আমেরিকায় লোকে বার্গার, হটডগ, বারিটো, নাচোস খায়; ওদের স্ট্রিট ফুড বলতে এসবই আমরা জেনে এসেছি এতোদিন। বাংলাদেশেও এইসব খাবারের জনপ্রিয়তাও তুঙ্গে। সেই আমেরিকানরাই যখন আমাদের স্ট্রিট ফুড খেয়ে উচ্ছ্বসিত, তখন ওদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলতে ইচ্ছে করবে, ‘বাংলাদেশি ফুচকা ইজ দ্য বেস্ট’।
১৪ মে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের ফেইসবুক পাতায় রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ও সফররত মার্কিন কূটনীতিবিদ ডোনাল্ড লু’র ফুচকা খাওয়ার ভিডিও এরমধ্যে ভাইরাল হয়েছে।
এই ফুচকা বানিয়েছেন টিভির পরিচিত মুখ রন্ধনশিল্পী রহিমা সুলতানা রীতা।
সকাল সন্ধ্যার সঙ্গে আলাপে উঠে এল তার মুখরোচক ফুচকার রেসিপি।
ডোনাল্ড লু এবং পিটার হাস আপ্যায়নে ফুচকাই কেন?
রহিমা সুলতানা রীতা বললেন, “ফুচকাটা আমিই বানিয়েছি। আগে থেকেই আমরা ঠিকঠাক করেছি ফুচকা খাওয়াবো। আমি আমার মতো আমার রেসিপিতে বানিয়েছি। আমাদের বাংলাদেশি ট্রেডিশনাল পপুলার স্ন্যাকস হিসেবেই চিন্তা করা হয়েছে।
“আর ওনারা দুইজন আমার সাথে পাশে বসে ফুচকায় পুর ভরে খেয়েছে। আমি তো ফুচকার সব টপিং নিয়ে গেছি। ইট ওয়াজ ফান। ওরা ভীষণ পছন্দ করেছে।”
তবে শুধুই ফুচকা খাইয়ে ক্ষ্যান্ত দেননি এই রাঁধুনি। পথে-ঘাটে বয়ামে-গ্লাসে ধুন্ধুমার ঝাঁকিয়ে মাখানো যে ঝালমুড়ি তার স্বাদও এ দুই কূটনীতিবিদকে দিয়েছেন রীতা।
তিনি বলেন, “ঝালমুড়ি আমি স্ট্রিটফুডওয়ালারা যেমন হয়, ওমন করে মশলা করে নিয়ে গিয়েছিলাম।
“আমি ওদের কাছে গিয়েছি, দেখেছি কীভাবে ওরা মশলাটা তৈরি করে রাখে। আমি হাইজেনিক ওয়েতে সরিষার তেল দিয়ে মশলাটা করেছি। সাথে কিছু ছোলাও যোগ করেছি। আমার মতো করে আমি ঝালমুড়ি বানিয়েছি।”
সোশ্যাল মিডিয়ার ভিডিওতে দেখা গেল, ডোনাল্ড লু এবং পিটার হাস দুজনেই ফুচকা হাতে তুলে ধরে বলছেন, “বাংলাদেশি ফুচকা ইজ দ্য বেস্ট।” সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন রীতাও।
ডোলান্ড লু এবং পিটার হাসের ফুচকা খাওয়ার উচ্ছ্বাসে একান-ওকান হাসি দেখা যাচ্ছিল তার মুখেও।
“ওরা শুধু পছন্দই করেছে তা নয়, আমাকে গিফটও দিয়ে গেছে; ব্যাগ দিয়েছে, আরও কিছু। আসলে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো ওরা খুশি হয়েছে। আমি যে ওদের খাইয়ে তৃপ্তি দিতে পেরেছি- ইটস মাই প্লেজার।”
কিন্তু বিদেশিরা তো আমাদের মতো ঝাল খেতে পারেন না; ডোনাল্ড লু আর পিটার হাস ঝাল খেতে পারলেন!
হাসতে হাসতে রহিমা সুলতানা রীতা বললেন, “বানানোর সময় আমি জিজ্ঞেস করেছি, আমি কি বেশি ঝাল দেব?,
“লু হট মানে ঝাল পছন্দ করে। তবে পিটার একটু কম ঝাল খায়।”
“আমি তো তিন রকম ফুচকা বানিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম।একটা হলো আমাদের ট্রেডিশনাল তেঁতুলের টক দিয়ে। একটা করেছি দই ফুচকা। আরেকটা হলো ফিউশন – বার-বি-কিউ ফুচকা।”
বার-বি-কিউ ফুচকাটা কী?
“ফুচকায় আমি চিকেন কুচি কুচি করে কেটে দিয়েছি। সস মিশিয়েছি। আর ছোট ছোট গ্লাসের মধ্যে একটা ডিপ বানিয়ে পরিবেশন করেছি। সরিষা বাটা, মেয়নিজ, পেরিপেরি সস, টমেটো কেচাপ ছিল গ্লাসে। উপরে পুদিনা পাতা বসিয়ে দিয়েছিলাম। এটা দেখতে খুবই সুন্দর দেখাচ্ছিল।“
তারপর যেন গোপন খবর ফাঁস করে দিলেন এভাবে সকাল সন্ধ্যাকে রহিমা সুলতানা রীতা বললেন, “আসলে ফুচকা ফিউশনটা চাওয়া ছিল পিটারের। আমি ওর জন্য করেছিলাম। ওরা পছন্দ করেছে খুব।”
ফুচকা তো একবারে মুখে পুরে নিতে হয়; অনভ্যস্ত দুজন পারলো খেতে ওভাবে?
“একেবারে! ওরা তো বড় বড় হা করতে পারে! নিজেরাই সসে ডিপ করে নিয়ে বড় হা করে খেয়েছে। আমি বলে দিয়েছিলাম। তারপর ওরা ওদের পছন্দ মতো মিক্স করে খেয়েছে। ”
খাবারের পরিবেশনা নিয়ে রীতা বলেন, “বাসা থেকে ভেজে গরম গরম ফুচকা নিয়ে গেছি। ওখানে গিয়ে সব সাজিয়ে পরিবেশন করেছি। দই ছিল, তেঁতুল সস ছিল। আবার ঝুড়িভাজা ছিল।
“কোন বাটিতে ফুচকা সার্ভ করবো, গ্লাস কেমন হবে সব নিজে কিনলাম। আমার নিজের পকেট থেকেই তো আমি দশ হাজার টাকা খরচ করে ফেলেছি।”
“ওরা দুজন আবার মাথায় ক্যাপ, গায়ে অ্যাপ্রন পরে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। এটা অসামান্য একটা অভিজ্ঞতা। আই ফেল্ট অনারড। আমার মনে হয়েছে, এটা আমার জন্য একটা স্মরণীয় ঘটনা। আমি চিন্তাও করিনি যে ওরা এতো পছন্দ করবে।”
আনন্দ নিয়েই বললেন, “আমি তো অনেক ফুচকা বানিয়ে নিয়ে গেছি সবার জন্য; প্রায় একশ ফুচকা বানিয়ে নিয়ে গেছিলাম। রাত জেগে সব গুছিয়ে কাজ করেছি। বাজারও আমিই করেছি।”
ঝালমুড়ি কীভাবে খেলো ওরা দুজন?
“মশলা তো আমি বানিয়ে নিয়ে গেছি। ফ্লেভারের জন্য আচারের তেল দিয়েছিলাম। সরিষার তেল তো আছেই। মশলার সাথে পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ, ধনেপাতা, ঝুড়িভাজা, কুচি করা লেবুর খোসা, লেবুর রস সব মিক্স করে তারপর মুড়ি দিয়েছি। সঙ্গে ছোলাও দিয়েছি।”
“সুপ পরিবেশন করে এমন ছোট ছোট বাটি-প্লেটে করে দিয়েছিলাম ঝালমুড়ি। ওরা চামচ দিয়ে খেয়েছে সিমপল বাট ভেরি এলিগেন্ট ফুড ঝালমুড়ি।”
খুব শিগগিরই ছুটি কাটাতে যুক্তরাষ্ট্র যাচ্ছেন এই রন্ধনশিল্পী। সেটা শুনে পিটার হাস প্রস্তাব দিলেন দুজনে মিলে ফুচকা স্ট্যান্ড দেয়ার ।
রীতা বলেন, “ঈদের সময় ছুটি কাটাতে আমেরিকায় থাকবো দুই সপ্তাহের মতো। পিটারকে বললাম সে কথা। সেও বলল, তুমি এসো; আমরা ফুচকা স্ট্যান্ড দেব। আমিও বললাম, আমার শিডিউল এবার একেবারে টাইট; এবার পারবো না। তোমরা যদি কখনও মেলা করো তবে ঝালমুড়ি আর ফুচকা বিক্রি করতে আমি যাবো।”
এই যে বিশেষ দুজন বিদেশি মানুষ, তাদের কাছে একেবারে দেশীয় দুটো পদ পরিবেশন করতে গিয়ে খানিক ভয় কাজ করছিল কি?
“না না না!” সকাল সন্ধ্যার এই প্রশ্ন একেবারে হেসে উড়িয়ে দিলে রহিমা সুলতানা রীতা।
“আমাকে যদি কালকে বলে বাইডেনকে ফুচকা পরিবেশন করো আমার কোনো সমস্যাই নেই। বাইডেন যদি এই খবর দেখে বলে তারও খেতে মন চাচ্ছে, আমি হোয়াইট হাউজে গিয়েও বানিয়ে পরিবেশন করে আসতে পারবো।”
“আমি নার্ভাস হই না। কারণ যতটুকু কাজ করি আমার কাজে আমি ফোকাসড থাকি। কাজ করতে গেলে আমি সব ভুলে যাই।”
একজন রন্ধন ও রূপ বিশেষজ্ঞ রহিমা সুলতানা রীতা পত্রিকায় এসব নিয়ে লেখেন মাঝেসাঝেই। রোজার মাসে ইফতারের আয়োজন নিয়ে অনেক অনুষ্ঠানে তাকে দেখা যায়। টিভিতে জীবনচর্যার পরামর্শ নিয়ে নিজেও অনুষ্ঠান করেছেন, আবার বিভিন্ন চ্যানেলেও তাকে হরদম দেখা যায়।
রহিমা সুলতানা রীতার রান্নার ভিডিও ইউটিউবে দেখে তাকেই মনে ধরে দেশে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সবার।
“আমি কারোর মাধ্যমে যাইনি। ওরাই যোগাযোগ করেছে। ওরা ইউটিউব দেখে আমাকে বাছাই করেছে। এনটিভিকেও ফোন করেছিল এরপর, আমার নম্বরের জন্য। অনুষ্ঠানের দুই-আড়াই সপ্তাহ আগে ফোন পেয়েছিলাম।”
ঢাকা সফরের প্রথমদিনে ব্যস্ত সূচির ফাঁকে গুলশানের আমেরিকান ক্লাবে বাংলাদেশি খাবারের স্বাদ নিতে গিয়েছিলেন ডোনাল্ড লু। সঙ্গে ছিলেন পিটার হাস।
দুজনের সঙ্গে এতোটা সময় কাটালেন। কাকে কেমন দেখলেন?
“সেদিন একটা ঘণ্টা এই দুজনের সঙ্গে ছিলাম। পিটার তো ভালই; লু কে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। যতটুকু কথা বলেছি ওর সঙ্গে আমার খুব ভালো লেগেছে। এটা স্মরণীয় মুহূর্ত আমার জন্য।”
লোকে বলে, ‘যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে’। কেন বলে সে কথা আবারও বোঝা গেলো রহিমা সুলতানা রীতার কথায়।
“খাবার বানানোর ব্যস্ততা তো ছিলই; আবার নিজেকেও তৈরি করতে হয়েছে, যেহেতু আমি পরিবেশন করছি। আমি সেদিন সবুজ রঙের … সি গ্রিন … দেশীয় শাড়ি পরেছিলাম। চুলগুলো বেঁধেছি। খাবার পরিবেশনের কিছু রীতি আছে, সেসব আমি সবই পালন করেছি। হাতে গ্লাভস পরেছি।”
রহিমা সুলতানা রীতার ‘খুব পছন্দের’ রঙ সবুজ। এর সঙ্গে আরও কারণ রয়েছে তার সবুজ শাড়ি পরার।
“ওখানে আমি যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম সেই জায়গাটায় লালচে বিষয় ছিল। তাই মনে হয়েছিল সবুজ সেখানে ফুটে উঠবে। ওরা নীল পরেছিল। সব মিলিয়ে ভাবলাম আমি সবুজই পরি।”
যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রতিনিধির পরনে ছিল নীল রঙের শেফ ক্যাপ এবং অ্যাপ্রন। টুপিতে বাংলায় লেখা ছিল শেফ পিটার ও শেফ ডন।
ফুচকা মুচমুচে করার টিপস কি দেবেন সকাল সন্ধ্যার অনুসারীদের জন্য?
তালমাখনা আর ময়দার পরিমাণ খেয়াল রাখতে হবে; “যেমন এক কেজিতে এক চা চামচ তাল মাখনা দিলেই হবে”, বললেন পাকা রাঁধুনি রহিমা সুলতানা রীতা।
“খুব ভালো করে মাখাতে হয় খামিরটাকে। তেল দিতে হয় না। তাহলে পরে নরম হয়ে যাবে ফুচকা। ময়দার কোয়ালিটির উপরেও ফুচকা কমবেশি মুচমুচে হয়।”
“ফুচকার রুটিটা বেলার সময় খুব পাতলাও হবে না, আবার মোটাও হবে না; এক ইঞ্চির চারভাগের এক ভাগ ধরা যাক এমন হবে।”
“এরপর তো গোল গোল করে কেটে সেঁকে রাখা যায়। সবচেয়ে ভালো হয় রোদে শুকিয়ে রাখলে। পাপড়ের মতো। তাহলে অনেকদিনের জন্য বয়ামে ভরে রাখা যায়। রুটির মধ্যেকার আর্দ্রতা থাকা যাবে না, এটাও একটা কৌশল।”
রহিমা সুলতানা রীতার সঙ্গে ‘মুখরোচক’ এই আলাপে যে প্রশ্নটি না করলেই নয়, তা জানতে চাইল সকাল সন্ধ্যা; ঝালমুড়ি মুচমুচে রাখার টিপস দেবেন?
যুক্তরাষ্ট্রের দুজনকে ঝালমুড়ি খাইয়ে বাংলাদেশের স্ট্রিট ফুডে মুগ্ধ করে দেওয়া রহিমা সুলতানা রীতার টিপস হলো, “সব মশলা মাখিয়ে রেডি থাকবে। যখন খাওয়া হবে ঠিক তখন মুড়ি দিয়ে মাখাতে হবে।”