ছেলে সাব্বিরের খোঁজে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতের গারদখানার সামনে অপেক্ষা করছেন সফুরা বেগম। রাজধানীর বিভিন্ন থানা থেকে যখন পুলিশের প্রিজনভ্যান ঢুকছে। তখনই ছুটে যাচ্ছেন সফুরা। ভ্যানের দুপাশে ঘুরে ঘুরে ‘সাব্বির-সাব্বির’ নাম ধরে ডাকছিলেন তিনি।
সফুরার মতো কয়েকশ মানুষকে রবিবার দুপুরে দেখা যায় পুরান ঢাকার আদালতপাড়ায় গারদখানার সামনে। ‘আপনি কাকে খুঁজছেন’- এই প্রশ্নে প্রথমে কিছুটা বিরক্ত হন মধ্যবয়সী এই নারী। পরে বলেন, ছেলেকে জামিন করাতে এখানে এসেছেন তিনি।
ঢাকার সাভারের বাসিন্দা সফুরা। স্বামী আক্কাসের সঙ্গে সাভার চৌরাঙ্গী মার্কেটের সামনে লেবুর শরবত বিক্রি করেন ছেলে সাব্বির (১৮)।
সফুরা বলেন, গত ২২ জুলাই সোমবার রাতে পুলিশ অভিযান চালায় তার এলাকায়। সাব্বিরসহ আরও পাঁচজনকে ধরে নিয়ে আসে। এরপর থানায় গিয়েও কোনও পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে পারেননি। এজন্যই আদালতে এসেছেন। তিনি শুনেছেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের আদালতে চালান করা হচ্ছে।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে গত সপ্তাহে সংঘাত-সহিংসতায় দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যুর পর এখন বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে ঢুকে পড়ে বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে বলে পুলিশের ভাষ্য। তাতে জড়িতদের ধরতে বিভিন্ন স্থানেই অভিযান চলছে পুলিশের, তাতে নির্দোষ অনেকেই ধরা পড়ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
সাব্বির এই আন্দোলন কিংবা ভাংচুর-অগ্নিসংযোগে ছিলেন না দাবি করে সফুরা বলেন, “আন্দোলনের সাথে যারা যুক্ত তাদেরকে না পেয়ে আমার নির্দোষ ছেলেকে কেন তারা ধরে নিয়ে গেল?
“আমার ছেলেকে এলাকার সবাই চেনে। আমার ছেলে কোনও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না। এগুলো বুঝেও না। কেন পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গেল, কিছুই বুঝতাছি না।”
এক পর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন এই নারী; বলেন, “আন্দোলনের সময় আমার ছেলেকে আমি বাড়ির বাইরে যেতে দিইনি। তারপর তো কারফিউ জারি হয়। ঘরে বসেও আমার পোলা নিরাপদ না।
“আমাদের মতো নিরীহ মানুষকে পুলিশ কি এদেশে থাকতে দেবে না? আমরা যাব কোথায়?”
জীবনে কখনও আদালতে আসেননি সফুরা। “আমার ছেলেদের জন্য কোনোদিন থানায়ও যেতে হয়নি। আজকে ছেলের জন্য এখানে আইসা বইসা আছি “
সফুরার পাশেই ছিলেন সালমা আক্তার। তার ভাই সুরুজ আলীকেও (৩০) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। শেরপুরের নালিতাবাড়ির এই দুই ভাই-বোন সাভারে একটি গার্মেন্টসে চাকরি করেন।
গত ২২ জুলাই সোমবার পুলিশ সাভারের বাসা থেকে সুরুজকে ধরে নিয়ে যায় জানিয়ে সালমা বলেন, এখনও ভাইয়ের খোঁজ পাননি তিনি।
সালমা বলেন, “কত কষ্ট করে গার্মেন্টসে চাকরি করে আমরা বেঁচে আছি। এই আন্দোলন গ্যাঞ্জাম করে লাভ কী আমাদের? আমাগো গরিববো কপালই হচ্ছে খারাপ। খারাপ কাজ না করেও আমরা খারাপ হয়ে গেলাম।
“যারা অন্যায় করেছে, তাদের না ধরে আমাদের মতো নির্দোষদের ধরে নিয়ে গেছে। আমার ভাই যদি কোনও অন্যায় করত, তাইলে মনডারে বুঝ দিতে পারতাম। এখন কেমনে বুঝ দিতাম।”
পুলিশ সুরুজের সঙ্গে মোট পাঁচজনকে ধরে নিয়ে যায় জানিয়ে সালমা বলেন, বাকিরা হোটেলের কর্মী। তাদের সঙ্গে আন্দোলনের কোনও সম্পর্ক নেই।
ঢাকার মহাখালীর ওয়ারলেস গেইটের এক নারী আদালতে এসেছিলেন তার স্বামীর জন্য। নিজের নাম প্রকাশ না করলেও স্বামীর নাম নাজমুল খান বলে জানান তিনি।
এই নারী বলেন, তার স্বামী পাঠাওয়ের মোটরবাইক চালক। গত ২২ জুলাই পুলিশ তাকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়।
“পরে পল্টন থানায় মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। এ মামলায় জামিন করাতে আজকে আমরা আদালতে আইছি।”
প্রিজনভ্যানে স্বামীর সঙ্গে কথা বলার সময় ভিড়ের মধ্যে নিজের স্যামসাং মোবাইল সেটটি খুইয়ে ফেলেন এই নারী। “কষ্টের মধ্যে আরেক কষ্ট,” বলেন িতনি।
হাফেজ শফিক বিন বাহাউদ্দিন (৩৫) নামে এক মাদ্রাসা শিক্ষকের স্ত্রী ও বোনও প্রিজন ভ্যানগুলোর সামনে ছিলেন স্বজনের খোঁজে।
ওই শিক্ষকের বোন বলেন, তার ভাই এ আন্দোলনের সময় একবারও বের হয়নি। এমনকি বাজার করতেও বের হয়নি। কিন্তু পুলিশ বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গেছে।
রিনা আক্তার নামে এক নারী এসেছিলেন ছেলে মাসুদ রানার (২৭) জন্য। সোমবার রাতে মাসুদকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ডেমরা থানায় নাশকতার মামলাও দেওয়া হয়েছে তার বিরুদ্ধে।
মাসুদ ডেমরা থানা ছাত্রদলের নেতা। আগের দুটি মামলায় তিনি জামিনে ছিলেন বলে জানান রিনা। তার দাবি, এবার আন্দোলনের সময় মাসুদ ঘর থেকেই বের হননি।
“কোটা নিয়ে গণ্ডগোলের সময় আমার ছেলে তিন দিন ঘরেই ছিল। বাইরে যায় নাই। তারপরেও পুলিশ মামলা দিল।”
গণঅধিকার পরিষদের গণমাধ্যম সম্পাদক আবু হানিফ ইউএস বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কাজ করেন। গত শুক্রবার নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ভুলতা গাউছিয়া এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। হানিফের বোন নিলুফাও ঢাকার আদালতের গারদ খানার সামনে এসেছিলে ভাইয়ের খোঁজে। তবে ভাইয়ের খোঁজ পাচ্ছিলেন না।
জাহিদ নামে একজনকে প্রিজন ভ্যানে খুঁজে পেয়েছিলেন তার স্বজনরা। তাকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন তার মা। ছেলেকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন- “বাবা তুমি টেনশন করিও না। প্রয়োজনে আমার সব বিক্রি করে দিব। তুমি টেনশন করিও না।”
স্বজনরা জানান, জাহিদের শ্বশুর বিএনপি করেন। তাকে ধরতে পুলিশ গিয়েছিল ২৩ জুলাই। কিন্তু তাকে না পেয়ে মেয়েজামাই জাহিদকে ধরে নিয়ে আসে।
জাহিদের বন্ধু শাহারুল ইসলাম বলেন, “আমরা একসঙ্গে সাইফুরসে আইইএলটিএস কোচিং করছিলাম। আমরা দেশের বাইরে চলে যাব। এজন্য ইংরেজি কোর্স করছিলাম। কয়েকদিন আগেও ওর সঙ্গে কথা হয়েছে। কিন্তু কী কারণে তাকে গ্রেপ্তার হলো, আমি নিজেও বুঝতে পারছি না।”
পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সহিংসতার ঘটনার ভিডিও দেখে চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। ঢাকায় ২০৭টি মামলায় শনিবার পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২৫৩৬ জনকে।
তবে এই সময়ে নির্দোষ অনেককে গ্রেপ্তার এবং গ্রেপ্তার বাণিজ্যও চালানোর অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে।
যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ ১৭ বছর বয়সী এক কলেজছাত্রকে গ্রেপ্তার করার পর শনিবার রশি বেঁধে আদালতে পাঠিয়েছিল। তাকে রিমান্ডেও পাঠিয়েছিলেন বিচারক। তবে ব্যাপক সমালোচনা ওঠার পর তার রিমান্ডে বাতিলের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট।
তবে অভিযোগ অস্বীকা করে ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র উপকমিশনার (মিডিয়া) ফারুক হোসেন বলেন, “সুনির্দিষ্ট মামলা ও তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। সন্দেহের ভিত্তিতে কাউকে আটক করলেও তথ্য যাচাইয়ের পর তাদের ছেড়ে দেওয়ার ঘটনাও আছে। প্রমাণ ছাড়া গ্রেপ্তারের অভিযোগ সঠিক নয়।”
রবিবার ঢাকার হাকিম আদালত থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ১২ জনকে রিমান্ডে পাঠানো হয়। ১৩১ জনকে পাঠানো হয় কারাগারে।
এরমধ্যে মিরপুরের কাজীপাড়ায় মেট্রোরেল স্টেশনে হামলা, ভাঙচুরের অভিযোগে রাজধানীর কাফরুল থানার মামলায় বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার এবং ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরসহ আটজনের পাঁচ দিনের রিমান্ডের আদেশ হয়।