দেশের হস্তশিল্পকে ২০২৪ সালের বর্ষপণ্য ঘোষণা করে এর ব্যাখ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এতে নারীদের কর্মসংস্থান বাড়বে, অর্থনৈতিকভাবে তারা স্বাবলম্বী হবে।
রবিবার পূর্বাচলে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি এই ঘোষণা দেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘‘নারীর ক্ষমতায়ন, নারীকে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা এবং নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে হস্তশিল্পকে চলতি বছরের বর্ষপণ্য হিসেবে ঘোষণা করছি।
‘‘আমরা প্রতিবছর একটি পণ্যকে বর্ষপণ্য হিসেবে সুনির্দিষ্ট করে দিই। পাট, চামড়াজাত পণ্যকে বিভিন্ন সময় বর্ষপণ্য হিসেবে ঘোষণা করেছি।’’
এবার হস্তশিল্পকে বর্ষপণ্য ঘোষণার ব্যাখ্যায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘হস্তশিল্পের মাধ্যমে নারীদের কর্মসংস্থান বাড়বে, অর্থনৈতিকভাবে নারীরা স্বাবলম্বী হবে। পাশাপাশি অনেকে যারা গৃহকর্ম করেন তারাও কিছু আয় করতে পারবেন, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
‘‘একটা জাতীকে উঠে দাঁড়াতে হলে যেখানে আমাদের অর্ধেকই নারী, সেখানে নারীদের স্বাবলম্বী হতে হবে।’’
নারীরা যেসব পণ্য উৎপাদন করবে সেগুলির জন্য তাদের আরও প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘‘আমরা তৃণমূল, গ্রামের নারীদের অনলাইন ব্যবহার করার শিক্ষা দিচ্ছি। সবার হাতে এখন মোবাইল ফোন আছে। আমরা ডিজিটাল সেন্টার করে দিয়েছি। সেইসঙ্গে নারীদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতেরও ব্যবস্থা করতে হবে।
‘‘হস্তশিল্প বলতে কেবল মুড়ি-চিড়া করবে কেন, এখন মানুষের খাদ্যের রুচিও বদলে গেছে।’’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘‘সম্প্রতি আমি টুঙ্গিপাড়ায় গেলাম। সেখানকার আওয়ামী লীগের অফিসে হেঁটে হেঁটে যাওয়ার সময় দেখলাম সেখানে একটি রেস্টুরেন্ট। যদিও আমি যাব বলে সিকিউরিটির লোকজনরা রেস্টুরেন্টট বন্ধ করে রেখে দিয়েছে।
‘‘এটা খুব আফসোসের ব্যপার। রেস্টুরেন্টটা বন্ধ হলো কেন? সেখানে অনেক খাবার পণ্যের সঙ্গে পিৎজাও আছে। আমার খুব আফসোস থেকে গেল এখানকার পিৎজাটা খেয়ে যেতে পারলাম না। ভালো সিঙ্গাড়া, সমুচা বিক্রি করছে, তালিকা আছে, ছবি দেখলাম। ছবি দেখে মনটা ভরতে হলো। কিন্তু আমার ভালো লাগল অজপাড়াগায় মানুষের খ্যাদ্যাভাস্যের কত পরিবর্তন হয়েছে।’’
‘‘কাজেই এখান থেকে যদি শিক্ষা নিই, নারীরা চিড়া, মুড়ি খই তো করবেই, পাশাপাশি পিঠা-পুলি, আঁচার, ফুচকা, নুডুলস, স্প্যাগেটি— এগুলি প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করা কোন কঠিন ব্যাপার নয়।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘তাছাড়া পোশাক-পরিচ্ছদে এম্ব্রোডারি করা, শেলাইয়রে কাজ করা, উলের তৈরি পোশাক। এছাড়া তামা, কাসা, পিতল, মাটি, পাট, খড়, গমের ডাটা, কাশফুলের ডাটা, বেত, সুপারি গাছের ছাল-পাতা ছোট বাটি, গ্লাস তৈরি হচ্ছে।
‘‘কচুড়িপনা দিয়ে কাগজ থেকে শুরু করে অনেক কিছু তৈরি হচ্ছে। কলা গাছের থোড় থেকে পাহাড়ি এলাকার কয়েকজন শাড়ি বানিয়ে আমাকে উপহার দিয়ে গেছে। আনারস গাছের পাতা থেকেও খুব ভালো সিল্ক কাপড় তৈরি হয়।’’
এরকম অনেক কাজ নারীদের করার সুযোগ আছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘‘তাদের (নারীদের) প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কখন কোন ধরনের রং ও নকশার প্রয়োজন, সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
‘‘তাছাড়া এখন কর্মব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় অনেকে বাসা-বাড়িতে পিঠা-পুলি, আঁচার বানিয়ে খাওয়ার সময় পায় না। এ কারণে হস্তশিল্পীরা এগুলি বানিয়ে বিক্রি করলে সকলে খেয়ে আনন্দ করার সুযোগ পাবে।’’
‘‘সবচেয়ে বেশি দরকার অনলাইনে এগুলি কেনা-বেচার ব্যবস্থা করে দেওয়া। অনলাইনে পণ্য প্রদর্শন ও কেনাবেচার জন্য আমরা প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। আরও দেব। এতে প্রতিটি মেয়ের কিছু অতিরিক্ত উপার্জন থাকবে। আর উপার্জন থাকলে পরিবারে, সংসারে, সমাজে তার একটি স্থান থাকবে।’’
আন্তর্জাতিক বাজারে দেশীয় পণ্যের চাহিদা বাড়াতে নতুন পণ্য অন্তর্ভূক্তিকরণ, বাজার সম্প্রসারণ ও পণ্যের বহুমুখীকরণের ওপর জোর দিতে প্রতিবছর বাণিজ্য মেলার আয়োজন করে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। ১৯৯৫ সাল থেকে এ ধরনের মেলার আয়োজন করে আসছে সংস্থাটি।
২০২২ সাল থেকে এই মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে ঢাকার পূর্বাচলে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টারে। এর আগে মেলাটি অনুষ্ঠিত হতো শেরেবাংলা নগরে, চীন-মৈত্রী সম্মেলনকেন্দ্রে।
ইপিবির আরও বেশি সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘‘রপ্তানিতে বাংলাদেশ নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু একটা-দুইটা পণ্যের ওপর নির্ভরশীল থাকলে চলবে না। আমাদেরকে রপ্তানি বহুমুখী করতে হবে।
‘‘এটা আমি বারবার বলছি। সেক্ষেত্রে আরও কিছু সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। আমরা যে পণ্যগুলিকে সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছি তারাই খুব বেশি সাফল্য বয়ে আনছে। তাহলে আমাদের অন্যান্য পণ্যগুলি কেন বাদ যাবে? তাদেরকেও আমাদের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। তাহলে তারাও ভালো ব্যবসা করবে।’’
তিনি বলেন, ‘‘যেমন আমাদের নিট ও ওভেন গার্মেন্ট বিশ্ববাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে। আমাদের সুযোগ আছে পাট ও পাটজাত পণ্যের মতো পরিবেশবান্ধব পণ্য বিশ্ববাজারে আরও বেশি চাহিদা সৃষ্টি করে রপ্তানি বৃদ্ধি করার।’’
একইভাবে চামড়াজাত পণ্যের ক্ষেত্রেও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী। এ জন্য তিনি গবেষণা বৃদ্ধির ওপর জোর দেন।
তিনি বলেন, ‘‘পাট ও চামড়ার সংমিশ্রণেও অনেক বৈচিত্রময় পণ্য তৈরি হচ্ছে। এ ধরনের পণ্যের বিরাট বাজার বিশ্বব্যাপী রয়ে গেছে। এক্ষেত্রে আমাদের আরও গুরুত্ব দিতে হবে।
‘‘আমরা গার্মেন্ট খাতে যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছি অন্যান্য ক্ষেত্রেও আমাদের সেই সুযোগ-সুবিধা দেওয়া দরকার। পাট, চামড়া, ওষুধ শিল্প থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে আমরা কিন্তু যথেষ্ট অগ্রগামী। এছাড়াও আমাদের আরও অনেক পণ্য আছে যেগুলি রপ্তানি হচ্ছে কিন্তু খুব সীমিত আকারে। সেগুলি খুঁজে বের করে আমাদের আরও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।’’
এবারের মেলায় দেশ-বিদেশের মোট ৩৩০টি স্টল, প্যাভিলিয়ন ও মিনি প্যাভিলিয়ন থাকবে। এর মধ্যে ১৫-১৮টি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের স্টল রয়েছে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু, এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম, বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ ও ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান এ এইচ এম আহসান।
উদ্বোধন শেষে মেলা ঘুরে দেখেন শেখ হাসিনা।
বরাবরের মতো ভারত, পাকিস্তান, ইরান, তুরস্ক, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ব্যবসায়ীরা মেলায় অংশ নিচ্ছেন। স্থানীয় উদ্যোক্তারাও তাদের উৎপাদিত পণ্য প্রদর্শন ও বিক্রি করবেন এই মেলায়।