর ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে সৃষ্ট বন্যায় দুর্গত মানুষদের সহযোগিতায় বুধবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার গণত্রাণ সংগ্রহের ডাক দেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সব সমন্বয়ক ও স্বেচ্ছাসেবকদের নিজ নিজ জেলা, উপজেলায় স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও জনসাধারণের সঙ্গে সমন্বয় করে স্বেচ্ছাসেবী দল গঠনের আহ্বান জানান তিনি।

পরদিনই সকাল ৮টায় টিএসসিতে একটি বুথে নগদ অর্থ ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ শুরু হয়, যা এখনও প্রতিদিন রাত ১০টা পর্যন্ত চলছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার সকাল থেকে রবিবার বিকাল ৫টা পর্যন্ত ৫ কোটি ২৩ লাখ ৩ হাজার ৬০৩ টাকা বন্যার্তদের জন্য অর্থসহায়তা পেয়েছে তারা।

এই সময়ে বন্যাকবলিত এলাকায় ৫০টি ট্রাকে করে প্রায় ৫০ হাজারের বেশি প্যাকেজ পাঠানো হয়েছে। এগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর তত্ত্বাবধানে ৩ হাজার প্যাকেজ হেলিকপ্টারে করে দুর্গম অঞ্চলগুলোতে বণ্টন করা হয়েছে। আর ৩ লাখ ৯৬ হাজার ৫০০ টাকা নগদ সহায়তা দেওয়া হয়েছে।

মানুষ মানুষের জন্য

রবিবার দুপুর ১২টার দিকে ঢাকার বাসিন্দা শারমিন খান তার দুই ছেলেকে নিয়ে টিএসসিতে আসেন ত্রাণ দিতে। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “দেশের যে অবস্থা, আমরা যতটা স্বচ্ছলভাবে জীবনযাপন করছি, বাকিরা সেভাবে পারছে না। দুর্গত মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য, দুর্যোগপূর্ণ সময়ে তাদের কষ্ট লাঘবের জন্য তাদের পাশে দাঁড়াতে এসেছি।

টিএসসিতে বন্যার্তদের জন্য নিরলস পরিশ্রম করে যাওয়া ছাত্রদের একজন জাহিদ হাসান। শরীয়তপুরে বাড়ি তার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষে পড়েন তিনি।

ত্রাণ সংগ্রহ কার্যক্রমের শুরু থেকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন জাহিদ।

টিএসসিতে ত্রাণের স্তূপ। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

তিনি বলেন, “আমি এখানে আজ চারদিন ধরে কাজ করছি। সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত সবাই এখানে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। ত্রাণগুলো প্যাকেজিং-এর পাশাপাশি প্রতিটি জিনিস আলাদা করে প্যাকেট করা হচ্ছে। শিশু খাদ্য, তরল দুধ, চিপস, কেক, চিনি, চিড়া, মুড়ি, চাল ও খেজুর আছে এসব প্যাকেটে।”

ত্রাণ কীভাবে পাঠানো হচ্ছে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী বলেন, “এখান থেকে ট্রাক-লরিতে করে ত্রাণ পাঠানো হচ্ছে। এছাড়া দুর্গম এলাকায় আমাদের যে সমন্বয়করা আছেন, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে হেলিকপ্টারেও ত্রাণ পাঠানো হচ্ছে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্র মাঠে ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে রবিবার দুপুর ১টার দিকে আসেন কানাডাপ্রবাসী একজন। নাম জানাতে অনিচ্ছুক এই নারী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “২৫ বছর ধরে কানাডায় থাকি। কিছুদিন আগে দেশে এসেছি। এমন বন্যা আমি দেখি নাই। মানুষের এত কষ্ট সহ্য করা যায় না। তাদের পাশে দাঁড়াতেই এখানে আসা।”

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ত্রাণ সংক্রান্ত উদ্যোগের প্রশংসা করে তিনি বলেন, “আমাদের বাচ্চারা বন্যা দুর্গতদের জন্য এত কিছু করছে! তাদের পক্ষে আসলে সবকিছুই করা সম্ভব।”

“আমরা যা পারি নাই, এই বাচ্চারা তা পেরেছে। ওরা ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। ওদেরকে শ্রদ্ধা। ওদের জন্য সারারাত দোয়া করি। দেশটা যেন একদিন সত্যি সত্যিই সুন্দর হয়।”

টিএসসিতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এক নারী এসেছেন ত্রাণ সহায়তা নিয়ে। তিনিও নাম না জানিয়ে বলেন, “পুরো দেশটাকে একটা পরিবার ভেবে এখানে এসেছি। এই বিশাল পরিবারের একটা অংশ এ মুহূর্তে কষ্টে আছে। নিজেদের জায়গা থেকে যদি তাদের কাজে লাগতে পারি, সেই কারণে আসা এখানে।”

তিনি বলেন, “আমাদের মধ্যে এক ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাজ করছিল। ত্রাণ সামগ্রীগুলো ঠিকমতো দুর্গত এলাকায় পৌঁছাচ্ছে কি না? অসহায় মানুষগুলো সেসব পাচ্ছে কি না? এই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব এখন কেটে গেছে।   

“ত্রাণ তৎপরতা আগে পাড়া, মহল্লা আর জেলা পর্যায়ে ছিল। এখন আমরা তা জাতীয় পর্যায়ে দেখতে পাচ্ছি। আমি মনে করি, এটা বিশাল এক প্রাপ্তি। কীভাবে এটিকে টেকসই করা যায়, তা ভাবা উচিত।”

শাহবাগ মোড়ে টিএসসিকেন্দ্রিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের ত্রাণ সংগ্রহ। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

শুধু ব্যক্তি নয়, রাজনৈতিক দলও সাড়া দিচ্ছে ছাত্রদের ডাকে।

ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) যুগ্ম সম্পাদক ওবায়দুল হককে ত্রাণ হাতে টিএসসিতে দেখা যায়। তিনি বলেন, “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে। প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছানোর মতো জনবল আমাদের দলের নেই। তাই যতটুকু সম্ভব, তাদের সঙ্গে ত্রাণ কর্মসূচিতে আমরা অংশ নিয়েছি।”

সন্ধ্যার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মাঠে কাপড়ভর্তি বস্তা নিয়ে বড় বোনের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিল মোবারক হোসেন আহনাফ।

সাউথ পয়েন্ট স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির এই ছাত্র সকাল সন্ধ্যাকে বলে, “বন্যার্তদের জন্য কাপড় নিয়ে এসেছি। ওরা অনেক কষ্টে আছে। তাই এসেছি।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত