ঢাকার স্পর্শকাতর এলাকা কূটনীতিক পাড়ায় এক পুলিশ সদস্যের গুলিতে আরেকজনের প্রাণ হারানোর ঘটনা নিয়ে দেশজুড়ে চলছে আলোচনা। গুলিবর্ষণকারী পুলিশ সদস্যের মানসিক ভারসাম্যহীনতার খবর প্রকাশের পর উঠেছে আরও প্রশ্ন।
মানসিক চাপের মধ্যে থাকা একজন ব্যক্তির হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে তাকে আবার কূটনীতিক পাড়ার মতো এলাকায় দায়িত্বে পাঠানো কতটা সঙ্গত ছিল- এই প্রশ্নের পাশাপাশি এমন প্রশ্নও আসছে, বাংলাদেশ পুলিশে বাহিনীর সদস্যদের মানসিক সুস্থিতির দিকে কতটা মনোযোগ দেওয়া হয়?
জানতে চাইলে পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার উত্তর আসে, “কিচ্ছু নেই, কিচ্ছু নেই, একদমই নেই। কাউন্সেলিং, মানসিক অসুস্থতা, মানসিক চিকিৎসা- এগুলো নিয়ে কোনোদিন কোনও কথাই শুনিনি। কেউ এগুলো নিয়ে কোনও কথা বলে না।”
পুলিশে যোগ দেওয়ার সময় দেহের দৈর্ঘ্য-প্রস্থের নানা শর্ত পূরণ করতে হয়। এরপর দৈহিক সামর্থ্য ধরে রাখতে প্যারেডে জোর দেওয়া হলেও চাপের এই পেশায় মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কোনও নজর নেই বলে বাহিনীর সদস্যদের কাছ থেকে বক্তব্য এলেও পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্রের দাবি, তাদের ‘সিলেবাসে’ এসব বিষয় আছে।
নানা পেশার মধ্যে পুলিশের কাজটি চাপের বলে স্বীকৃত। এই বাহিনীতে কাজ করতে গিয়ে মানসিক চাপে থাকার বিষয়টি নানা জরিপেও আসছে। মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতদিন উপেক্ষা করা হলেও এখন এদিকে মনোযোগ দেওয়ার সময় এসেছে।
পুলিশের অস্ত্রের ভিন্ন ব্যবহার আগেও ঘটেছে
পুলিশের হাতে আগ্নেয়াস্ত্রটি দেওয়া হয় নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যবহারের জন্য। কিন্তু সেই অস্ত্রে পুলিশ সদস্যদের মারা যাওয়ার ঘটনা কম নয়।
২০২৩ সালের ৪ আগস্ট পারিবারিক কারণে নিজের রাইফেল দিয়ে মাথায় গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন ফিরোজ আহমেদ নামের এক কনস্টেবল। ওই বছরের ২৫ মে বনানীতে পুলিশ চেকপোস্টে দায়িত্ব পালনের সময় নিজের পিস্তলে আত্মহত্যা করেন আশরাফুজ্জামান রনি নামে আরেক সদস্য।
২০২২ সালে মাগুরায় দুই পুলিশ সদস্যের আত্মহত্যা আলোড়ন তুলেছিল দেশজুড়ে। তাদের একজন গলায় ফাঁস দিলেও অন্যজন নিজের শটগানের গুলি চালিয়েছিলেন নিজের দেহে।
২০২৩ সালে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন রাঙামাটিতে কর্মরত পুলিশ সদস্য মোতাহার হোসেন। তার আগে তিনি ফেইসবুক লাইভে এসে বলেছিলেন, “আমার লাইফে প্রচুর ডিপ্রেশন রয়েছে। তাই বেঁচে থাকার আশা হারিয়ে ফেলেছি।”
২০২১ সালের ১৫ জুলাই রাঙামাটিতে কনস্টেবল কাইয়ুম সরকার নিজের অস্ত্র দিয়ে নিজের মাথায় গুলি চালিয়ে মারা যান। ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি ঢাকার মিরপুর পুলিশলাইন্সে আবদুল কুদ্দুস নিজের রাইফেল দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তার আগে ফেইসবুকে তিনি লিখে যান- “আমার মৃত্যুর জন্য কাউকে দায়ী করব না। আমার ভেতরের যন্ত্রণাগুলো বড় হয়ে গেছে, আমি আর সহ্য করতে পারছি না।”
এবার যা ঘটল
ফিলিস্তিন দূতাবাসের সামনে গত শনিবার প্রহরারত দুই পুলিশ সদস্যের একজন কাউসার আলী তার রাইফেল দিয়ে গুলি চালিয়ে হত্যা করেন সহকর্মী মনিরুল ইসলামকে। কনস্টেবল মনিরুল ও কাউসারের মধ্যে কোনও বিষয় নিয়ে তর্কাতর্কি হয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। এরপরপরই নিজের হাতে থাকা সাবমেশিনগান দিয়ে গুলি করেন কাউসার।
সিসি ক্যামেরার এক ভিডিওতে দেখা গেছে, নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে সহকর্মীর দেহে একের পর এক গুলি চালিয়ে যাচ্ছেন কাউসার। মনিরুলের নিসাড় দেহেও গুলি চালানো থামাননি তিনি।
ঘটনা শোনার পর সেখানে গিয়ে পুলিশ প্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন সাংবাদিকদের বলেন, কনস্টেবল কাউসার উন্মাদের মতো এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়েছে।
মনিরুলের ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া দেহে মোট ৩৮টি গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে।
ভিডিওতে দেখা গেছে, মনিরুলের নিষ্প্রাণ দেহ যখন পড়েছিল, তখন তার চাইনিজ রাইফেলটি নিয়ে ফুটপাতে এসে কাউসার পাশের দেয়ালেও আঘাত করেন। এরপর কিছুক্ষণ ওই অস্ত্রটি ফুটপাথে রেখে নিজের অস্ত্র নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে ঘাড়ে নেন কাউসার। পরে ফুটপাতে দাঁড়িয়েই লাশের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন।
কাউসারের গুলিতে সাজ্জাদ নামে একজন পথচারীও আহত হন। তিনি পুলিশকে বলেন, তিনি এ পথ দিয়ে যাওয়ার সময় উপুড় হয়ে থাকা পুলিশ সদস্যকে দেখে কাউসারের কাছে কারণ জানতে চেয়েছিলেন। তখন তাকেও গুলি করেন কাউসার।
গুলশান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শাহনুর রহমান পরে জানান, ঘটনার পরপরই গ্রেপ্তার করা হয় কাউসারকে। তবে তিনি দাবি করেন যে গুলির ঘটনার কিছুই তার মনে নেই।
মানসিক সমস্যা থেকেই কি গুলি
ঘটনার পর পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, মানসিক সমস্যার কারণেই কাউসার তার সহকর্মীকে গুলি করেন বলে তাদের ধারণা।
“সম্ভবত মানসিক সমস্যার কারণে আমাদের এক কনস্টেবল আরেকজনকে গুলি করেছে,” তখন বলেছিলেন গুলশান থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) খ মহিদ উদ্দিন ঘটনার পরদিন রবিবার সাংবাদিকদের বলেন, কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে কনস্টেবল কাউসার গুলি ছুড়েছিল। তার কাছে মনে হয়েছে যে কাউসার মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিল।
পাবনায়ও চিকিৎসা নেন কাউসার
পুলিশে যোগ দেওয়ার পর কাউসার আলী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে পাবনার মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছিলেন।
কাউসার কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলা সদর ইউনিয়নের দৌলতখালী দাড়ের পাড়া এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়াত আলীর মাস্টারের ছোট ছেলে। ২০০৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর তিনি কনস্টেবল হিসাবে পুলিশে যোগ দেন।
তার প্রতিবেশী দৌলতপুর সদর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, কাউসার চাকরিতে যোগ দেওয়ার পাঁচ বছর পর মানসিক রোগে আক্রান্ত হন। তখন তার চিকিৎসা করানো হয়। সুস্থ হলে আবার চাকরিতে যোগ দেন তিনি।
কাউসারের স্ত্রী নিলুফার ইয়াসমিন সাথী বলেন, খাগড়াছড়ি জেলায় চাকরি করার সময় কাউসারের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। তখন তিনি পালিয়ে বাড়ি চলে আসেন। এরপর পাবনার হেমায়েতপুরের সরকারি মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল তাকে। সেখানে চিকিৎসা নিয়ে তিনি স্বাভাবিক হয়ে ওঠেন।
১৪ মাস বাড়িতে কাটিয়ে চাকরিতে ফিরলেও মাঝে মধ্যে কাউসারের ‘মাথায় সমস্যা’ হত বলে জানান তার স্ত্রী।
তখন কেমন আচরণ করতেন- জানতে চাইলে সাথী বলেন, “ঝামেলা করত। থালা-বাসন ছুড়ে ফেলত।”
কাউসার এক সময় মাদক সেবন করতেন বলেও জানান তার স্ত্রী।
কাউসার ঠিক কী কারণে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন জানতে সকাল সন্ধ্যা যোগাযোগ করে পাবনা মানসিক হাসপাতালের পরিচালক ডা. শাফকাত ওয়াহিদের সঙ্গে।
তিনি বলেন, “আমি এ সম্পর্কে জানি না, আপনার কাছেই প্রথম শুনলাম।”
কাউসার ২০১০ সালের দিকে ভর্তি ছিলেন জানালে ডা. শাফকাত বলেন, “সে সময় আমি দায়িত্বে ছিলাম না। অনেক আগের কথা। এগুলো তো রেকর্ডে চলে যায়, রেকর্ড দেখে হয়ত পরে জানাতে পারব।”
কাউসারের মা মাবিয়া খাতুন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “২০১০ সালে পাহাড়ে (খাগড়াছড়ি) যখন সে ছিল, তখন থেকে তার মেন্টাল সমস্যা হয়। সেখান থেকে আমাদের জানালে আমরা গিয়ে নিয়ে আসি। এরপর সরকারিভাবে পাবনা হাসপাতালে তারে ভর্তি করা হয়।”
মাবিয়া জানান, চার মাস পাবনায় থাকার পর কাউসারকে বাড়িতে আনা হয়েছিল। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন না হলে দৌলতপুর থানা থেকে পুলিশ এসে তাকে আবার পাবনায় নিয়ে গিয়েছিল।
সাথী বলেন, তার স্বামীর চিকিৎসা হয়েছে সরকারিভাবেই। পুলিশ নিয়ে যেত, আবার পুলিশই ফিরিয়ে নিয়ে আসত।
কাউসার যেসব ওষুধ সেবন করতেন, সেসবের যত খালি পাতা বাড়িতে ছিল, তা রবিবার সন্ধ্যায় দৌলতপুর থানা থেকে পুলিশ এসে নিয়ে যায় বলে জানান সাথী। তিনি বলেন, তার ছেলে মোবাইল ফোনে ওষুধের ছবি তুলে রাখলে সেই ছবিও মুছে দেয়।
কাউসার কী কী ওষুধ খেতেন মনে আছে কি না- জানতে চাইলে সাথী কেড্রিন, হেলোপিড, অলিয়াঞ্জ, ডিসোপ্যান, লিথোসানের নাম বলেন। তিনি জানান, পাবনার হাসপাতাল থেকে এই ওষুধগুলো দেওয়া হয়েছিল।
কেড্রিন, হেলোপিড, অলিয়াঞ্জ, ডিসোপ্যান, লিথোসান সাধারণত সিজোফ্রেনিয়া অথবা বাইপোলার বা সাইকোসিস রোগীদের দেওয়া হয় বলে জানান মানসিক রোগ চিকিৎসকরা।
এই ওষুধগুলোর নাম শোনার পর এক চিকিৎসক বলেন, “তাইলে তো গুরুতর রোগ ছিল। এর হাতে অটোমেটিক রাইফেল? সহকর্মী বা রিপোর্টিং বস কেন বুঝল না, সেটা আমি বুঝতে পারছি না।”
কাউসারের মা মাবিয়ারও একই প্রশ্ন- “আমার ছেলে মেন্টাল, তার হাতে তাইলে কেন অস্ত্র দিল? ভিআইপি জায়গায় ডিউটি দিছিল, কেন দিছিল? ওর হাতে যদি অস্ত্র না থাকত, তাইলে তো সে মারতে পারত না।”
ডিএমপির এক কর্মকর্তা বলেন, পুলিশ বিভাগে এমন অনেক জায়গা রয়েছে, যেখানে অস্ত্র হাতে রাখতে হয় না। বিষয়টি বুঝতে পারলে কাউসারকে তেমন কোথাও দায়িত্ব দেওয়া যেত।
কত চাপে পুলিশ সদস্যরা
মনোরোগ চিকিৎসকরা বলছেন, কেবল পুলিশ নয়, যারা বিভিন্ন পেশায় বিশেষ করে চাপের মধ্যে থেকে কাজ করেন, তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষার বিষয়টি ভীষণ জরুরি।
জন ভায়োলান্টি একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ‘পুলিশ স্ট্রেস’ বিশেষজ্ঞ। নিউ ইয়র্ক স্টেট পুলিশ বিভাগে ২৩ বছর চাকরির পর তিনি পুলিশের মানসিক চাপের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন। ২০১২ সালে তিনি এবং তার দুজন সহকর্মী মিলে প্রকাশ করেন ‘পুলিশ সুইসাইড’ নামের বিখ্যাত বই।
বইতে তারা বলেছেন, অন্য অনেক পেশার চাইতে পুলিশ পেশায় থাকা ব্যক্তিরা বেশি চাপে থাকেন। এর কারণ নানা সহিংসতা, ট্রমা, অফিস কর্মঘণ্টাসহ নানা কিছু।
২০০২ সালে পুলিশ সদর দপ্তর একটি জরিপ করে কনস্টেবলদের নিয়ে। তাতে দেখা যায়, ২৩ শতাংশ কনস্টেবল কর্মঘণ্টানিয়ে অসন্তুষ্ট। পরিবারকে দেওয়ার সময় না পাওয়াকে চাকরির বড় সমস্যা হিসাবে দেখেন ১২ শতাংশ। এসআইদের ক্ষেত্রে এই হার ২১ দশমিক ২২ শতাংশ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পুলিশ সদস্য জানান, কাগজে-কলমে আট ঘণ্টার ডিউটি হলেও কখনও কখনও তা ১২-১৫ ঘণ্টায় গিয়ে ঠেকে।
এ বছরের ১৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসভিত্তিক পিয়ার রিভিউ জার্নাল বায়োরেস সায়েন্টিয়াতে ‘অ্যাটিওলজি অব স্ট্রেস অ্যামং পুলিশ ফোর্সেস’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত আইজি (এসবি) মনিরুল ইসলাম এবং পুলিশ স্টাফ কলেজ বাংলাদেশের পরিচালক মোহাম্মদ শাহাজাহান।
তাদের গবেষণাপত্রে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের চাপের কারণ হিসাবে বেরিয়ে এসেছে- পদোন্নতি ঠিক সময়ে না হওয়া, সাধারণ মানুষের নেতিবাচক মনোভাব, মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার পর্যাপ্ত সুবিধা না থাকা, বিনোদনের অভাব, কাজের একঘেয়েমি, পরিবারের জন্য পর্যাপ্ত সময় না পাওয়া, ছুটির অভাব, কর্মরত সময়ে খাবারের সমস্যা, নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা না থাকা, অতিরিক্ত কাজের চাপ ইত্যাদি।
এছাড়া রাজনৈতিক কারণেই পুলিশের চাপ বেড়ে যাওয়ার কথা বলেন পুলিশ সদস্যরা।
নিউ ইয়র্ক পুলিশ বিভাগে তাদের সদস্যদের শারীরিকের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার ওপর জোর দিয়ে থাকে। সেখানে বলা হয়, “আপনি নিউ ইয়র্ক পুলিশ বিভাগে কাজ করেন মানে হলো, আপনি নাগরিকদের সহযোগিতা করতে দিনাতিপাত করছেন। অন্যদের সেই সহযোগিতা করতে হলে আগে আপনার নিজেকে ভালো থাকতে হবে।”
পাশের দেশ ভারতেও পুলিশের মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষ গুরুত্ব পায়। চলতি বছরেই পুলিশে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীর মানসিক স্থিতি, ব্যক্তিত্ব যাচাই করার সুপারিশ করেছে দেশটির ব্যুরো অব পুলিশ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট– বিপিআরডি।
সুপারিশে ‘একান্ত প্রয়োজন’ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, “পুলিশ সদস্যদের নানা রকম মানসিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এই সমস্যা দূর করতে মানসিক স্থিতাবস্থা যাচাই একান্ত জরুরি।”
কাউসারের ঘটনা এবিষয়টিতে বাংলাদেশ পুলিশের অবহেলার নজির হিসাবে দেখছেন মনোরোগ চিকিৎসকরা।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কাউসারের সহকর্মী, ঊর্ধ্বতনরা যদি মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন থাকতেন, তাহলে হয়ত তারা বুঝতে পারতেন।
“মানসিক সমস্যা কেমন হতে পারে, কী কী লক্ষণ থাকলে সেটা আমলে নিতে হবে, সেটা চিহ্নিত করতে হবে এবং সে প্রক্রিয়াও জরুরি। তার (কাউসার) ইমিডিয়েট সিনিয়ররা যদি বুঝতেন বিমর্ষ, চুপচাপ থাকা, এগুলো মানসিক সমস্যার লক্ষণ, তাহলে কাউসারকে নিয়ে ভিন্নভাবে চিন্তা করার সুযোগ পাওয়া যেত।”
কোভিড মহামারির সময়ে পুলিশ সদস্যদের মানসিক অবস্থা নিয়ে ছোট পরিসরে কাজ করেছিলেন ডা. হেলাল উদ্দিন।
তিনি মনে করেন, কেবল পুলিশই নয়, যারা নানা ধরনের মানসিক চাপ নিয়ে কাজ করেন, যেমন ফায়ার সার্ভিস, সাংবাদিক, পাইলট, গাড়িচালক, চিকিৎসক, নার্স এমন সব পেশায় ‘ইন সার্ভিস’ মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি অর্ন্তভুক্ত করা দরকার।
“তাহলে কেবল হোমিসাইড নয়, সুইসাইডও প্রতিরোধ করা যায় এবং এটা এই অস্থির সময়ে ভীষণ জরুরি।”
পুলিশে আছে কি কিছু
চাপে থাকা অন্য পেশার চেয়ে পুলিশের বিষয়টি কিছুটা আলাদা। কারণ তাদের হাতে মারণাস্ত্র থাকে, যা অন্যের প্রাণ হরণের ঝুঁকিও তৈরি করে।
বাহিনীর সদস্যদের মানসিক সমস্যার সমাধানে পুলিশ বাহিনীতে কী আছে, তা জানতে কর্মকর্তাদের অনেকের সঙ্গে কথা বলেও সুনির্দিষ্ট কিছু পাওয়া যায়নি।
পুলিশ সদস্যদের জন্য বিশেষায়িত পুলিশ হাসপাতালে নেই মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং এ সংক্রান্ত কোনও বিভাগ, নেই কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা।
পুলিশ হাসপাতালে কল করা হলে সেখানকার নিয়ন্ত্রণ কক্ষে ফোন ধরেন মো. শামীম নামের একজন। তিনি বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যের কোনও ব্যবস্থা এখানে নেই, কোনও রোগীও ভর্তি করা হয় না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালসহ সারা দেশে পুলিশের যত চিকিৎসালয় আছে, কোথাও মানসিক স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া হয় না। পুলিশ কর্মকর্তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সমর্থন দেওয়ার জন্য কোনও আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থাই নেই।
“এটা নিয়ে কেউ চিন্তাই করে না। এটা তো সবচেয়ে সেনসিটিভ সার্ভিসগুলোর একটি, সেখানে ‘মানসিক স্টেবিলিটি’ না থাকলে, নিজের মানসিক সামর্থ্য না থাকলে কীভাবে হবে?”
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মহিদ উদ্দিন গত রবিবার সাংবাদিকদের প্রশ্নে বলেন, “প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমাদের কাউন্সেলিংয়ের সিস্টেম নেই। তবে নিয়মিত ব্রিফিংগুলোতে কী করা যাবে, কী করা যাবে না; সে সম্পর্কে বলা হয়। এটাও এক ধরনের কাউন্সেলিং।”
পুলিশ সদস্যদের মানসিক স্বাস্থ্যর সুরক্ষায় বাহিনী থেকে কোনও পদক্ষেপ হয় কি না- জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স) এসপি ইনামুল হক সাগর সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “যখন রিক্রুটমেন্ট হয়, তখন এগুলো দেখা হয়, এগুলো রয়েছে।
“সিলেবাসে রয়েছে, আক্ষরিক অর্থেই রয়েছে। বিষয়গুলো দেখা হয় এবং আলোচনা হয়। বিভিন্ন সময় এনিয়ে তাদের ব্রিফিংও করা হয়ে থাকে। টাইম টু টাইম তাদেরকে ডু এবং ডোন্টস অর্থাৎ তারা কী করতে পারবে এবং কী করতে পারবে না, সে নিয়ে কথা বলা হয়।”
পুলিশ হাসপাতালে মানসিক স্বাস্থ্য সেবার কোনও সুযোগ নেই- তা জানানো হলে ইনামুল বলেন, “এটা তো আপনি কথা বলেছেনই, এনিয়ে আমার কোনও বক্তব্য নেই।”
এদিকে ভাইর মৃত্যুর ঘটনায় মনিরুলের বড় ভাই গুলশান থানায় হত্যা মামলা করেছেন, কাউসারকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে সেই মামলায়।
ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) রিফাত রহমান জানিয়েছেন, কেন তিনি এই কাণ্ড ঘটালেন, তা জানতে কাউসারকে সাত দিন হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছে আদালত। এই ঘটনার তদন্তে রিফাত রহমানকে প্রধান করে ৩ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে ডিএমপি।
মহিদ উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, “সহকর্মীর গুলিতে পুলিশ নিহতের এ ঘটনা গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। ঘটনার কারণ ছাড়াও কয়েকটি বিষয় অনুসন্ধান করবে তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটিকে সাতদিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।”
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন সকাল সন্ধ্যার আঞ্চলিক প্রতিবেদক জহুরুল ইসলাম]