Beta
শনিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৫

অন্তর্বর্তী সরকারের ৮০ দিন : হতাশ কেন রাজনৈতিক নেতারা

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির আলোচনা সভায় বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির আলোচনা সভায় বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
[publishpress_authors_box]

বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নপূরণের অঙ্গীকার করে দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ৮০ দিনের কার্যক্রম দেখে হতাশা ঝরল অনেক রাজনৈতিক নেতার কণ্ঠে, যাদের দল শেখ হাসিনার সরকারকে হটানোর আন্দোলনে ছিল সক্রিয়।

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সোমবার ‘অন্তর্বর্তী সরকারের ৮০ দিন: গতিমুখ ও চ্যালেঞ্জসমূহ’ শিরোনামে এক আলোচনা সভায় এক হয়েছিলেন বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতারা।

সভার শুরুতেই আয়োজক দল বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে ১০টি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন।  

সেখানে অন্তর্বর্তী সরকারের সদিচ্ছার ঘাটতি না থাকলেও তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, কাজের শ্লথগতি, সরকার পরিচালনায় অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতার অভাবের বিষয়গুলো চিহ্নিত করা হয়।

পাশাপাশি উপদেষ্টাদের কারও কারও নানা কথাবার্তা সরকারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরির সুযোগ করে দিয়েছে বলেও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির পর্যবেক্ষণ।

এরপর আলোচনা করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, এবি পার্টির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু, গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, ভাষানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম বক্তব্য রাখেন।

আলোচনায় বক্তারা সংস্কার কাজের অগ্রগতি নিয়ে অসন্তোষের কথা জানান। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সরকারের সমন্বয়হীনতার কথাও উঠে আসে আলোচনায়।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল গত জুলাইয়ের শুরুতেই, আওয়ামী সরকারের দমন-পীড়নে কয়েকশ মানুষের মৃত্যুতে তা রূপ নেয় গণবিস্ফোরণে।

ছাত্র-জনতার সেই অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট টানা দেড় দশকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার তিন দিন পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার।

দেশে ‘ফ্যাসিবাদী’ শাসন আর যেন ফিরতে না পারে, সেই লক্ষ্যে প্রাতিষ্ঠানিক নানা সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেয় এই সরকার।

প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস গত ২৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেন, “বিপ্লবী ছাত্র-জনতা জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে আমাকে এক গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেছেন। তারা নতুন এক বাংলাদেশ গড়তে চান।

“বৈষম্যহীন, শোষণহীন, কল্যাণময় এবং মুক্ত বাতাসের রাষ্ট্রের যে স্বপ্ন নিয়ে ছাত্র-জনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, আমি তাদের সেই স্বপ্নপূরণে অঙ্গীকারবদ্ধ।”

সমন্বয়হীনতা

সরকার পতনের আড়াই মাস পর রাষ্ট্রপতি অপসারণে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবির দিকে ইঙ্গিত করে বিএনপি নেতা আমীর খসরু বলেন, “সংস্কারের জন্য ১০টি কমিশন করা হয়েছে। ৯০ দিনের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন আসবে।

“কিন্তু এরই মধ্যে নতুন নতুন দাবি উপস্থাপন করছে। তাদের দাবির সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার বা কমিশনের দাবি এক কি না? তা আমরা জানি না। এগুলো পরিষ্কার করতে হবে। কারণ এ দাবিগুলো সংস্কারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

রাষ্ট্রপতি অপসারণের বিষয়ে সরকারের অস্পষ্ট অবস্থান নিয়ে নাগরিক ঐক্যের মান্না বলেন, “৮ আগস্ট মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে রাষ্ট্রপতি কেন রাখলেন? বিপ্লবী সরকার হয়ে বলতেন— তার অধীনে শপথ নেব না। কিন্তু আপনি গণতান্ত্রিক পথে হাঁটলেন। সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে কারা সরাচ্ছে না, বিএনপি নাকি সরকার?”

রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে বঙ্গভবন ঘেরাওয়ের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “এটি ভালো বার্তা দেয়নি। তারা (আন্দোলনকারীরা) সরকারে থেকেই সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছেন।”

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক বলেন, “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ বিভিন্ন মহল থেকে নতুন নতুন ইস্যু সামনে নিয়ে আসায় গোটা সংস্কার এজেন্ডা এই মুহূর্তে অনেকটা পেছনে পড়ে গেছে।

“বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিরা যেহেতু অন্তর্বর্তী সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন, সে কারণে তাদের উত্থাপিত ইস্যুর পেছনে সরকারের সম্মতি বা সমর্থন রয়েছে কি না, এই প্রশ্ন জোরালভাবে দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতি অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষ চরিত্র বৈশিষ্ট্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে।”

এলডিপির সেলিম বলেন, “চুপ্পুকে কেন্দ্র করে যে অচলাবস্থা সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে, আমরা মনে করি এটা একটা ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত।”

সংস্কারে স্লথগতি

সংস্কার নিয়ে সাইফুল হক বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে জাতীয় মতৈক্যের ভিত্তিতে জরুরি সংস্কারগুলো সম্পন্ন করে সম্ভব স্বল্পতম সময়ের মধ্যে অবাধ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তক্ষেপ করে মর্যাদার সঙ্গে বিদায় নেওয়া।

“কিন্তু এ ব্যাপারে এখনও দৃষ্টিগোচর তেমন কোনও তৎপরতা নেই। এখনও নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন হয়নি।”

বিএনপি নেতা আমীর খসরু বলেন, “সংস্কারের দাবি নতুন কিছু নয়। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। যে বিষয়গুলো নিয়ে ঐকমত্য হবে, সেগুলো বাস্তবায়ন করা যায়। যে বিষয়গুলোতে হবে না, সেগুলো নিয়ে জনগণের কাছে যেতে হবে।

“নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার করে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বিষয়ে ঐকমত্য হয়ে আছে। জনগণ ভোট দিতে চায়। এতে কোনও দ্বিমত নেই।”

মান্না বলেন, “সংস্কার কাজ চলমান প্রক্রিয়া। কোনও সরকার যদি বলে সংস্কার কাজ শেষ করে নির্বাচন দেবেন, তাহলে সেই সরকার সংস্কার কাজ বোঝে না।

“অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ হলো সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা যা সংস্কার করা, তা করে নির্বাচন দেওয়া। এজন্য নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কারের কাজে তাদের জোর দেওয়া উচিৎ। তবে এখনও তারা প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সংস্কার এখনও করতে পারেনি।”

বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, “সংস্কার তো কেয়ামত পর্যন্ত চলবে। রাষ্ট্র যতদিন পর্যন্ত আছে, সংস্কার ততদিন চলবে। সব সংস্কার আপনি করতে পারবেন না।”

বেফাঁস কথায় বিতর্ক

সাইফুল হক বলেন, “গত ৮০ দিনে তাদের নানা বেফাঁস ও আবেগী কথাবার্তায় তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জনমনে বিভ্রান্তির সুযোগ তৈরি হয়েছে। তাদের কিছু পদক্ষেপ ও ঘোষণাও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।”

দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি মানুষকে নাজেহাল করে তুলছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, জন-আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী নির্বাচন ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের দুটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার ছিল জনজীবনে স্বস্তি ও নিরাপত্তা বিধান করা। এজন্য সরকারের প্রচেষ্টা রয়েছে।

“কিন্তু বাজার পরিস্থিতি এখনও বেসামাল; দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি মানুষকে নাজেহাল করে তুলছে। জনজীবনে রয়েছে উদ্বেগজনক নিরাপত্তাহীনতা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ প্রশাসনকে এখনও পেশাদারি দক্ষতায় কার্যকরি করা যায়নি।”

ঐক্যে ধরছে ঘুন

এবি পার্টির সদস্যসচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, “তিন মাস আগে সবার মধ্যে যে ঐক্য ছিল, তাতে এখন ক্ষয়িষ্ণু ভাব দেখা যাচ্ছে।”

বিএনপি নেতা আমীর খসরু বলেন, “কিছু বিষয়ে ঐকমত্যে আছে। এর বাইরেও দাবি এসেছে, কোনও আলোচনা, কথাবার্তা ছাড়া। তাহলে ঐকমত্য কি সিলেক্টিভলি (বেছে বেছে) করা হচ্ছে? সিলেক্টিভলি ঐকমত্য করলে হবে না।”

গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে সবাইকে এক থাকার ওপর গুরুত্ব দিয়ে গণসংহতি আন্দোলনের সাকি বলেন, “গণঅভ্যুত্থান কিন্তু চাইলেই ঘটানো যায় না। গণঅভ্যুত্থানের কিছু ঐতিহাসিক শর্ত থাকে, সেটা সমাজের মধ্যে পরিপক্ক হয় এবং ঘটে।

“আমাদের যে লক্ষ্যের জায়গা, সেখানে ফ্যাসিবাদবিরোধী সব শক্তির জায়গায় একমত হতে হবে। আমরা যাতে লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত না হই। এমন কিছু কাজ না করি, যাতে আমাদের লক্ষ্য অর্জনে বাধাগ্রস্ত হয়।”

এখন একটি জাতীয় রাজনৈতিক কাউন্সিল গঠনের সুপারিশ করেন তিনি।

সাকি আরও বলেন, “কেউ দাবি নিয়ে রাস্তায় নামলে আওয়ামী লীগ অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে বলে ব্র্যান্ডিং করা হচ্ছে। এটা না করে দেখতে হবে দাবির ন্যায্যতা আছে কি না?”

কোন কোন কাজে সন্তোষ

গত ৮০ দিনে সরকারের তিনটি অর্জন দেখতে পাচ্ছেন মাহমুদুর রহমান মান্না।

তিনি বলেন, ‘উন্নয়ন সহযোগীরা বড় অর্থসহায়তা দেবেন বলেছেন’, ‘দুই মাসে রিজার্ভে হাত না দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ঋণ শোধ করেছেন’ এবং ‘আরব আমিরাতে বন্দি ৫৭ জনকে মুক্ত করা।

“এর বাইরে সরকারের উল্লেখযোগ্য কোনও কাজ দেখা যায় না। জনগণের কল্যাণে তারা কোনও সংস্কার করেছে, তার প্রমাণ নেই।”

সরকারের ইতিবাচক কাজের ফিরিস্তি দিয়ে সাইফুল হক বলেন, জনগণের বিরাট প্রত্যাশার চাপ নিয়ে সরকার পরিচালনায় নানা ঘাটতি ও দুর্বলতা থাকলেও গত ৮০ দিনে দেশের ভঙ্গুর সামষ্টিক অর্থনীতিতে খানিকটা শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে, অর্থনীতি কিছুটা সচল হতে শুরু করেছে। গণ-অভ্যুত্থানকালে নৃশংস গণহত্যা ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনাল ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে; ধীরগতিতে হলেও অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার অব্যাহত রয়েছে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত