ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের পুঁজিবাজার। এত দিন মুখ ফিরিয়ে নেওয়া বিনিয়োগকারীরা আকর্ষণীয় বড় মূলধনী কোম্পানিগুলোর শেয়ার কেনায় ঝুঁকেছেন। এতে দেশের উভয় স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক ও লেনদেনে চাঙ্গাভাব দেখা দিয়েছে।
গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন। এতে কোটা সংস্কারের দাবিতে জুলাইয়ে শুরু হওয়া আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে দেশে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল তার অবসান হয়। এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে দেশের পুঁজিবাজারে।
সরকার পতনের পর প্রথম দিন মঙ্গলবার দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স প্রায় ২০০ পয়েন্ট বেড়েছিল। শতাংশ হিসাবে বেড়েছিল ৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। লেনদেন হয়েছিল ৭৫০ কোটি টাকা। সাম্প্রতিক সময়ে ডিএসইর সূচকে এমন উল্লম্ফন দেখা যায়নি।
সেই ধারাবাহিকতায় বুধবারও ডিএসইর মূল্যসূচকে উল্লম্ফন দেখা গেছে। এদিনও প্রধান সূচক ডিএসইএক্স প্রায় ২০০ পয়েন্ট বেড়েছে; শতাংশ হিসাবে বেড়েছে সাড়ে ৩ শতাংশের বেশি।
অন্য পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই) একই চিত্র দেখা গেছে।
মঙ্গলবারের মতো বুধবারও সকাল ১০টায় ব্যাপক উত্থান নিয়ে শুরু হয় লেনদেন। তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারের দর বাড়লেও মঙ্গলবারের মতো বুধবারও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দরপতন হয়েছে। একই অবস্থা আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ারেরও।
তবে ডিএসইতে লেনদেনে আধিপত্য দেখা যায় ওষুধ, ব্যাংক ও খাদ্য খাতের। এদিন ডিএসইর মোট লেনদেনের মধ্যে ১৬.৯ শতাংশ ওষুধ, ১৪.২ শতাংশ ব্যাংক ও ১৩.৮ শতাংশ ছিল খাদ্য খাতের।
আন্দোলন দমাতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার বুধবার পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছিল। তবে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশত্যাগের পর সোমবারই সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ব্যাংকসহ সব সরকারি-বেসরকারি অফিস খোলা রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়। এর ফলে মঙ্গলবার স্বাভাবিক সময়ে শুরু হয় পুঁজিবাজারের লেনদেন।
বুধবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৫ হাজার ৪২৬ দশমিক ৪২ পয়েন্টে নিয়ে সকাল ১০টায় শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯২ দশমিক ৩৬ পয়েন্ট বেড়ে লেনদেন শেষ হয়; ডিএসইএক্স অবস্থান করছে ৫ হাজার ৬১৮ দশমিক ৭৯ পয়েন্টে।
ডিএসইর অন্য দুই সূচক ডিএসইএস ৪২ দশমিক ৫২ পয়েন্ট বা ৩ দশমিক ৬১ শতাংশ বেড়ে ১ হাজার ২১৯ দশমিক ১৩ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। ডিএস-৩০ সূচক ৮৭ দশমিক ৪৩ পয়েন্ট বা ৪ দশমিক ৫১ শতাংশ বেড়ে ২ হাজার ২২ দশমিক ১৭ পয়েন্টে অবস্থান করছে।
বুধবার ডিএসইতে ৭৭৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। মঙ্গলবার লেনদেনের অঙ্ক ছিল ৭৪৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকা।
মঙ্গলবার ডিএসইতে ৩৯৬টি কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে ২৬৬টির দামই বেড়েছে; কমেছে ১১৪টির। আর অপরিবর্তিত ছিল ১৬টির দর।
বুধবারও সালমানের কোম্পানিগুলোর দরপতন
মঙ্গলবারের মতো বুধবারও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারের দর বাড়লেও সদ্য পদত্যাগ করা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা পুঁজিবাজারের আলোচিত নাম সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দরপতন হয়েছে।
একই অবস্থা বেসরকারি আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ারেরও। ব্যাংকটির মালিকানায় সরকারের অংশ বড় হলেও এতে বেক্সিমকো গ্রুপে বিনিয়োগ দিয়ে সালমান এফ রহমান ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদে আছেন। তার মালিকানাধীন বেক্সিমকো ফার্মা, শাইনপুকুর সিরামিকসের শেয়ারের দরপতন অব্যাহত রয়েছে।
বুধবার বেক্সিমকো ফার্মার শেয়ারের দাম কমেছে ৩ টাকা। শতাংশ হিসাবে বেড়েছে ২ দশমিক ৯৪ শতাংশ। অথচ ওষুধ খাতের আরেক কোম্পানি স্কয়ার ফার্মার দর বেড়েছে ১১ টাকা ১০ পয়সা; শতাংশ হিসাবে বেড়েছে ৫ দশমিক ০৭ শতাংশ।
শাইনপুকুর সিরামিকসের শেয়ারের দর কমেছে ৯০ পয়সা বা ২ দশমিক ৯৬ শতাংশ।
অন্যদিকে সব ব্যাংকের শেয়ারের দাম বাড়লেও আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ারের দর বুধবার ২০ পয়সা বা ২ দশমিক ৩০ শতাংশ কমেছে।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) বিধান অনুযায়ী, পুঁজিবাজারে কোনও কোম্পানি বা মিউচুয়াল ফান্ডের শেয়ার বা ইউনিটের দাম এক দিনে ৩ শতাংশের বেশি কমতে পারে না।
তবে বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ারদরে ফ্লোর প্রাইস এখনও কার্যকর রাখায় ওই শেয়ারের দরপতন হওয়ার সুযোগ নেই।
জুলাইয়ের শুরুতে শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে সপ্তাহের প্রথম দিন রবিবার পুঁজিবাজারে বড় দরপতন হয়। ওইদিন প্রধান বাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১০৪ দশমিক ৬৬ পয়েন্ট কমেছিল। অন্য বাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ১৯৩ দশমিক ১৮ পয়েন্ট কমে।
বিদায়ী সরকার বুধবার পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করায় সপ্তাহের দ্বিতীয় দিন সোমবার পুঁজিবাজারে লেনদেন হয়নি।
উল্লম্ফন সিএসইতেও
বুধবার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ৫৪৫ দশমিক ১০ পয়েন্ট বেড়ে অবস্থান করছে ১৫ হাজার ৯৩৮ দশমিক ২৫ পয়েন্টে। শতাংশ হিসাবে এই সূচক বেড়েছে ৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ। লেনদেন হয়েছে ২২৫ কোটি ১৫লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট।
২৫৬টি কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে দাম বেড়েছে ১৬০টির। কমেছে ৭৫টির। আর অপরিবর্তিত ছিল ২১টির দর।
একাধিক ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ নির্বাহী নাম প্রকাশ না করার শর্তে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বাজারে মন্দা চলছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে পুঁজিবাজার ভালো যায় না—এমন প্রচারণাও আছে বাজারে। তাই পরিবর্তনের হাওয়ায় পুঁজিবাজারেও চাঙাভাব দেখা দিয়েছে।
দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বাজার আরও ভালো হবে বলে আশার কথা শোনার তারা।