“এক স্বজনকে আটকের খবর শুনে যাত্রাবাড়ী থানায় গিয়েছিলাম। ঢোকার সময় প্রধান ফটকেই আমার নাম, পরিচয়, মোবাইল নম্বর, পেশা, থানায় আসার কারণ- সবকিছু জানাতে হলো। এরপর থানার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের পরই আমি ঢুকতে পেরেছি। থানায় ঢুকতে যত তথ্য দিতে হয়েছে, ক্যান্টনমেন্টে গেলেও এত প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় না।”
ঢাকা মহানগরীর যাত্রাবাড়ী থানার অভিজ্ঞতার কথা সকাল-সন্ধ্যার কাছে এভাবেই বলছিলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগী। তার এমন তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা শুনে সম্প্রতি যাত্রাবাড়ী থানা ও আশপাশ ঘুরে সেবাপ্রত্যাশীদের সঙ্গে এমন কড়াকড়ির চিত্র পাওয়া গেছে।
দেখা যায়, থানার প্রধান ফটকের ডান পাশে রয়েছে ছোট্ট একটা টেবিল। সেখানে ‘মোটাসোটা’ রেজিস্ট্রার খাতা নিয়ে বসে আছেন পুলিশের এক কনস্টেবল। কেউ থানায় ঢুকতে গেলে চেয়ারে বসেই তাকে ডাক দিচ্ছেন তিনি। পরে থানায় আসা ব্যক্তির বিস্তারিত লিখে ইচ্ছেমতো কাউকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছেন, কাউকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন।
এসময় অনুমতি ছাড়াও কয়েকজনকে অবাধে থানায় যাতায়াত করতে দেখা যায়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, তারা ‘যাত্রাবাড়ী থানার সোর্স’ বা দালাল চক্রের সদস্য। তবে যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ বলছে, সেবাপ্রত্যাশীদের নয়, দালাল চক্রের সদস্যদের রুখতেই নেওয়া হয়েছে এই পদক্ষেপ।
গত বুধবার দুপুর আড়াইটার দিকে যাত্রাবাড়ী থানার প্রধান ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন এক বৃদ্ধ। ফোনের অপর পাশে থাকা ব্যক্তিকে তিনি বলছিলেন, “স্যার আমার ছেলেকে মেরে ফেললে কি আপনি উদ্ধার করতে যাবেন? আমার ছেলেকে বাঁচান স্যার।”
এ সময় কাছে গিয়ে পরিচয় জানতে চাইলে নিজের নাম হায়াত আলী বলে জানান ওই বৃদ্ধ।
তিনি বলেন, গত কয়েকদিন ধরে তার ছেলে সাইফুল ইসলাম (১৮) নিখোঁজ। সে বিষয়ে থানায় জিডি করেছিলেন। এখন এসেছেন খোঁজ নিতে। কিন্তু থানার ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। তাই ফোন করেছিলেন জিডির তদন্ত কর্মকর্তাকে।
এর কিছুক্ষণ পরই যাত্রাবাড়ী থানার সামনে আসেন দুই যুবক। ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর ২টা ৫৫ মিনিট। তারা থানায় ঢুকতে গেলে প্রধান ফটকে তাদেরও পথ রোধ করা হয়। প্রধান ফটকের এক পাশে টেবিল-চেয়ার নিয়ে বসে থাকা এক কনস্টেবল ও দুই আনসার সদস্য থানায় ঢুকতে না দিয়ে তাদের ফিরিয়ে দেন।
ফিরে যাওয়ার পথে ওই দুই যুবকের কাছে থানায় আসার কারণ জানতে চায় সকাল সন্ধ্যা। তারা জানান, মোবাইল হারানোর জিডি করতে এসেছিলেন। কিন্তু ফটকে থাকা পুলিশ সদস্য ‘সার্ভার নষ্ট থাকায় জিডি হবে না’ বলে তাদের ফিরিয়ে দিয়েছেন। পুলিশের ‘হেনস্থার ভয়ে’ নিজেদের পরিচয় জানাতে রাজি হননি ওই দুই যুবক।
এ সময় সকাল সন্ধ্যার প্রতিবেদক পরিচয় গোপন রেখে এক পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করতে থানায় ঢোকার অনুমতি চান। তখন দায়িত্বরত ওই কনস্টেবল বলেন, “থানায় অনেক অফিসার আছেন। যার সঙ্গে দেখা করতে চান, তাকে ফোন দিয়ে গেটে আসতে বলেন। আপনি ভেতরে যেতে পারবেন না।”
গত বুধবার যাত্রাবাড়ী থানা এলাকায় কয়েক ঘণ্টা অবস্থান করে তার মতো সেবা নিতে আসা বেশিরভাগ মানুষকে এমন ভোগান্তির মুখে পড়তে দেখা যায়। সেদিন দুপুরে থানার ফটকে বসে থাকা সেই কনস্টেবল পুলিশের পোশাক পরা থাকলেও তার নেমপ্লেট ছিল না। এসময় সেবাপ্রত্যাশীরা তার বিভিন্ন প্রশ্নের মুখে পড়লেও ফটকের সামনে আড্ডা দেওয়া কয়েকজন যুবক বিনা বাধায় থানায় যাতায়াত করছিলেন। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তারা থানা পুলিশের সোর্স।
থানার পাশের এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, আগে কখনও যাত্রাবাড়ী থানায় ঢুকতে এমন নিয়ম তিনি দেখেননি। সংসদ নির্বাচনের আগে থানায় নতুন ওসি এসেছেন। তিনি আসার কিছুদিন পরই এই ‘সিস্টেম’ চালু হয়েছে।
অন্য কোনও থানায় দেখা যায়নি এই নিয়ম
গত বুধবার যাত্রাবাড়ী থানায় এমন পরিস্থিতি দেখার পর দুই দিন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) আওতাধীন ডেমরা, ওয়ারী, মোহাম্মদপুর, আদাবর, নিউ মার্কেট, বনানী, শাহবাগ, এয়ারপোর্ট, উত্তরা পশ্চিম ও পূর্ব থানায় ঘুরেছেন সকাল-সন্ধ্যার প্রতিবেদক।
ডিএমপির অন্য কোনো থানায় যাত্রাবাড়ী থানার মতো নিয়ম চোখে পড়েনি। এসব থানায় সেবাপ্রত্যাশীরা সরাসরি থানায় ঢুকে দায়িত্বরত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলছেন।
থানায় সেবাপ্রত্যাশীদের যাতায়াতের ক্ষেত্রে এমন কড়াকড়ির প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক থানার ওসি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ডিএমপি কমিশনার মহোদয় বারবার বলেছেন ‘থানা হবে জনতার। নগরবাসীর জন্য ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকবে থানার দরজা।’ আমি সেভাবেই সেবা দেওয়ার চেষ্টা করি। কেউ যদি এর ব্যতিক্রম করে সেটা তার ব্যক্তিগত বিষয়। ব্যক্তিবিশেষে সেবা দেওয়ার মানসিকতা থেকে এমন ভিন্নতা হতে পারে বলে আমার মনে হয়।”
এ বিষয়ে যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফরমান আলীর সঙ্গে কথা বলতে সোমবার তার সরকারি মোবাইল ফোন নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
একই নম্বরে মঙ্গলবার সকালেও একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করার পর ধরেন যাত্রাবাড়ী থানার ওসি (তদন্ত) আজহারুল ইসলাম। তিনি জানান, ওসি ফরমান আলী ছুটিতে আছেন।
থানায় সেবাপ্রত্যাশীদের প্রবেশে কড়াকড়ির বিষয়ে জানতে চাইলে আজহারুল ইসলাম বলেন, “যাত্রাবাড়ী থানাটি জনবহুল এলাকায়, চার রস্তার মোড়ে। সেজন্য থানার ভেতরে দালাল শ্রেণির লোকদের ভিড় লেগেই থাকত। এমনকি দালালরা থানার ভেতরে আড্ডাও বসাত।
“তারা থানায় আসা সেবাপ্রত্যাশীদের সঙ্গে প্রতারণার আশ্রয় নিত। জিডি বা অন্য কোনও সেবার কথা বলে সেবাপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের ঘটনাও ঘটাত দালালরা। দালালদের প্রবেশ ঠেকাতেই থানায় আগত ব্যক্তিদের পরিচয় লিপিবদ্ধ করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”
থানার ফটক থেকেই জিডির সেবাপ্রত্যাশীদের ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এমন ঘটনা ঘটার কথা নয়। গেইটে দায়িত্বপালন করেন একজন কনস্টেবল। জিডির সার্ভারের বিষয়ে তার তো জানার কথা নয়। তিনি কোনোভাবেই সেবাপ্রত্যাশীকে এ বিষয়ে বলতে পারেন না। জিডির বিষয়ে জানাবেন ডিউটি অফিসার।”
থানায় সেবাপ্রত্যাশীদের নিবন্ধনের বিষয়ে সকাল সন্ধ্যা কথা বলেছে ডিএমপির ওয়ারী জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইনের সঙ্গে।
তিনি বলেন, “আসলে নাম-ঠিকানা লিখে থানায় প্রবেশ করানো হতে পারে দুই কারণে। এক নম্বর হলো, সোর্সরা যেন প্রবেশ করতে না পারে। দুই নম্বর কারণ হতে পারে নিরাপত্তা।”
যাত্রাবাড়ী থানায় সোর্সদের অবাধ যাতায়াত ও প্রকৃত সেবাপ্রত্যাশীদের ভোগান্তির অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ডিসি বলেন, “তাহলে তো হাসপাতাল রোগী সুস্থ করতে নয়, রোগী মেরে ফেলতে করা হয়েছে। এমনটি হলে আমরা ব্যবস্থা নেব। ২৪ ঘণ্টা নগরবাসীর সেবা দেওয়ার জন্য থানা বানানো হয়েছে। গেট থেকে ফিরে যাওয়ার জন্য নয়।”
থানার ফটক থেকেই কর্তব্যরত কনস্টেবলের প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে জিডি না করেই ফিরে যেতে দেখা গেছে সেবাপ্রত্যাশীদের।
এ প্রসঙ্গে সকাল-সন্ধ্যার প্রশ্নের জবাবে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, “জিডি করতে এসে মানুষ ঘুরে যাবে, আর যাদের জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তারাই ছাড় পাবে- এটা মেনে নেওয়া যাবে না। সার্ভার নষ্ট এটি ডিউটি অফিসার বলবেন। গেটের দ্বায়িত্বরত কনস্টেবল কেন বলবেন? এটি কখনোই হতে পারে না।”
ঘরে ফিরেছেন হায়াত আলীর ছেলে
গত বুধবার দুপুরে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোনে আহাজারি করা সেই হায়াত আলীর ছেলে বাসায় ফিরছেন। হায়াত আলী সকাল সন্ধ্যাকে জানিয়েছেন, গত শুক্রবার তার ছেলে সাইফুল ইসলাম নিজেই বাড়িতে ফোন করেন চট্টগ্রাম থেকে। সাইফুলের মামা ইকবাল চট্টগ্রাম গিয়ে তাকে ঢাকায় নিয়ে এসেছেন।