কবিতার জন্য নির্বাসন, বিশ্বে তা বেনজির নয়, তবে প্রসঙ্গ যখন বাংলাদেশ, তখন সবার আগে আসবে আসে যে নাম, তা হচ্ছে দাউদ হায়দার।
কবিতার জন্য নির্বাসন স্বাধীন বাংলাদেশে দাউদ হায়দারই প্রথম। নির্বাসিত সেই জীবন থেকে মুক্তি নিয়ে চলে গেলেন তিনি।
শনিবার জার্মানির রাজধানী বার্লিনে একটি প্রবীণ নিরাময় কেন্দ্রে দাউদ হায়দারের মৃত্যুর পর ফেইসবুক ভরে উঠেছে এই কবির জন্য শোকগাথায়। সেই স্মরণে উঠে আসছে একটি কবিতার জন্য নির্বাসিত এক জীবনের আখ্যান।
তখন ১৯৭৪ সাল; সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ। ওই বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি দৈনিক সংবাদের রোববারের সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছিল দাউদ হায়দারের কবিতা- কালো সূর্যের কালো জোৎস্নার কালো বন্যায়।
এই কবিতায় ইসলাম অবমাননা করা হয়েছে বলে তখন শোর তুলেছিল ইসলামী বিভিন্ন সংগঠন। দাউদ হায়দারের শাস্তির দাবিতে হরতালও ডাকা হয়।
পরিস্থিতি কেমন ছিল, তা বোঝায় যায় ১৯৭৪ সালের ১২ মার্চে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিবেদনটি পড়লে, যার শিরোনাম ছিল- ‘কবিতাটিকে কেন্দ্র করিয়া’।
তার আগের দিনই পাবনা শহরে হরতাল হয়, বিক্ষোভ মিছিল নামে দাউদ হায়দারকে গ্রেপ্তারের দাবিতে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এই পাবনায়ই দাউদ হায়দারের জন্ম হয়ছিল।
মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী নেতৃত্বাধীন ন্যাপের নেতা মশিউর রহমানের বিবৃতির খবরও ছিল সেই প্রতিবেদনে, যেখানে তিনি দাউদ হায়দারের শাস্তি দাবি করেন। মাদ্রাসা ছাত্র পরিষদের ব্যানারে দাউদ হায়দারের শাস্তির দাবিতে সমাবেশও হয়।
১২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও দাউদ হায়দারের বিরুদ্ধে ছাত্র-শিক্ষক ব্যানারে একটি প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছিল। সেদিন বায়তুল মোকাররম থেকে সংবাদ অফিসের দিকে মিছিলও গিয়েছিল দাউদ হায়দারকে গ্রেপ্তারের দাবি নিয়ে। সেই মিছিল থেকে হামলা হয়েছিল পত্রিকাটির কার্যালয়ে।
বায়তুল মোকাররমের সেই সমাবেশ নিয়ে বাংলার বাণীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল- ‘সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথাচাড়া দিয়া উঠিয়াছে’।
ইত্তেফাকের ১১ মার্চের প্রতিবেদনেই জানানো হয়, কবিতাটি প্রকাশের জন্য সংবাদ কর্তৃপক্ষ দুঃখ প্রকাশ করেছে। ক্ষমা চেয়েছেন দাউদ হায়দারও।
দাউদ হায়দারকে উদ্ধৃত করে ইত্তেফাকের সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল- “আমার উক্ত কবিতার জন্য আমি শুধু লজ্জিত ও বিব্রতই নই, পীড়িত ও অপরাধী বোধ করছি। ভবিষ্যতে কবিতাটি আমার কোনও গ্রন্থে আমি অন্তর্ভুক্ত করব না।”
তবে ঘটনার সেখানেই শেষ নয়। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে এক কলেজ শিক্ষক মামলা করার পর ১১ মার্চ দাউদ হায়দারকে সংবাদ অফিস থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তিনি তখন সংবাদের সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন।
তখন কবি তালিম হোসেন কবি দাউদ হায়দারের মুক্তির দাবি জানিয়েছিলেন বলে ইত্তেফাকের প্রতিবেদনে পাওয়া যায়।
ধারণা করা হয়, তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকার মুসলিম বিশ্বের সমর্থন হারানোর শঙ্কায় দাউদ হায়দারকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন।
১৯৭৪ এর ২০ মে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়ার পরদিনই দাউদ হায়দারকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কলকাতায়।
পরে দাউদ হায়দার বলেছিলেন, তখন তার হাতে ছিল মাত্র ৬০ পয়সা এবং কাঁধে ঝোলানো ব্যাগে ছিল কবিতার বই, দু’জোড়া শার্ট, প্যান্ট, স্লিপার আর টুথব্রাশ।
“আমার কোনও উপায় ছিল না। মৌলবাদীরা আমাকে মেরেই ফেলত। সরকারও হয়ত আমার মৃত্যু কামনা করছিল,” বলেছিলেন তিনি; জানিয়েছিলেন, কলকাতার দমদম বিমানবন্দরে নেমে কেঁদেছিলেন তিনি।
কলকাতায় সাংবাদিক-সাহিত্যিক গৌরকিশোর ঘোষের কাছে প্রথম আশ্রয় পান দাউদ। এরপর দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি হয়েছিলেন।
নির্বাসিত অবস্থায় ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান যখন ক্ষমতায়, ভারতে বাংলাদেশ দূতাবাসে নিজের পাসপোর্ট নবায়নের জন্য জমা দিেয়ছিলেন দাউদ। কিন্তু তা বাজেয়াপ্ত করলে পাসপোর্টবিহীন হয়ে পড়েন দাউদ।
তখন ভারতও তাকে রাখতে চাইছিল না। এসময় নোবেলজয়ী জার্মান সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাস ভারত সফরে গিয়ে বাঙালি কবি দাউদের কথা শুনে সহানুভূতিশীল হন। তার চেষ্টায় ১৯৮৭ সালে জার্মানি পাড়ি জমান দাউদ। তারপর থেকে বার্লিনেই ছিলেন তিনি। জার্মানিতে থাকাকালে ডয়চে ভেলে বাংলায় কাজ করতেন দাউদ হায়দার।
তার আগে এইচ এম এরশাদ বাংলাদেশে ক্ষমতায় বসার পর দাউদ হায়দার পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেছিলেন, কিন্তু তা ফেরত দেওয়া হয়নি এই বলে যে ‘এই ব্যক্তি বাংলাদেশের জন্য সন্দেহজনক’।
জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়ে বার্লিন যাওয়ার সময় জাতিসংঘের বিশেষ ট্রাভেল পাস ব্যবহার করেছেন দাউদ হায়দার। পরে সেই পাস ব্যবহার করেই বহু দেশ ঘুরেছেন। নির্বাসিত জীবনে প্রায় ৩০টির মতো বই লিখেছেন জার্মান, হিন্দি, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, জাপানি ও স্প্যানিশ ভাষায়।
দাউদ হায়দারের ভাইদের মধ্যে প্রায় সবাই সংস্কৃতি অঙ্গনের পরিচিত মুখ। তাদের মধ্য রয়েছেন- নাট্যকার জিয়া হায়দার, কথাশিল্পী রশীদ হায়দার, কবি মাকিদ হায়দার, জাহিদ হায়দার, আবিদ হায়দার ও আরিফ হায়দার।
৭৩ বছর বয়সে জীবন থেকে ছুটি নেওয়ার অর্ধ শতক আগে স্বদেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন দাউদ হায়দার। এরপর আর কখনও দেশে ফেরার সুযোগ তার হয়নি।
তবে দেশ নিয়ে তার হতাশা ফুটে ওঠে ২০০৫ সালে লেখা এক কবিতায়।
“দীর্ঘশ্বাস-ছাড়া তোমাকে আর কী দিতে পারি, দেশ?
অনিঃশেষ
ব্যথাবেদনায় কাতর হয়েছি আমি। আত্নঘাতী ভালোবাসা
হত্যা করেছে সমস্তা আকাঙ্ক্ষা ও আশা
যে-প্রেমে উদ্বুদ্ধ ছিলাম একদা, আজো আছি, কিন্তু দেশ
পরতে-পরতে তোমার মৃত্যুতে ছাড়ছি দীর্ঘনিশ্বেস
-তোমার মৃত্যুতে “