রাত সাড়ে ১২টা; বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা সীমান্তের কালাচাইন্দা সড়কে সারি বেঁধে চলছে একপাল গরু। গরুগুলো এসেছে মিয়ানমার থেকে, তবে এগুলোর গলায় বাঁধা দড়ি স্থানীয়দের হাতে। গরু আনা এই ব্যক্তিদের কারও কারও মুখ কাপড়ে ঢাকা। কেউ অবশ্য মুখ খোলা রেখেই গরুগুলো টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছেন।
গরুগুলো যাতে ছুটে না যেতে পারে, সেজন্য সবার হাতে একটা করে লোহা বা কাঠের লাঠি। কারও কারও হাতে আগ্নেয়াস্ত্রও রয়েছে। সারিবদ্ধ গরুগুলোকে কিছু দূর নেওয়ার পর তুলে দেওয়া হচ্ছে ট্রাকে। এই ট্রাকগুলো আগে থেকে দাঁড়িয়ে ছিল গরুর অপেক্ষায়।
এই দৃশ্য দেখলে যে কারোরই মনে হবে, কোরবানির গরুর হাট তো মধ্যরাতে বেশ জমে উঠেছে! কিন্তু গরুগুলো ভালো করে দেখলে মনে সন্দেহ জাগবে। দেশি গরুর মতো এগুলো তেমন স্বাস্থ্যবান নয়।
ট্রাকে তোলা এই গরুগুলো মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে আনছে স্থানীয় চোরাকারবারি চক্র। কোরবানির ঈদ সামনে রেখে তাদের গরু পাচার ফুলে-ফেঁপে উঠছে।
অভিযোগ আছে, এই চক্রের নেতৃত্বে আছে পুলিশেরই একাধিক সোর্স। গরু পাচারের সময় আটকাতে গেলে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যদের দিকে গুলি ছুড়তেও দ্বিধা করছে না এই চোরাকারবারিরা।
স্থানীয় বাসিন্দা কলিমউল্লাহ মো. সোহেল সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “রাত যত বাড়ে, খাল থেকে শুরু করে বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে গরু-মহিষ আমাদের দেশে ঢোকায় চোরাকারবারি সিন্ডিকেট।
“বিজিবি বাধা দিতে গেলে তারা তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এলাকার প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের সদস্যরা দিনকে দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে।”

কেবল কালাচাইন্দা সড়ক নয়, সীমান্তের নাইক্ষ্যংছড়ির বাম হাতিরছরা, ফুলতলী, চাকঢালা, লম্বাশিয়া, ভাল্লুক খাইয়া, দৌছড়ি, তুমব্রু, বাইশফাঁড়ি, আশারতলী, জামছড়ি, বম্বনিয়া এবং কক্সবাজারের রামু উপজেলার হাজিরপাড়া ও মৌলভীরকাটা দিয়েও একইভাবে চোরাইপথে গরু আনছে এই চক্র।
সীমান্তের বাসিন্দাদের অভিযোগ, কোরবানি ঈদকে সামনে রেখে ৯ ব্যক্তির নেতৃত্বে দুইশর বেশি চোরাকারবারি প্রতিদিন সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে শত শত গরু-মহিষ দেশে আনছে। ট্রাকে করে গরুগুলো পাঠানো হচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়।
রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সীমান্তে চেরাকারবারি চক্রের তৎপরতা বাড়তে থাকে জানিয়ে ইজিবাইক চালক মো. রফিক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “রাত ৮টার পর, বিশেষ করে ১০টা বা ১২টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত এসব পশু দেশে ঢোকানো হচ্ছে। এখান থেকে তাদের ঈদগাঁ ও চকরিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়।”
যেভাবে হাটে যাচ্ছে চোরাই গরু-মহিষ
রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশে আনা গরু-মহিষ হাটে তোলার পর তা বৈধ করে নিয়েই দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠাচ্ছে চোরাকারবারি চক্র।
কৌশলটি হলো, এসব চোরাই গরু ও মহিষ আনার পর দেশের হাটবাজারের ইজারাদার থেকে রশিদ নেওয়া হয়। এরপর দেশের খামারির বলে দেশের বিভিন্ন স্থানে দেওয়া হয় চালান।
স্থানীয়রা জানায়, সীমান্তের ওপারের পাচারকারীরা দেশের এই চোরকারবারি চক্রকে প্রতি গরু বা মহিষে ২ হাজার টাকা করে দেয়। পাচারকারীদের এরপর বিশেষ টোকেন দেওয়া হয়।
এই টোকেন বাজার ইজারাদারের হাতে পৌঁছলে ইজারাদার টোল দেওয়ার রশিদ চোরাকারবারি চক্রকে দেয়। এতে মিয়ানমারের গরু হয়ে হয়ে যায় দেশের গরু।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন গরু ব্যবসায়ী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বেপারীরা আসে গর্জনিয়া বাজারে। কারণ মিয়ারমার থেকে আসা গরু-মহিষ অনেক কম দামে পাওয়া যায়। নিতেও সুবিধা।
একজন বলেন, “পুলিশকে দুই হাজার টাকা দিলে বাজারে গরুগুলো হাটে তুলে শুধু ইজারার রশিদটা নেওয়া হয়। এখানে পুলিশের সোর্স আর ইজারাদার মিলে সিন্ডিকেট করেছে। তাদের কথার বাইরে গেলে হাট থেকে গরু দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যেতে পারে না।”
পুলিশের সোর্সরাই পাচারে
অভিযোগ আছে, এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন গর্জনিয়ার মোহাম্মদ সোহেল, কচ্ছপিয়ার হাজিরপাড়া গ্রামের মো. এরশাদ উল্লাহ, আনোয়ার হোসেন রাসেল, একই ইউনিয়নের দৌছড়ি দক্ষিণকুল গ্রামের ফরিদুল আলম, কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ মৌলভীকাটার ইয়াছিন আরাফাত রিসাদ, ফাক্রিকাটা এলাকার নুরু, দক্ষিণ দৌছড়ীর আব্দুর রহিম, হাজী পাড়ার নুরুল আলম ও একই গ্রামের আবু তালেব।
এরা সবাই এলাকায় পুলিশের সোর্স হিসাবে পরিচিত। একই সঙ্গে চক্রটি গর্জনিয়া বাজারের ইজারাদারও। স্থানীয়রা তাদের সম্পর্কে প্রকাশ্যে কথা বলতে রাজি নন। কারণ কথা বললে হয় হামলা নয়ত মামলা দিয়ে হয়রানির শিকার হতে হয়।
মোহাম্মদ সোহেল অবশ্য তার বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “পুলিশের নাম নিয়ে আগে গরু প্রতি ২০০০ টাকা করে তুলতাম আমি। এখন না। এখন অন্য কেউ টাকা তুলছে।”
সোহেলের টাকা নেওয়ার প্রমাণ সকাল সন্ধ্যার প্রতিবেদকের কাছে আছে জানানো হলে তিনি এনিয়ে আর কথা না বাড়াতে চাননি। তিনি পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।
পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “যদি পুলিশের নামে কেউ টাকা তুলেছে এমন প্রমাণ মিললে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একাজে যদি পুলিশের কেউ জড়িত থাকে, তাহলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
চোরাকারবারি চক্রের সঙ্গে জড়িত কি না- এই প্রশ্নে পুলিশের আরেক সোর্স আনোয়ার হোসেন রাসেল সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমি কাঠ ব্যবসায়ী। কচ্ছপিয়া বাজার ইজারার সঙ্গে যুক্ত। চোরাচালানের সঙ্গে আমি কোনোভাবে জড়িত নই। আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।”
আরেক সোর্স কচ্ছপিয়ার হাজিরপাড়া গ্রামের মো. এরশাদ উল্লাহসহ কয়েকজনের মোবাইল ফোনে কয়েকবার কল করেও তাদের কারও সাড়া পাওয়া যায়নি।
পাচারে আরাকান আর্মি
সীমান্তবাসী বাংলাদেশিদের অভিযোগ, মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সঙ্গে লড়াইরত সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সদস্যরাই গরু-মহিষ ও মাদকদ্রব্য পাচারে জড়িত। গড়ে ৫০০ টাকা করে ঘুষ দিলে তারাই পাচারে সহায়তা করছে।

এসব পাচার ঠেকাতে গিয়ে বিজিবির সঙ্গে চোরাকারবারিদের গোলাগুলিতে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। পাচারের সময় মাইন বিস্ফোরণেও হতাহতের ঘটনা ঘটে। চোরাকারবারির টাকা ভাগাভাগির দ্বন্দ্বেও একাধিক সংঘর্ষও হয়েছে।
সর্বশেষ গত ২ জুন রাতে গর্জনিয়া সীমান্তে বিজিবির সঙ্গে গোলাগুলিতে নেজাম নামের একজন নিহত হওয়ার নেপথ্যেও ছিল চোরাচালান।
বিজিবির দাবি, সীমান্তে চোরাচালান রোধে কাজ করতে গিয়ে বাহিনীর টহল দল ডাকাত দলের সদস্য নেজামের দলের গুলির মুখে পড়ে। তখন বিজিবিও পাল্টা গুলি ছোড়ে।
দুশ্চিন্তায় দেশি খামারিরা
কোরবানির আগে মিয়ানমারের গরু অবৈধভাবে আসায় লোকসানের শঙ্কায় পড়েছেন দেশের খামারিরা।
রামুর গর্জনিয়া, নাইক্ষ্যংছড়ি ও চকরিয়ার হাট থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মিয়ানমার থেকে আসা গরু-মহিষ ছড়িয়ে পড়ছে বলে জানান রামুর খামারি খলিলুর রহমান।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এভাবে গরু আসায় ঈদে আমাদের বড় লোকসানে পড়তে হবে। আবার বিদেশি এসব পশুর মাধ্যমে নানা ধরনের রোগবালাইও ছড়িয়ে পড়তে পারে।”
খামার মালিক আইনজীবী শামীম হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের একমাত্র সীমান্ত হাটে তোলা বেশিরভাগ পশুই বিদেশি। এ অবস্থায় কোরবানি মৌসুমের ব্যবসা নিয়ে আতঙ্কে আছি।”
রামুর কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের খামারি আব্দু রশীদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা ব্যাংক ঋণ শোধ করতে পারছি না। গরুর খাবারের দাম বেশি, অথচ আমরা ন্যায্য মূল্য পাচ্ছি না।
“মিয়ানমারের গরুগুলো রোগা। এ কারণে যেমন ইচ্ছা কম দামে তাদের বিক্রি করা যায়। বিভিন্নভাবে তারা সিন্ডিকেট করে, প্রশাসনকে ম্যানেজ করে গরুগুলো নিয়ে আসে।”
অবৈধভাবে মিয়ানমার থেকে গরু আনা বন্ধে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান খামারিদের সবাই।
যা বলছে চোরাচালানবিরোধী টাস্কফোর্স
মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে গরু-মহিষ দেশের অভ্যন্তরে পাচারের অভিযোগ স্বীকার করেছেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা চোরাচালানবিরোধী টাস্কফোর্সের সদস্য মো. ইয়ামিন হোসেন।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “অভিযোগ পেয়েছি, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে চোরাকারবারিরা গরু-মহিষ নিয়ে আসছে। বিজিবির সঙ্গে তাদের গোলাগুলিও হচ্ছে। টাস্কফোর্সের মাধ্যমে আমরা এসব বন্ধের চেষ্টা করছি।”
বন্ধে কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এখানে কিছু আইনগত বিষয় আছে। সবকিছু কাটিয়ে চোরাকারবারিদের লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করছি আমরা।”



