ভোটের বাকি আর মাত্র তিনদিন। বিএনপির বর্জনের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এমন প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার (৪ জানুয়ারি) জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ভাষণে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি সাংবিধানিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় এমন কিছুতে ইন্ধন না দিতে আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
নৌকায় ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে সেবা করার সুযোগ দেওয়ায় দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান প্রধানমন্ত্রী।
দীর্ঘ চলার পথে যদি কোনও ভুল-ভ্রান্তি হয়ে থাকে তবে ক্ষমা সুন্দর চোখে দেখতে অনুরোধ করে বলেন, “আবার সরকার গঠন করতে পারলে, ভুলগুলি শোধরাবার সুযোগ পাব। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আমাকে আপনাদের সেবা করার সুযোগ দিন।”
আওয়ামী লীগের শাসনামলে দেশ ও মানুষের উন্নয়নে নেওয়া বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, “১৫ বছর আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশের মধ্যে বিরাট ব্যবধান। মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটেছে। মানুষ আজ স্বপ্ন দেখে উন্নত জীবনের। স্বপ্ন দেখে সুন্দরভাবে বাঁচার।”
এসময় ২০০৬ সালের সঙ্গে বর্তমান সময়ের মাথাপিছু আয়, দারিদ্রের হার, বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা, বাজেটের আকার, প্রবৃদ্ধি, রেমিট্যান্স প্রবাহের ব্যবধান তুলে ধরেন।
সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্প শেষ করার কথা জানান। বলেন, “ঢাকায় মেট্রোরেল চালু করেছি, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে, পাতাল রেলের কার্যক্রম উদ্বোধন করেছি। রূপপুরে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করেছি। উদ্বোধন করা হয়েছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল। চট্টগ্রামে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম পাতাল সড়কপথ- বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ করেছি। কক্সবাজারে দৃষ্টিনন্দন রেলস্টেশন স্থাপন করে ঢাকা-কক্সবাজার রেল রুট চালু করেছি। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করা হয়েছে।”
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশের অর্থনীতির উৎকর্ষতার বিভিন্ন প্রেক্ষাপট তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “যারা সমালোচনা করেন- দুঃখের বিষয় যে, তারা সঠিক তথ্যটা জাতির সামনে তুলে ধরেন না। দেশের বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা তাদের চরিত্র। মনে হয়, বাংলাদেশের জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নতি দেখলে তারা বিমর্ষ হয়ে পড়ে।”
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার স্মৃতিচারণও করেন শেখ হাসিনা। সেই সময়ের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, অস্ত্র চোরাকারবারি, মানি লন্ডারিং, ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ, হাওয়া ভবনের দ্বৈত শাসনে জনজীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল।”
মেয়াদ শেষে ২০০৬ সালে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নির্বাচন দেওয়ার কথা থাকলেও বিএনপি-জামায়াত জোট তা না করে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে নানা ছলচাতুরির আশ্রয় নেয় বলে অভিযোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
ভুয়া ভোটারসমেত ভোটার তালিকা প্রণয়ন এবং আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন গঠনসহ সেসময় বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয় বলে উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা।
বলেন, “সামরিক বাহিনী অন্তরালে থেকে ক্ষমতা দখল করে। ইয়াজুদ্দীন, ফখরুদ্দীন, মইনুদ্দীনের এই সরকার জনগণের অধিকার হরণ করে তাদের উপর স্টিমরোলার চালানো শুরু করে। প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোকে ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নেয়। আমাকে এবং আমার দলের বহু নেতাকর্মীসহ অন্যান্য দলের নেতাকর্মীদের বন্দি করা হয়। ভিন্ন দল গঠন করার চেষ্টা করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেয়।
“কিন্তু এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে সচেতন দেশবাসী ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়ায়। জনগণের আন্দোলনের মুখে তারা নবম সংসদ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়।”
সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের নিরঙ্কুশ বিজয়ের কথাও তুলে ধরেন তিনি।
আগামী ৭ জানুয়ারি ভোটের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, “গণতন্ত্র ও আইনের শাসনে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলসমূহ এবং প্রতিষ্ঠানের প্রতি অনুরোধ, সাংবিধানিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় এমন কোনও উদ্ভট ধারণাকে প্রশ্রয় দেবেন না এবং ইন্ধন জোগাবেন না।”
২৪ মিনিট দীর্ঘ ভাষণের শুরুতেই দেশের মানুষকে খ্রিস্টীয় নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানান শেখ হাসিনা। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার-নেতা, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ও নির্যাতিত, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক ও গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কথা।
ভাষণে উঠে আসে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রসঙ্গ, ছোট বোন শেখ রেহানাসহ শরনার্থীর জীবন কাটানোর প্রসঙ্গ এবং ১৯৮১ সালে জনগণের সমর্থন নিয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসার প্রসঙ্গও।
দেশে ফিরেই জনগণের ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরু করেছিলেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এজন্য বার বার আমার উপর আঘাত এসেছে। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের লক্ষে সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি, বার বার গ্রেপ্তার হয়েছি। আমাকে অন্তত ১৯ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু আমি দমে যাইনি।”
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের দেওয়া ইশতেহারের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আজকে আপনাদের কাছে নৌকা মার্কায় ভোট চাইতে হাজির হয়েছি। এই উন্নয়নকে টেকসই করা, আপনাদের জীবন মান উন্নত করা, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত স্মার্ট সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ চাই।”
একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রত্যাশার কথা জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, “এই প্রথম বাংলাদেশে আইনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে আর্থিকভাবে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা নির্বাচন কমিশনের অধীনে ন্যাস্ত করা হয়েছে। সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করছে।”
সরকার সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনকে সব ধরনের সহযোগিতা দিচ্ছে বলেও জানান তিনি।
জাতির উদ্দেশে দেওয়া এই ভাষণে ফিলিস্তিনে গণহত্যার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থানও তুলে ধরেন তিনি। জানান, বাংলাদেশ সব সময় ফিলিস্তিনের জনগণের পক্ষে আছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুরো ভাষণ পড়ুন এখানে: